জনস্বার্থে বিশ্বের সর্বোচ্চ ‘রিটকারী’ মনজিল মোরসেদ!
অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
মনজিল মোরসেদ। দেশজুড়ে তিনি রিটকারী বা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলাকারী হিসেবে বেশি পরিচিত। তবে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবীর পরিচিতি এখন বিশ্বময় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আর এর সবই তিনি সম্ভব করেছেন সমাজের নানান সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে গিয়ে।
সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ এই আইনজীবী ১৯৫৯ সালে ঝালকাঠি জেলার কীর্তিনাশা উইনিয়নের বাউলকানন্দা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
জন্মের পর স্থানীয় মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর বরিশাল কলেজ থেকে এইচএসসি, ঝালকাঠি সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এর পাশাপাশি সেন্ট্রাল ল’কলেজ থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
১৯৮৮ সালে আইন পেশায় যোগদান করেন তিনি। এরপর দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা জজ আদালতে আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনা করেন।
সেখান থেকে সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভূক্তির পর দেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের জুনিয়র (কনিষ্ঠ আইনজীবী)হিসেবে মামলা পরিচালনা করেন। সেখানে প্রায় পাঁচ বছর আইন প্রাকটিস করেন।
এরপর ২০০৩ সাল থেকে স্বতন্ত্রভাবে দেশের উচ্চ আদালতে সম্মানের সঙ্গে আইন পেশায় নিজেকে সর্বাগ্রে প্রমাণ করে চলেছেন। তার সেই সব কথা নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের সাক্ষাৎকার পর্বটি।
কিভাবে তিনি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন এবং এর ফলে জনসেবায় তার চেষ্টা, অবদান প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন পরিবর্তন ডটকমের সঙ্গে। নিচে তার সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বটি তুলে ধরা হলো:
আইন পেশায় জনস্বার্থে মামলা করতে উদ্বুদ্ধ হলেন কিভাবে?
কিছু আইনজীবী ফি ছাড়া মোটেই কাজ করতে চান না। ফি পেলেই মামলা নিয়ে চিন্তা করেন। নইলে করেন না। কিন্তু আমি যখন ঢাকা দায়রা জজ আদালতে আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস শুরু করি তখন আমার এক আত্মীয়র মৃত্যুর খবর পাই এবং আমাকে তার জানাযায় অংশ নিতে আজিমপুর যেতে বলা হয়। জোহরের নামাজের পর জানাজায় অংশ নিতে আমি কোর্ট (মহানগর দায়রা জজ) থেকে বারোটার দিকে রওনা হলাম। তখন ছিলো কুরবানি ঈদের আগের সময়। আমি রিকশায় করে আজিমপুর যেতে যেতে ওই জানাজা আর পাইনি। সেখানে পৌঁছাতে তিন/চার ঘন্টা লেগেছিল। ওইসময় আমার কাছে মনে হলো যে, এই রাস্তাঘাটে এত জ্যাম কেন? এর কোনো প্রতিকার কি আইনে নেই?
তখন দেখলাম যে, বুয়েটের পাশ থেকে রাস্তার ওপর গরুর হাঁট বসানো। তখন আমার মাথায় একটা জিনিস এলো। এই যে ঢাকা শহরটি, এই শহরের জন্যওতো একটা আইন আছে। সিটি করপোরেশন আইন, ডিএমপি আইন প্রভৃতি। সেসব আইনে এমন কি কোনো বিধান নেই যেখানে রাস্তায় চলাচলের বিধান ঠিক রাখা যায়?
এভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সমস্যা সামনে আসলে তখন এর প্রতিকার খুঁজতে আইন-আদালতের দ্বারস্থ হয়ে রিট মামলা করতে থাকি।
জনস্বার্থের মামলায় নিজেকে কখন থেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করলেন?
