গণ দাবীর আংশিক পূরণে অভিনন্দন তবে
গণ দাবীর আংশিক পূরণে অভিনন্দন তবে…
রণেশ মৈত্র
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
বহু বছর পরে হলেও, নানা টালবাহানা ও ঢিলেমি সত্বেও, অবিশ্বাস্য রকমের বিপুল ব্যয়ে প্রাচীন দৈনিকের ২১ নভেম্বরে শেষের পৃষ্ঠায় এক কলাম শিরোনামে প্রকাশিত হলেও বিষয়টি জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিরোনামটি হলো “মানিকগঞ্জে বিজয় দিবসে চালু হচ্ছে আরিচা-নগরবাড়ী ফেরী সার্ভিস”।
খবরে বলা হয়েছে, যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর চাপ কমাতে অতি শীঘ্রই চালু হচ্ছে মানিকগঞ্জের আরিচা-নগরবাড়ী ফেরি সার্ভিস। ২০০২ সালের মার্চ মাসে এই রুটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আগামী বিজয় দিবসের মধ্যেই নতুন ফেরি চলাচলের জন্য এই রুটের শুভ উদ্বোধন করা হবে।
জানা গেছে, নৌপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করার লক্ষ্যে সরকার ৫১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে নদী বন্দর নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্প গ্রহণ করে যা আগামী ২০২১ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করা হবে। প্রকল্পের মূল কাজের মধ্যে ভূমি উন্নয়ন ড্রেজিং, পাকা জেটি, তীর রক্ষা বাঁধ, সংযোগ সড়ক, স্টীল গ্যাংওয়ে, পল্টুন, কাঁটাতারের সীমানা প্রাচীর, যাত্রী ছাউনি, পাকা সিঁড়ি, গুদাম, উন্মুক্ত স্থান, বন্দর ভবণ, পরিদর্শন বাংলো, ডরমিটরী ও পাওয়ার হাউস নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবী করেন।
এদিকে আগামী বিজয় দিবসের আগেই যাতে এ নৌরুট চালু করা সম্ভব হয়, সেই লক্ষ্যে ফেরী সেক্টর বিআইডব্লিউটিসি চেয়ারম্যান খাজা নিয়ামসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন প্রকল্পের কাজগুলো ইতোমধ্যে পরিদর্শন করেছেন। দীর্ঘ আঠার বছর যাবত আরিচা-নগরবাড়ী ফেরী সার্ভিস বন্ধ থাকায় হাজার হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হন।
মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয় জানা, আরিচা-নগরবাড়ী ফেরী চলাচলটি দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। ফলে জনগণের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু সেতুরউপর চাপ কমাতে এবং এই অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের যাতায়াতের সুবিধার জন্য আগামী বিজয় দিবসেই আরিচা-নগরবাড়ি ফেরি সার্ভিস চালু হবে। এই রুটটি চালু হলে আরিচা ঘাটের সেই প্রাণ চঞ্চলতা ও জৌলুস ফিরে আসবে।
প্রকাশিত খবরের বিবরণ এটুকুই।
এ সম্পর্কে কতিপয় প্রশ্ন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উত্থাপন করছি যার সঠিক উত্তর জনস্বার্থে বাঞ্ছনীয়। প্রশ্নগুলি হলো:
এক. উপরে আরিচা ঘাটে যা যা নির্মাণের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে সেগুলি অপর প্রান্তের নগরবাড়ী ঘাটেও নির্মাণ করা হয়েছে?
দুই. ড্রেজিং আদতে কতটা করা হয়েছে। বিশাল নদী যমুনা। বর্ষাকালে নদীটি সমুদ্রের রূপধারণ করে। প্রবল ¯্রােতও বইতে থাকে। তাই পূরো নদীটির এপার থেকে ওপার পর্য্যন্ত এবং ওপার থেকে এ পার পর্য্যন্ত যাথেষ্ট পরিমাণে গভীর করে ড্রেজিং করা হয়েছে কি? প্রতি এক বা দুই বছর পর ড্রেজিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে কি?
তিন. সারা দিনে-রাতে এই রুটে কতগুলি ফেরী চলাচল করবে? যাত্রীদের এবং চলমান অসংখ্য যান-বাহন ঘন্টার পর ঘন্টা নদীর উভয় পাড়ে ফেরী অভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি সংবাদপত্রগুলিতে আর প্রকাশিত হবে না তো?
