ঘাটাইলে ব্যবসায়ী খুনের নেপথ্যে
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
ঘাটাইলে ব্যবসায়ী খুনের নেপথ্যে-
বাবার হত্যার বিচার চাওয়ায় প্রাণনাশের ভয়ে পরিবার।
স্টাফ রিপোর্টার, গোপালপুর, টাঙ্গাইল । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
‘বাবা মানুষের দুঃখকষ্টে পাশে দাড়াতেন। দুর্দিনে টাকাপয়সা ধার দিতেন। ধার দেয়া টাকা চাইতে গিয়ে ওরা আমার বাবাকে মেরে ফেললো। অমানুষিক নির্যাতনে খুন করলো তাকে। ছোট্র মুদির দোকান চালিয়ে কোনোভাবে সংসার চালানো বাবাকে হারিয়ে আমরা সর্বশান্ত। খুনিরা প্রভাবশালী। মামলা তুলে না নেয়ায় আমাকেসহ পরিবারের সবাইকে গুম করার হুমকি দিচ্ছে। আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই।’ আকুতি জানিয়ে ঘাটাইলের দেউলাবাড়ি ইউনিয়নের শালিয়াজানি টোলাজান গ্রামের নিহত ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদের পুত্র সুমন মিয়া এভাবেই আর্তনাদ করছিলো। গত মঙ্গলবার সরেজমিন খোঁজ নিতে গিয়ে সামাদ হত্যাকান্ডের বিষয়ে কিছু অজানা তথ্য জানা যায়।
ঘাটাইল-গোপালপুর সড়কের শালিয়াজানি বাজারে সুমনদের বাড়ি। আবাদী জমিজমা নেই। বাবার মুদি দোকানের আয় থেকে সংসার চলতো। এখন বাবা নেই। আয়ও নেই। তাই পেট চালাতে মাছের ব্যবসা করছেন সুমন। কিন্তুজামিনে থাকা খুনিদের হুমকির মুখে তার মাছের ব্যবসা বন্ধ হতে যাচ্ছে। হুমকির ঘটনায় গত ১৭ মে ঘাটাইল থানায় জিডি করেছেন। কিন্তু থানা পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেনা।
সুমন পিতৃ হত্যায় দায়ের হওয়া মামলার বরাত দিয়ে জানান, ঘটনার দিন গত ১৩ জানুয়ারী আসামী জব্বর ও মিনারা বেগম বাড়িতে এসে পাওনা টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন। টাকা নেয়ার জন্য কুতুবপুর গ্রামে সুকোমল দত্তের মুরগী ফার্মে যাওয়ার জন্য বলেন। আসামী জব্বরের নিকট এক লক্ষ টাকা পাওনা ছিল। জব্বর ও মিনারা ওই ফার্মের কর্মচারি। পাওনা টাকার আশায় ওই দিন দুপুরে সুকোমল দত্তের ফার্মে গিয়ে সামাদ রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। খুনের অভিযোগ উঠে ফার্ম মালিক সুকোমল দত্ত, খামারের তিন কর্মচারি এবং হারুবাড়ি গ্রামের কয়েক দুবৃর্ত্তের বিরুদ্ধে। যাদের সাথে লেনদেন ছিল নিহত সামাদের।
সেদিন সন্ধ্যায় হয়ে গেলেও সামাদ বাড়ি না ফেরায় পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। স্থানীয় ইউপি মেম্বার কামরুল ইসলাম রতন এবং এক ডজন পড়শি নিয়ে সুমনরা রাত ১১টায় সুকোমল দত্তের মুরগী ফার্মে হাজির হন। ফার্মের ভিতরে তখন পৌষপার্বন চলছিল। ফার্ম মালিক সুকোমল উপস্থিত ছিলেন। নিখোঁজ সামাদের সন্ধানে মুরগী ফার্মের ভিতরে তল্লাশির কথা বললে সুকোমল ও তার কর্মচারিরা বাধা দেন। ফার্মের কর্মচারি জয়নাল তখন জানান, কিছুক্ষন আগে সামাদ বিড়ি-চুরুট পান করে ফার্ম থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। এক পর্যায়ে জয়নাল ফার্মের পাশের পাটি বেত বাগান খুঁজে দেখার কথা বলেন। এতে সকলের সন্দেহ হয়। ৬০/৭০ জনে মিলে তন্ন তন্ন করে কমল চরনের বেত বাগান খুঁজে দেখেন। কিন্তু সেখানে সামাদকে পাওয়া যায়নি। জয়নালের কথায় সন্দেহ বেড়ে যাওয়ায় ফার্মের আধা পাকা ভবন তল্লাশির প্রস্তাব দেন সুমনরা। কিন্তু ফার্ম মালিক সুকোমল দত্ত রহস্যজনক কারণে ভবন তল্লাশিতে বাধা দেন। তিনি সুমনকে পরদিন সকালে এসে ঘর তল্লাশির কথা বলেন। হতাশ হয়ে ফিরে আসেন সুমনরা।