হাইকোর্টে আইন পেশা পরিচালনার সময় থেকেই নিজেকে জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত করার চেষ্টা শুরু করি। আর এজন্য জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট রিট মামলায় বেশি গুরুত্ব দিতে থাকি। তখন ভাবলাম জনস্বার্থে কিছু করতে হলে তা একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এজন্য কিছু সমমনা আইনজীবী, যারা সমাজকে কিছু দিতে চান তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কেননা যারা রাজনীতি করেন তারাতো রাজনীতির মাধ্যমে অবদান রাখেন। আর রাজনীতি ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে তো কিছু করার সুযোগও কম। তবুও কিছু করার প্রবল আগ্রহ নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা করলাম। সেই মোতাবেক আইনজীবীদের নিয়ে আমি একটি সংগঠন তৈরী করলাম। সমমনা আইনজীবীদের নিয়ে সংগঠনটির নাম দিলাম ‘হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)’।
নিজের প্রথম রিট মামলা নিয়ে কিছু বলুন …
প্রথমেই ঢাকার রাস্তায় কুরবানির হাট নিয়ে রিট করলাম। তখন কোর্ট আমাকে জানালো, এটাতো ধর্মীয় বিষয়। আপনিতো বিপদে পড়বেন। তখন ওই কোর্ট কোনো আদেশ দেননি। পরে ওই মামলায় আরেক কোর্ট আদেশ দেন। এরপর ডিসেম্বর মাসে নিম্ন আদালত বন্ধ থাকার বিষয়েও রিট মামলা করেছি।
এরপর বিভিন্ন সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারি দেশের নদী দখল, পরিবেশ দূষণ, মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘণ, পুলিশের নির্যাতন, নারী নির্যাতন ইত্যাদি খবর। এসব সমস্যা অর্থাৎ যেখানে কোনো আইনী প্রতিকার হয়না সেক্ষেত্রে আমরা আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়ে মামলা শুরু করতে লাগলাম।
রিট মামলায় বিচারপতিদের আগ্রহ কতটুকু?
এই মামলাগুলো চালাতে গিয়ে দেখলাম, বিচারকগণ তাদের হাত প্রশস্ত করছেন। রিট মামলায় সময় নিয়ে জনগণের লাভের জায়গাটাকে আদালতের সামনে তুলে ধরলাম। আদালতও বিষয়টি ভালোভাবে নিলেন। এভাবে ধীরে ধীরে রিট মামলার শুরু।
এ পর্যন্ত কতটি রিট মামলা করেছেন?
আমি এ পর্যন্ত ২৮০টি মামলা করেছি। যা সমগ্র বিশ্বে ব্যক্তির দায়েরকৃত সর্বোচ্চ জনস্বার্থের মামলার রেকর্ড। তবে এর মধ্যে ৬০টি মামলার রায় হয়েছে। তার মধ্যে দুটি মামলায় আমি হেরেছি। একটি হলো, সুন্দরবনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সংক্রান্ত মামলা(আপিলে হেরেছি, রিভিউ এর প্রস্তুতি নিচ্ছি)। আরেকটি হলো, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে রাজনৈতিক নমিনেশনের বিরুদ্ধে মামলা, এই মামলায়ও আমরা হেরেছি। এটিতে হাইকোর্টের রায় পেয়েছি এবার আপিল বিভাগে যাবো।
নিজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রিট মামলা সম্পর্কে বলুন।
খাদ্যে ভেজাল রোধ, আদালত অবমাননার আইন করা হয়েছিল যেটা স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করে তার বিরোধীতাও করে মামলা করেছি। দুর্নীতি দমন কমিশনকে অকার্যকর করার বিষয়ে একটি আইন করা হয় সেটিও আমি চ্যালেঞ্জ করেছি।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মামলা করেছি, সেখানে আমরা আপিল বিভাগে জয় লাভ করেছি। এভাবে পরিবেশ রক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে মানুষকে সঠিক বিচার পাইয়ে দেওয়ার ভূমিকা রাখতে কাজ করে যাচ্ছি।
এছাড়াও ঢাকার চার নদী, কুয়াকাটা সি বিচের জায়গা দখন রোধ, সূচিত্রা সেন ও বেগম রোকেয়ার বাড়ি উদ্ধার, লালবাগ কেল্লার জায়গা দখল রোধ, ঢাকায় ট্রাফিক জ্যাম নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে যান চলাচলে আদালতে ২২ দফা নির্দেশনা, জিএমপি অনুসারে ওষুধ উৎপাদন না করায় তার উৎপাদন বন্ধ করা সহ নিজের সাধ্যমত জনস্বার্থে মামলা করে যাচ্ছি।