চার. উভয় তীরে আধুনিক হোটেল নির্মিত হয়েছে কি? না কি অতীতের মত নোংরা হোটেলগুলিতে বসে বা সেগুলির সামনে দাঁড়িয়ে নারী-পুরুষ-শিশু যাত্রীদেরকেউড়ন্ত ধূলায় ভরা ভাত, মাছ, সবজী, মাংস,জল খেতে হবে? বিশুদ্ধ খাবার জল সবার জন্যে ও খাঁটি দুধ কি শিশুদের জন্যে সুলভ মূল্যে সহজলভ্য হবে?
এ প্রশ্নগুলি নেহায়েতই প্রাসঙ্গিক। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যত সত্বর সম্ভবএগুলির জবাব চাইব।
কিন্তু সেতু? মন্ত্রী মহোদয় নজর দিন
মূল দাবীটি কি ছিল?
বস্তুত: ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু চালু হওয়ার পর থেকেই নগরবাড়ী-আরিচা রুটটি কার্য্যত: বন্ধ করে দেওয়া হয় অঘোষিতভাবে। তার বহু আগে থেকেই উত্তরবঙ্গের অনেকগুলি জেলে ব্যবসায়ীরা, পরিবহন মালিকেরা এবং নানা সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনের তরফ থেকে দাবী উঠেছিল নগরবাড়ী-আরিচা সেতু নির্মাণ করা হোক-তাতে বাস, ট্রেন, পথচারী চলাচল ও গ্যাস পাইপ লাইন সংযোগ করা হোক। এই সেতু নির্মিত হয় নি আজও। ফলে উত্তরবঙ্গের (রাজশাহী বিভাগের) মানুষ যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
এই রুটে ফেরী সার্ভিস চালু হয়ে যাচ্ছে-এটি সুখবর। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? ফেরী চলাচল বন্ধ হওয়ার কয়েক বছর পর যখন দেখা গেল যমুনা সেতু দিয়ে বাস চলাচল অত্যন্ত সময় সাপেক্ষএবং ব্যয় বহুল হওয়ায় স্বল্পবিত্ত যাত্রীদের পক্ষে ঐ ব্যয় বহন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে তখন কয়েক বছর হলো পরিবহন সার্ভিসগুলোর বেশীরভাগ এ/সি গাড়ীগুলি যমুনা সেতু দিয়ে চালু রাখতে কিন্তু নন-এসি বেশীরভাগ যাত্রীবাহী বাস নগরবাড়ী-আরিচা রুটে চালু করতে নিজেদের কোম্পানীর জন্য ছোট ছোট ফেরী কিনে সেগুলি চালু করে ফেললো। তাই সবই চালু হয়েছে, বিশেষ করে যাত্রী চলাচল। সময় লাগছে সেতু দিয়ে যাতায়াতে যা লাগে তার অর্ধেক ভাড়াও তাই। ফলে বেশী বেশী করে যাত্রীরা এই পথেই চলতে সুরু করায় ফেরী সার্ভিস বন্ধ থাকা জনিত সমস্যা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। সমস্যা মূলত: ট্রাকগুলির। ফেরী চলাচল চালু হলে ট্রাকগুলির সুবিধা হবে।
বলা হচ্ছে, এই রুটে ফেরী চলাচল শুরু হলে যমুনা সেতুর উপর চাপ কমবে। কমবে ঠিকই কিন্তু কতটা কমবে?মনে রাখা দরকার, আমাদের দেশে লোকসংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা-তাই হু হু করে বাড়ছে যাত্রী, কার, মাইক্রোবাস, মিনি বাস, বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান প্রভৃতি। তাই যমুনা সেতুর উপর চাপ ক্রমবর্ধমান এবং বিরতিহীন। এই সমস্যাটিকে লঘু করে দেখার কোন অবকাশ নেই।
আমরা যদি পদ্মা সেতুর মত ব্যয়বহুল সেতু নিজ তহবিলে নির্মাণ করার যোগ্যতা অর্জন করে থাকি তবে যমুনা সেতুর উপর ক্রমবর্ধমান চাপ তথা নগরবাড়ী আরিচা বহুমুকী সেতু নিজস্ব অথবা বিদেশী অর্থায়নে কেন নির্মাণ করতে পারবো না? ইচ্ছে থাকলে অবশ্যই তা পারা যাবে।
