ঘুরে আসুন বাংলাদেশের প্রকৃতির অপ্সরা বিছনাকান্দি

সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী পানি – পাহাড় -পাথরের নতুন ভ্রমণ গন্তব্য বিছনাকান্দি। আকাশছোঁয়া পাহাড়ের কোলে এ জায়গায় আাছে প্রকৃতির অপরূপ রূপের বিছানা পাতা। পাশেই বয়ে চলা স্বচ্ছ শীতল পানির পাহাড়ি নদী পিয়াইন। ছোট বড় পাথরের মাঝে পিয়াইন নদীর মায়াবী স্রোত। আপনাকে করবে শান্ত । সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার রস্তুমপুর ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা এ জায়গা এখন পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। পাথর বিছানো বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপরে বয়ে চলা মেঘালয়ের পাহাড়ি ঝরনাধারা বিছনাকান্দির মূল আকর্ষণ।

IMG_2967 (1)

অতীতের জাফলংয়ের সঙ্গে বিছনাকান্দির অনেকটাই মিল আছে। অস্বাভাবিকভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে জাফলং ধ্বংস হলেও বিছনাকান্দি ঠিকঠাকই আছে কারন বিছানা কান্দির কিছু মানুষ তা ধরে রেখেছে । বলা চলে সামাজিক কিছু মানুষ রেখেছে তাদের ভুমিকা । মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ছোট বড় পাথরের উপর দিয়ে ছুটে আসা স্বচ্ছ পানির স্রোতধারা সৃষ্টি করেছে এক মনোরম পরিবেশ। যা হতে পারে ভ্রমণ পিপাসীদের জন্য এক আকর্ষনীয় স্থান। সবকিছু মিলেবে বিছনাকান্দিতে। যেমন জাফলং এর মতো স্বচ্ছ পানি, পাথর আর পাহাড়ের মিলন, মাধবকুন্ডের মতো ঝর্ণা, কক্সবাজারের মতো জলের ঢেউ, শীতল মিষ্টি পানি; এ যেন অনন্য বিছানা কান্দি ।
জলের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে পাথরের টুকরা। পাথর ছুঁয়ে জল গড়িয়ে মিশে যাচ্ছে স্রোতস্বিনীতে। সেই পাথর ছোঁয়া জলে অপরূপ রূপ ধারণ করে আছে প্রকৃতির অপ্সরা বিছনাকান্দি। ডুবু ডুবু পাথর আর জলখেলার দৃশ্যে এ অপ্সরা মুহূর্তেই মন কেড়ে নেবে যে কোনো সৌন্দর্য পিপাসুর। দূরের চেরাপুঞ্জি আর কাছের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার জল আর পাথুরে বিছানায় বিছনাকান্দির নিবাস। বছরের পর বছর এখানের পাথর জমে প্রস্তরময় আকারে গড়ে উঠেছে সবুজের কোল আর লাল পাহাড়। সিলেটের গোয়াইঘাট সীমান্তে পাথর কোয়ারী হিসেবে পরিচিত বিছানাকান্দি। অপ্সরীর সাজানো পাথর বিছানা আর অগভীর স্বচ্ছ জলে যে কেউ নাও ছাড়িয়ে গা ভাসিয়ে প্রকৃতির কোলে চড়তে পারেন। এখনও আড়ালেই রয়ে গেছে পাহাড়-পাথর-জলে বন্দী অপ্সরী বিছনাকান্দি। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এখনও পরিচিত হয়ে ওঠেনি স্থানটি। আর যারা একবার গেছেন, মুগ্ধ হয়ে বার বার ছুটে আসছেন বিছানাকান্দির কূলে। সারা বছরই রূপ মেলে থাকে বিছনাকান্দি। বর্ষার ভরাট জলে তার মায়াজাল আরও বেশি বিস্তৃত হয়। তবে শুকনো মৌসুমেও হতাশ হতে হয় না পর্যটকদের। ছড়িয়ে থাকা পাথরে মেলে ধরা রূপে তাকে বিস্মিত হতেই হয়। বিছনাকান্দি যাবার আগেই উঁচু পাহাড় স্বাগত জানাতে জানাতে ধীরে ধীরে যেনো কাছে চলে আসে। এরপর জল ছিটিয়ে প্রকৃতির রূপের ডালি খুলে যায়।যাবার পথে বালির আস্তরণ ভেদ করে এক ঘণ্টার নৌকাভ্রমণ আনন্দকে দ্বিগুণ করে তোলে।
ভারতের পাহাড় ভেদ করে বাংলাদেশের বুকে জল গড়িয়ে আসছে। এই অগভীর জলের নীচে আছে পাথরের প্রলেপ। প্রকৃতি এতো সুন্দর করে পাথর বিছাতে পারে, সেটা এখানে না এলে বোঝা যেতো না। স্বচ্ছ জলে ডুব দিলে সাগরতলের মত সবকিছু দেখা যায়। যা সত্যিই রোমাঞ্চকর। সামনে অথবা পেছনে সুউচ্চ পাহাড় রেখে নৌকা বেয়ে পথচলার অসাধারণ সৌন্দর্যের দেখা মেলে বিছনাকান্দিতে। স্থানটি পরিচিতি পেলে সিলেটের পর্যটন আকর্ষণে অন্য অনেক স্থানকে ছাপিয়ে যেতে পারে। শুধু পাথরে জলের খেলাই নয়। এখানে প্রকৃতি, পাহাড় আর মেঘজমা পর্বতের মোহনীয় জাল আটকে দেবে সবাইকে।বর্ষায় পিয়াইন থাকে পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ। তবে শীতে শুকিয়ে পানি তলায় ঠেকে। তখন পিয়াইন হেঁটেই পার হওয়া যায়। তবে বর্ষায় ভরা পিয়াইন নদীতে চলতে চলতে এর দুই পাশের দৃশ্য দেখে বিমোহিত হবেন যে কেউ। এর চারপাশটাই যেন ছবির মতো। পিয়াইনে চলতে চলতে দূরে দেখা যাবে আকাশে হেলানো উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি। চারপাশের চোখ ধাঁধানো সব দৃশ্য দেখতে দেখতে এক সময় এই পাহাড়ের কোলে এসে চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ পাথর কেয়ারি। বর্ষায় পাথর কেয়ারি পানিতে ডুবু ডুবু। এখান থেকে একটু সামনেই সীমান্ত ঘেঁষা পাথর-জলের বিছনাকান্দি।

