বিশ্বখ্যাত জাদু সম্রাট পিসি সরকারের ১০৩তম জন্ম বার্ষিকী
আধুনিক বাঙালীদের মধ্যে যে কয়জন ক্ষণজন্মা মানুষ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, ঐন্দ্রিজালিক পিসি সরকার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বিশ্বখ্যাত জাদু সম্রাট পিসি সরকার অর্থাৎ প্রতুল চন্দ্র সরকারের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী আজ বৃহস্পতিবার(২৩ ফেব্রুয়ারি)। ১৯১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের আশেকপুরে তিনি জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা ভগবান চন্দ্র সরকার এবং মাতা কুসুম কামিনী দেবী। প্রচন্ড দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা প্রতুল চন্দ্র সরকার জাদু শিল্পে বিশ্ব জয় করে ‘জাদু সম্রাট’ উপাধি লাভ করেন।
টাঙ্গাইল শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন শিবনাথ হাইস্কুলে প্রতুল চন্দ্র সরকারের শিক্ষাজীবন শুরু। বাল্যকাল থেকেই জাদুবিদ্যার প্রতি কৌতূহল এবং কিছুটা বংশগত ঐতিহ্যও তাঁকে এ পেশায় আগ্রহী করে তোলে। গণপতি চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর জাদুবিদ্যার গুরু। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি জাদু দেখানো শুরু করেন এবং কলেজে অধ্যায়নকালে পুরোপুরি প্রাকটিস শুরু করেন। তবে সাধারণ লেখাপড়া এতে বাধাগ্রস্ত হয়নি।
শিবনাথ হাইস্কুল থেকে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি ভর্তি হন করটিয়া সা’দত কলেজে। তখন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন বিখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবিদ ইব্রাহিম খাঁ। কলেজে ভর্তি হয়েও তিনি জাদুর ওপর পড়াশোনা আর ম্যাজিকের চর্চা করতে থাকেন। সারা কলেজে তখন তার প্রচুর নাম-ডাক। চায়ের দোকানে, খেলার মাঠে সকলের মুখে মুখে প্রতুলের অদ্ভুত জাদু খেলার প্রশংসা।
এমন সময় একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সপেক্টর ড. হরেন মুখার্জি এবং কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মি. হার্লে করটিয়া সা’দত কলেজ পরিদর্শন করতে আসেন। তাদের আগমন উপলক্ষ্যে প্রতুলের জাদু প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রতুল অনুষ্ঠানে এমন সব চমৎকার জাদুখেলা দেখান যে, তারা দুজনেই খুবই মুগ্ধ হন।
করটিয়া কলেজে পড়ার সময়ে তিনি ‘হিপ্নোটিজম’ নামে একটি বইও লিখেন। তখনকার করটিয়া কলেজ ছিল ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত। তাই ১৯৩১ সালে আইএ পাস করে ডিগ্রি পড়ার জন্য তিনি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে তিনি অংকে(গণিত) অনার্স নিয়ে বিএ পরীক্ষা দেন। আনন্দমোহন কলেজে পড়ার সময় তিনি ‘ম্যাজিক শিক্ষা’ নামে আরও একটি বই লেখেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি জাদুকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে তার নাম-ডাক এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, তিনি হলে অথবা কোথাও ম্যাজিক দেখাচ্ছেন শুনলেই দেখতে দেখতে প্রচুর দর্শকের সমাগম হতো। ম্যাজিক বিষয়টিকে ভুতবাজি, ঠক, মাদারি, ভন্ড তান্ত্রিকদের হাত থেকে মুক্ত করে পিসি সরকারই বিশ্ব সভ্যতার আঙিনায় নিয়ে আসেন।
জাদুকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পর তিনি চলে যান বড় শহরে, বৃহত্তর ক্ষেত্রে। কারণ গ্রামে পড়ে থাকলে তার প্রসার জমবে না। তাই তিনি কলকাতায় পাড়ি জমান। প্রথমে তিনি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। পরে কলকাতার বালিগঞ্জে নিজেই বাড়ি করেন। অল্পদিনের মধ্যেই কলকাতা শহরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি নিয়মিত জাদুর অনুষ্ঠান করতে থাকেন, আর সেই সঙ্গে পত্রপত্রিকাতেও শুরু করেন জাদু বিষয়ে লেখালেখি। দুদিকেই তার খ্যাতি বাড়তে থাকে। টাঙ্গাইলের সেই প্রতুল সরকার সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে পিসি সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
জাদু শিল্পে পিসি সরকারের কৃতিত্ব হল তিনি বহু প্রাচীন জাদু খেলার মূল সূত্র আবিষ্কার করেন। ‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’ পিসি সরকারের আরেকটি জনপ্রিয় খেলা। ১৯৩৪ সালে তিনি সর্ব প্রথম বিদেশে গমন করেন এবং ৭০টির মতো দেশে জাদু প্রদর্শন করে ব্যাপক খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এ সময় তিনি পর্যাপ্ত অর্থও উপার্জন করেন।
১৯৫৭ সালে পিসি সরকার লন্ডনের বিবিসি টেলিভিশনে করাত দিয়ে এক তরুণীকে কেটে দু’টুকরো করে দেখিয়ে ছিলেন। এতে বহু টেলিভিশন দর্শক অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। পরের দিন লন্ডনের বড় বড় পত্রিকা ওই লোমহর্ষক ও বিস্ময়কর খেলার খবরের সচিত্র বিবরণ প্রকাশ করে।
ওই বিস্ময়কর খেলা দেখানোর পরপরই ১৯৫৭ সালের ২২ মে পিসি সরকারকে আমেরিকা টিভি কোম্পানিগুলো বিশেষ বিমানে করে তাদের দেশে নিয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে তিনি আবার আমেরিকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ পান। এ সময় তিনি আন্তর্জাতিক রোটারি ক্লাবের সদস্য এবং বিলেতের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির আজীবন ফেলো নির্বাচিত হন।
কলকাতা ইম্পেরিয়াল রেস্টুরেন্টে শেরেবাংলা একে ফজলুল হককে যে জাদু দেখিয়ে তিনি মুগ্ধ করেন, তার শিরোনাম ছিল ‘বাংলার মন্ত্রী মণ্ডলীর পদত্যাগ’ এ শিরোনামের একটি সাদা কাগজে প্রথমে তিনি শেরেবাংলা ফজলুল হককে কিছু লিখতে বলেন এবং তার নিচে মন্ত্রিগণ স্বাক্ষর করেন। কিছুক্ষণ পর শেরেবাংলা ফজলুল হক তাঁর নিজের লেখার পরিবর্তে দেখেন আমরা সর্বসম্মতিক্রমে সকলেই এই মুহূর্তে মন্ত্রীরা পদত্যাগ করলাম এবং আজ হতে জাদুকর পিসি সরকারই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
ফোর্স রাইটিং খেলাটি দেখিয়ে ভারতের সংবাদপত্র মহলে মহাআলোড়ন ফেলে দেন। ঠিক তার পরই বিদেশে একটি বিশেষ দ্রুতগামী রেলগাড়ি আসার মাত্র ৩৮ সেকেন্ড আগে তিনি হাতকড়ি বন্ধ অবস্থায় ট্রেন লাইন থেকে মুক্ত হয়ে আসেন। এই হাতকড়িটি খুলতে ১৭টি চাবি ব্যবহার করা হতো। সেই জন্য ইংল্যান্ডের জাদুকর সম্মিলনীর তৎকালীন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি উইল গোল্ড স্টোন তাঁকে বলেছিলেন, তুমি জন্মসিদ্ধ জাদুকর।