আমরা জানি মানিকগঞ্জের শিবালয় ঘাটে একটি ফেরী নির্মাণ করে রেল সংযোগ দেওয়ার জন্য একটি জন সমর্থনহীন প্রকল্প কয়েক বছর আগে নিয়ে অঢেল টাকাব্যয় করে প্রথমে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থেকে একটি রেলপথ নির্মাণ কাজ চালু করা হয়েছে এবং তা ঢালার চর পর্য্যন্ত সমাপ্তি হয়েছে। বহু কাজ এখনও বাকী শেষ করতে কতদিন লাগবে তা কেউই বলতে পারেন না। বলেছি জনসমর্থনহীন প্রকল্প। তার প্রমাণও ইতিমধ্যেই নিলেছে। ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালার চর সিঙ্গল লাইননির্মাণ করে দিনে ঈশ্বরদী-ঢালারচর এবং ঢালার চর-পাবনা-রাজশাহী একটি করে ট্রেন চলাচল শুরু করলেও তা লাভের মুখ দেখে নি দেখবেও না। কারণ ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালারচর লাইনে যাত্রী কোনদিনই পাওয়া যাবে না। ঐ পথে চলাচলের মানুষের আদৌ প্রয়োজন পড়ে না সেই কারণে।
আবার ঐ লাইনটাই পাবনা থেকে সুজানগর-কাশীনাথপুর-বেড়া পর্য্যন্ত যাওয়ার কথা কিন্তু কতদিনে নির্মিত হবে-কতদিনে ঐ পথে ট্রেন চলাচল শুরু হবে-তাও অজানা। তবে এইটুকু জানা যে, ওটিতেই লোকসান হবে যাত্রী স্বল্পতার কারণে।
সে কারণেই ঈশ্বরদী থেকে ডবল লাইন নির্মাণ করে পাবনা হয়ে আতাইকুলা বনগ্রাম, দুলাই-কাশীনাথপুর-নগরবাড়ী পথ জনগণের দাবী অনুযায়ী নির্মাণ করলে দিনে একাধিক ট্রেন চালু করে রেলওয়ে লাভের মুখ দেখতে পারতেন। সরকারের কাছে প্রস্তাব এটাই ছিল। এই প্রস্তাব সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীনও ছিল। কিন্তু সাবে একজন মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী তাঁদের এলাকার স্বার্থে বৃহত্তর জাতীয় ও বেশী সংখ্যক মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালার চর সিঙ্গল লাইন রেলপথ নির্মাণ ও ট্রেন চলাচল চালু করে অহেতুক লোকসানের মুখ দেখতে বাধ্য হচ্ছে রেল বিভাগ আবার অধিকতর সংখ্যক যাত্রীও সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন।
যা হোক, সেতু ও রেল মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন রাখবো যে লাইন নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে তা অক্ষুন্ন রেখেই প্রথমে নগরবাড়ী-আরিচা সেতু নির্মাণ করে তাতে রেল, বাস-ট্রাক প্রভৃতি সব ধরণের যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা হোক এবং ডবল লাইন নির্মাণ (পাবনা-নগরবাড়ী-আরিচা-ঢাকা) করে প্রত্যহ দু’তিনটি করে ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করা হোক।
এ দাবী বহু পুরাতন। নানা রকম পরীক্ষা-ইতিবাচক মনোভাবও পোষণ করেছিল কিন্তু মাঝখানে প্রকল্পটি পথ হারিয়ে ভিন্নপথে চলে গেল।
আশা করি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেতু মন্ত্রী মহোদয় অবিলম্বে নগরবাড়ী-আরিচা বহুমুখী নির্মাণের কাজে হাত দিন।
রেলমন্ত্রী মহোদয়, দ্রুততার সাথে পাবনা-আতাইকুলা-বনগ্রাম-দুলাই-কাশীনাথপুর-নগরবাড়ী ডবল লাইন রেলপথ নির্মাণে অগ্রসর হোন। এ পথে রেলপথ নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে অতন্ত কম কারণ বহুদিন আগে থেকেই মহাসড়ক এ পথে চালু রয়েছে।
অতীতে এ নিয়ে অনেকবার লিখেছি। আশা করি এই দফা লেখার পর এ বিষয়ে আর লেখার দরকারও পড়বে না।