টাঙ্গাইলে বিদ্যুতের অসহনীয় লোডশেডিং, বিদ্যুৎ চুরি ও বিলের ভোগান্তি॥ জনজীবন অতিষ্ঠ॥
রাশেদ খান মেনন (রাসেল), টাঙ্গাইল, বিশেষ প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
টাঙ্গাইলে বিদ্যুতের অসহনীয় লোডশেডিং, দুর্নীতি ও বিলের ভোগান্তির কারনে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ভোগান্তির কারনে যেকোন সময় ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।
টাঙ্গাইলে বিদ্যুতের ভোগান্তি ও তীব্র গরমে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে জনজীবন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে হালকা বৃষ্টি হলেও ভ্যাপসা গরম কিছুতেই কমছে না। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। কোন কোন এলাকায় কিছু দিন যাবৎ একটানা দুই তিন ঘন্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে, ব্যহত হচ্ছে স্বাভাবিক কাজকর্ম। গত পনের দিন যাবৎ অফিসগামী মানুষ, শ্রমিক, স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী এবং অল্প বয়সের শিশুরা গরম ও তীব্র তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালগুলোতে গরমের কারনে বৃদ্ধি পেয়েছে ডায়রিয়া পক্স সহ অন্যান্য রোগে অসুস্থ রোগীর সংখ্যা। এর মধ্যে চলে এসেছে রমজান মাস।
২৮ মে রবিবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড টাঙ্গাইলের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিক্রয় ও বিতরন) মো. শাহাদৎ আলীর কাছে বিদ্যুতের ভোগান্তির জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন পুরো জেলায় প্রায় ১৪০ মেঘাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। এছাড়া পৌর এলাকায় ডিভিশন ১ এর অধীনে প্রায় ২৪ মেঘাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আমরা ১৮ থেকে ২০ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। ন্যাশনাল গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। এর বাইরে আর কিছুই বলতে পারবনা। বিস্তারিত তথ্য পাবেন বৈল্লা গ্রিডে।
বৈল্লা গ্রিড ডিভিশন ২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম এর সাথে কথা বলে জানা যায় টাঙ্গাইল জেলায় ১৪৫ থেকে ১৭৫ মেঘাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। সরবরাহ হচ্ছে প্রায় ৮০ মেগাওয়াট। এরমধ্যে পৌর এলাকার চাহিদা প্রায় ৩০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ ঘাটতি ও ট্রান্সফরমার সহ অন্যান্য যন্ত্রাংশের ওভার লোডিংয়ের কারনে লোডশেডিং হচ্ছে। তিনি আরো বলেন প্রয়োজনের তুলনায় বর্তমানে কম বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে,একারনে লোডশেডিং হচ্ছে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই এ সমস্যা কমবে কমতে পাওে বওে জানান তিনি।
কথা হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড টাঙ্গাইলের সহকারী প্রকৌশলী আল হেলাল আজাদের সাথে। তিনি বলেন বিদ্যুতের লোডশেডিং খুব একটা হচ্ছেনা। লোডশেডিং বেশী হলে আমরাই ব্যবস্থা নেব।
বিদ্যুৎ বিল নিয়ে গ্রাহকের ভোগান্তিঃ বিদ্যুৎ বিল নিয়ে সারা টাঙ্গাইল জুড়ে শুরু হয়েছে জণদূর্ভোগ। প্রতিদিন সাবালিয়ায় বিদ্যুৎ অফিসে বিলের জন্য ভীর করছে শতশত ভুক্তভোগী গ্রাহক। কেউ কেউ দুই তিন মাসের বিলের কোন কাগজ পায়নি, অনেকেই বিল পরিশোধের পর আবার ওই বিল যোগ হয়ে বাড়তি বিল এসেছে, কারো কারো আগে যেখানে পাঁচশত থেকে সাতশত টাকা বিল আসত সেখানে দিগুন এমনটি তিনগুন বিল এসেছে। কলেজপাড়ার গ্রাহক মোস্তাফিজুর রহমান ২৮মে বিদ্যুৎ বিল নিয়ে বিদ্যুৎ অফিসে আসেন মিটারের সাথে বিলের গড়মিল দেখে। যাচাই করে দেখা যায় মিটারের অতিরিক্ত সাড়ে আটশত ইউনিটের বিল তাকে দেয়া হয়েছে। দেওলার গ্রাহক এডভোকেট প্রবীর কুমার মোদক বিদ্যুৎ অফিসে নতুন আরেকটি সমস্যা নিয়ে। তার বাসায় গত মাসে বিল এসেছে ২৮১ টাকা, এইমাসে বিল এসেছে ১৫৭৯ টাকা। বেসরকারী চাকরীজীবী মুকিম জানায়, তার বাসায় প্রায় তের মাস যাবৎ সে বিদ্যুতের সংযোগ নিয়েছে। প্রতিমাসে পাঁচশত সাতমত কিংবা আটশত যে টাকা বিল এসেছে সে তার বিল সময়মত পরিশোধ করেছে। কিন্তু হটাৎ করেই এ মাসে তার বিল এসেছে তের হাজার টাকা। পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডেও বাসিন্দা মো. ওয়াহেদুজ্জামান ৩ মাস যাবৎ বিলের কোন কাগজই পায়নি। টাঙ্গাইল এজি অফিসের কর্মকর্তা মো. মকবুল হোসেন বলেন বিলের সমস্যার সমাধান করতে প্রায়ই বিদ্যুৎ অফিসে যাই। কিন্তু কোন সমাদান পায়নি । দিনদিন ভোগান্তি বাড়ছেই। এরকম অনেকেই এধরনের ভোগান্তিতে পড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিলের সমস্যা নিয়ে আসা লোকজনের সাথে বিল প্রদানকারী লোকজনের বাকবিতন্ডা লেগেই রয়েছে। বাক বিতন্ডা থেকে যেকোন সময় ঘটতে পাওে মারাত্মক দুর্ঘটনা। কোন প্রতিকার না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে প্রায় সকলকেই। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড টাঙ্গাইলের নির্বাহী প্রকৌশলী সহকারী প্রকৌশলী আল হেলাল আজাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে জানা যায় বিদ্যুৎ বিল গ্রাহকদের কাছে পৌছানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নতুন প্রতিষ্ঠান মুন পাওয়ারকে। মুন পাওয়ারের প্রায় সকলেই নতুন। তাই হয়তো তারা কাজ সামাল দিতে হিমশিম কাচ্ছে। তবে আশা করা যায় দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান হবে। বিদ্যুৎবিল গ্রাহকগণ কেন সময়মত পাচ্ছেনা ও বাড়তি বিল কেন আসছে জানতে চাইলে মুন পাওয়ার টাঙ্গাইলের প্রজেক্ট ম্যানেজার রেজাউল করিম বলেন আমরা নতুনভাবে দায়িত্ব নিয়েছি। আমাদের স্টাফরা নতুন। কাজ বুঝে উঠতে ও গ্রাহকদের বাসাবাড়ি চিনতে কিছুটা সময় লাগছে। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান হবে।
বিদ্যুৎ চুরির ঘটনাঃ বিলের ভোগান্তির সাথে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ চুরির ঘটনা। টাঙ্গাইলের বিসিক শিল্প নগরীর উত্তর পূর্বদিকে এ আর টেক্্রটাইল মিল নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায় মিলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যন্ত্রাংশ বিক্রি করার পর মিলের বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে রাতে চোরাই লাইন ব্যবহার করা হচ্ছে। অব্যবহ্রত মিলের ভিতর ব্যাটারী চালিত অটোরিক্সা ও অটোর ব্যাটারী প্রায় প্রতিদিন রাতে চার্জ দেয়া হয়। এরকম টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এরাকায় বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নয়তো বিদ্যুত অফিসে কর্মরত স্টাফদের সাথে অবৈধ টাকা লেনদেনের মাধ্যমে শহরের আনাচে কানাচে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে এভাবে প্রতিরাতে বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে। এ কারনে লোডশেডিংসহ অতিরিক্ত বিলের বোঝা গ্রাহকদের বইতে হচ্ছে। বিভিন্ন যায়গায় অবৈধভাবে বিদ্যুত সংযোগ ও বিদ্যুৎ চুরি যারা চুরি করছে তাদের বিষয়ে কি পদক্ষেপ নিবেন জানতে চাইলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড টাঙ্গাইলের নির্বাহী সহকারী প্রকৌশলী আল হেলাল আজাদ বলেন এব্যপারে আমার কিছু করনীয় নেই। এটা আমার দায়িত্বে পড়েনা। এবিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে কথা বলেন।
লোডশেডিং, বিদ্যুতবিভ্রাট ও লো-ভোল্টেজের কারণে সকল কাজই ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। যান্ত্রিক ও ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বিদ্যুতের ঘনঘন আসা-যাওয়া এবং গ্রামে দীর্ঘ সময়ের লোডশেডিংয়ে আবাসিক গ্রাহকেরা পড়েছে চরম দুর্ভোগে। বিদ্যুতের ঘনঘন আসা-যাওয়ার ফলে ইন্টারনেট সংযোগেও দেখা দিয়েছে বিভ্রাট। ফলে অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জরুরী কাজসহ সংবাদকর্মীদের সংবাদ আদান প্রদানে ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার কাছ থেকে জানা যায়, বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে একটু ঝড়বৃষ্টি হলেই বিদ্যুত বিভ্রাট সৃষ্টি হয়। দুর্বল সঞ্চালন, বিতরণ ব্যবস্থা এবং বেশকিছু পুরনো ও নিম্নমানের ট্রান্সফরমারের কারণে এই বিভ্রাট বেশি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে শহর ও গ্রামাঞ্চলে।
বিদ্যুৎ অভিযোগ কেন্দ্রের সেলফোনগুলো বেশীরভাগ সময়া রিং হওয়ার পর কেউ রিসিভ করেনা।ঘনঘন লোডশেডিং হওয়ায় প্রচন্ড গরমে শিশু, নারী ও বয়ষ্ক মানুষের কষ্টের সীমা নেই। গরমে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি বাড়ছে। বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুত নির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য এখন প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা।
টাঙ্গাইল জেলার ভুক্তভোগী গ্রাহকদের কেউ কেউ অভিযোগ করে বলেন, ঝড় বৃষ্টি হওয়ার আগে একটু বাতাস শুরু হলেই বিদ্যুত লাইন বন্ধ হয়ে যায়।
আসছে রমজান মাসে ইফতার-তারাবি ও সেহরির সময় লোডশেডিং না দিয়ে সর্বত্র নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দ্রুত পদক্ষেপ কামনা করেছে ভুক্তভোগী টাঙ্গাইলবাসী।
- কাগজটুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।