পর দিন ১৪ জানুয়ারী সকালে সুমনরা খবর পান কমল চরনের বেত বাগানে বাবার লাশ পড়ে আছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য কামরুল ইসলাম রতনকে সাথে নিয়ে ঐস্হানে গেলে ফার্মের কর্মচারি জয়নাল বেত বাগানে পড়ে থাকা সামাদের লাশ দেখিয়ে দেন। লাশের গলায় গামছা পেঁচানো, বাম চোখ উপড়ানো এবং কান দিয়ে রক্ত পড়া অবস্থায় পাওয়া যায়। দুই পা কলা গাছের ছোবড়া দিয়ে বাধা ছিল। সুমনের অভিযোগ সুকোমলের মুরগী ফার্ম ছাড়া আশপাশের এক কিলোমিটারের মধ্যে কোথাও কলা গাছ ছিলনা। সুমন ও তার পরিবারের বদ্ধমূল ধারনা আগের দিন রাতে সুকোমলের ফার্মের ভেতরে তার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়। আর খুব ভোরে বেত বাগানে লাশ ফেলে রাখা হয়। শীতের সকালে লাশ উদ্ধার করার সময় শরীরে কোনো কুয়াশা ছিলনা। এতে ধারনা করা হয় ওই ফার্মের ভিতরেই হত্যা করে লাশ লুকিয়ে রাখে। আর সকাল বেলা লাশ বেত বাগানে ফেলে রাখা হয়।
ঘাটাইল থানা পুলিশে ঐস্হানে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য পাঠায়। ইউপি মেম্বার কামরুল ইসলাম রতন জানান খুনের ঘটনাটি পরিস্কার। এটি পরিকল্পিত। তিনি দোষীদের শাস্তি দাবি করেন। নিহত সামাদের স্ত্রী সুমলা বেগম অভিযোগ করেন, “তার স্বামীকে পাওনা টাকা পরিশোধের কথা বলে সুকোমল দত্তের খামারে ডেকে নিয়ে খুন করা হয়েছে। স্বামী নিহত হওয়ার পর সংসারে আয়রোজগার কমে গেছে। ছোট মেয়েটি সাদত কলেজে অর্নাস শ্রেণীতে পড়ে। তার খরচপত্র জোগানো যাচ্ছেনা। বড় মেয়ে স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে। এখন সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে আসামীরা জামিনে এসে পুত্র সুমনকে প্রানসংহারের হুমকি দিচ্ছে। আমরা ন্যায় বিচার চাই। আমাদের দিকে খেয়াল রাইখেন বাপজান।”
এদিকে ঘটনার পরদিন সুমন বাদি হয়ে ঘাটাইল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। আাসামী করা হয় আয়নাল, তামিল, মামুন, রেজাউল, জব্বরসহ অজ্ঞাত তিনচার জনকে। থানা পুলিশ জয়নাল ও মিনারা বেগমকে আটক করে জেলহাজতে পাঠায়। তবে মূল আসামী গ্রেফতারে এবং প্রভাবশালী ফার্ম মালিক সুকোমল দত্তকে জিজ্ঞাসাবাদে থানা পুলিশ টালবাহানা শুরু করে। থানা পুলিশ মামলার তদন্তেও গড়িমসি শুরু করলে গত মার্চ মাসে টাঙ্গাইল সিআইডিতে মামলা স্থানান্তর হয়। সিআইডির দারোগা আতাউর রহমান আকন্দ মামলার তদন্তভার গ্রহন করেন। তিনি বাদির সহযোগিতায় সম্প্রতি ঢাকা থেকে এজাহারভূক্ত চার নাম্বার আসামী রেজাউলকে পাকড়াও করেন। কিন্তু রেজাউল ১৯ দিন পর আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান। জয়নাল ও মিনারা এখন জামিনে রয়েছে। এজাহারভূক্ত ২ ও ৩ নাম্বার আসামী তামিল ও মামুন সম্প্রতি আদালতে হাজিরা দিলে বিচারক তাদেরকে জেলহাজতে পাঠান।
সুমনের অভিযোগ আসামীরা সবাই জামিনে বেরিয়ে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন। সুকোমল প্রভাবশালী হওয়ায় এবং বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ায় মামলা ভিন্ন পথে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। সুকোমলকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে।
এলাকবাসিরা জানান, সুকোমল দত্তের মাছ ও মুরগী খামারটি অসামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু। অফিসের নামে নির্মাণ করা দুটি আধা পাকা ভবনে জুয়া ও নেশার আসর বসে। কাজেই সেখানে খুনখারাপি বিচিত্র কিছু নয়। এ ব্যাপারে সুকোমল দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, খুনের সাথে তিনি জড়িত নন। তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। তার খামার খোলামেলা জায়গা। সেখানে খুনখারাপি হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। ফার্মে কখনো কোনো আপত্তিকর কিছু হয়না। এলাকাবাসি এ ধরনের কোনো অভিযোগ দিতে পারেনা। সিআইডির দারোগা আতাউর রহমান আকন্দ বলেন, খুনের রহস্য উদঘাটনে নানা সমীকরণ মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। আসামী তামিল ও মামুনকে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। শীঘ্রই ব্যবসায়ী সামাদ হত্যার রহস্য উদঘাটন হবে বলে তিনি আশাবাদি।
- কাগজটুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।