thumbnail_Sylhet3
বিছনাকান্দিতে পাথর-জলের বিছানা মুগ্ধ হওয়ার মতো। এখানে পাথরের বিছানার উপরে পাশের পাহাড় থেকে অনবরত স্বচ্ছ পানির ধারা বহমান। তবে বর্ষায় পানির প্রবাহ বেড়ে যায় কয়েকগুন। এ সময়ে মূল ধারায় স্রোত অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
বিছনাকান্দির বিছানা বাংলাদেশ আর ভারত মিলিয়ে। স্বাভাবিক ভাবে সীমানা চিহ্ণিত করা নেই এখানে। জায়গাটিতে তাই সাবধানে বেড়ানো উচিৎ। বাংলাদেশ অংশ ছেড়ে ভারত অংশে চলে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। সাঁতার জানা না থাকলে এ ভ্রমণে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট নেওয়া উচিৎ। তাছাড়া ভ্রমণে গিয়ে কোনো বর্জ্য জায়গাটিতে ফেলে আসবেন না।

ঢাকা থেকে কিভাবে যাবেন বিছনাকান্দিতে?

ঢাকা থেকে সিলেটে আপনি ট্রেনে বা বাসে করে যেতে পারেন। সিলেট শহরের যে কোন প্রান্ত থেকে রিজার্ভ করা সিএনজি নিয়ে জেতে হবে হাদার পার বাজার, ভাড়া নেবে বড়জোর ৭৫০ টাকা। সিলেটের আম্বরখানা থেকেও যাওয়া যায় আলাদাভাবে। সেখানে প্রতি সিএনজিতে পাঁচজন করে নেয়া হয় হাদার পাড় বাজার পর্যন্ত। ভাড়া জনপ্রতি ১২০ টাকা। সময় লাগবে দু ঘণ্টার মত। হাদার পাড় বাজার নেমে নৌকা ঠিক করতে হবে বিছানাকান্দি পর্যন্ত। ভাড়া নেবে ৪০০-৫০০ টাকা আপ ডাউন। স্থানীয়রা ইদানিং পর্যটক বেসি দেখে নৌকার কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে নৌকা ভাড়া বেশি নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে ৮০০-১০০০ টাকা লাগতে পারে। দামাদামি করে উঠবেন, কারণ হাদার পাড় বাজার থেকে বিছানাকান্দির দুরত্ব খুব একটা বেশি না। ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যেতে সর্বোচ্চ ২০ মিনিট লাগে। আপনি চাইলে হেঁটে ও যেতে পারেন । হাদার পাড় থেকে কুয়ারি বাজার । একটা ছোট নদী পাড় হতে নেয় ১০ টাকা । তাঁর পড় হাটতে থাকলে ৩০ মিনিট লাগবে ।

কোথায় থাকবেন?

বিছনাকান্দি ও আশপাশে থাকার ভালো ব্যবস্থা নেই। সিলেট শহর থেকে খুব সকালে গিয়ে সারাদিন বেড়িয়ে রাতে এসে থাকতে হবে সিলেট শহরেই। এ শহরে থাকার জন্য বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল আছে।
শহরের শাহজালাল উপশহরে হোটেল রোজ ভিউ (০৮২১-৭২১৪৩৯)। দরগা গেইটে হোটেল স্টার প্যাসিফিক (০৮২১-৭২৭৯৪৫)। ভিআইপি রোডে হোটেল হিলটাউন (০৮২১-৭১৬০৭৭)। বন্দরবাজারে হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল (০৮২১-৭২১১৪৩)। নাইওরপুলে হোটেল ফরচুন গার্ডেন (০৮২১-৭১৫৫৯০)। জেল সড়কে হোটেল ডালাস (০৮২১-৭২০৯৪৫)। লিঙ্ক রোডে হোটেল গার্ডেন ইন (০৮২১-৮১৪৫০৭)। আম্বরখানায় হোটেল পলাশ (০৮২১-৭১৮৩০৯)। দরগা এলাকায় হোটেল দরগাগেইট (০৮২১-৭১৭০৬৬)। হোটেল উর্মি (০৮২১-৭১৪৫৬৩)। জিন্দাবাজারে হোটেল মুন লাইট (০৮২১-৭১৪৮৫০)। তালতলায় গুলশান সেন্টার (০৮২১-৭১০০১৮) ইত্যাদি। এছাড়াও সিলেট শহরের সব জায়গায় বেশ কিছু হোটেল আছে। এসব হোটেলে ৫০০ বা ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় বিভিন্ন মানের কক্ষ আছে।

সাবধানতা

বর্ষায় পাহাড়ি ঢল থাকে বলে পিয়াইন নদীতে এ সময়ে স্রোত খুব বেশি। তাই বিছনাকান্দি যাওয়ার পথে ছোট নৌকা পরিহার করা উচিত। ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে বেড়াতে চেষ্টা করুন। এছাড়া এখানকার নৌকাগুলোতে লাইফ জ্যাকেট থাকে না। যারা সাঁতার জানেন না, সঙ্গে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট নিবেন।

এছাড়া বিছনাকান্দি জায়গাটি আসলে নো ম্যানস ল্যান্ড ঘেঁষা। সীমান্তে চলাচলের সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন। সীমান্ত যাতে অতিক্রম না করেন সেদিকে খেয়াল রাখুন।

সেলিনা জাহান প্রিয়া

লেখক, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!