কলকাতার জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক উত্তম কুমারকে দিয়ে তিনি তার বিশ্ববিখ্যাত জাদু খেলা ‘কায়া যায় ছায়া থাকে’ খেলাটি দেখিয়েছিলেন। পিসি সরকার উত্তম কুমারকে স্টেজে আমন্ত্রণ জানান এবং পেছনে একটি সাদা স্ক্রিনে তাঁকে দাঁড়িয়ে রাখেন। পর্দায় তীব্র সার্চ লাইটের আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গে উত্তম কুমারের ছায়া পর্দায় ভেসে ওঠে। স্টেজে তিনি তাঁকে আসন গ্রহণ করতে বলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য উত্তম কুমার পর্দা থেকে সরে গেলেও তার ছায়াকে তিনি পর্দায় বন্দি করে রাখেন। ‘কায়া যায় ছায়া থাকে’ পিসি সরকারের এক অত্যাশ্চর্য খেলা। ১৯৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় উত্তমকুমারকে দিয়ে তিনি এই খেলাটি দেখিয়েছিলেন। সারা পৃথিবীতে পিসি সরকার ছাড়া এ খেলা আজ পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারে নি।
পিসি সরকার শুধু জাদুশিল্পীই ছিলেন না, তিনি একজন লেখকও ছিলেন। জাদুবিদ্যার ওপর তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন। ১৯৬৮ সাল নাগাদ ইংরেজি, বাংলা ও হিন্দি ভাষা মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২০টি।
পিসি সরকারের জাদু বিভিন্ন দূরদর্শনে যথা অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশন, বিবিসি, শিকাগোর ডব্লিউজিএন টিভি এবং নিউইয়র্কের এনবিসি ও সিবিএস টেলিভিশনে বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৫৭ ও ১৯৬৭ সালে আমেরিকায় এবং ১৯৬২ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো ও লেনিনগ্রাদ শহরে জাদু প্রদর্শন করে তিনি বিপুল সুনাম অর্জন করেন। পিসি সরকারই প্রথম রাজকীয় পোশাক এবং আকর্ষণীয় পাগড়ি পরে জাদু প্রদর্শনের প্রচলন করেন।
জাদু দেখিয়ে পিসি সরকার দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ স্টেজ ম্যাজিকের জন্য আমেরিকার জাদুবিদ্যার নোবেল প্রাইজ বলে খ্যাত ‘দি ফিনিঙ অ্যাওয়ার্ড’ তিনি দুবার লাভ করেন। এছাড়া তিনি ‘গোল্ডবার’ পুরস্কার, ‘সুবর্ণ লরেল মালা’ নামে জাদুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় জার্মান পুরস্কার, হল্যান্ডের ‘ট্রিঙ পুরস্কার’ এবং ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি লাভ করেন। তাঁর সম্মানে নতুন পোস্টাল স্ট্যাম্প চালু হয়। জাদুখেলার কৃতিত্বের জন্য মায়ানমারের (বার্মার) প্রধানমন্ত্রী থাকিন নু তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘এশিয়ার গৌরব’।
পিসি সরকার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বার্থে ১৯৩৭ সালে জাপান সফরের সব অর্থ দান করেন। তিনি ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মান, বেলজিয়াম এবং জাপানে ম্যাজিশিয়ান সমিতির অন্যতম সদস্য ছিলেন। জাদুশিল্পে অসাধারণ পারদর্শিতার জন্য বিশ্ববাসীর কাছ থেকে তিনি ‘জাদু সম্রাট’ ও সর্বকালের ‘শ্রেষ্ঠ সম্রাট’ উপাধি লাভ করেন।
জাদুসম্রাট পিসি সরকারের পারিবারিক জীবন ছিল অত্যন্ত সুশৃংখল ও শান্তিময়। ১৯৩৮ সালে তিনি টাঙ্গাইলের নামি চিকিৎসক প্রমথনাথ গুহ মজুমদারের প্রথম কন্যা বাসন্তী দেবীকে বিয়ে করেন। বাসন্তী দেবী ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিনী। পিসি সরকার যখন তার জাদুর খেলা নিয়ে মগ্ন থাকতেন ঘরের বাইরে কিংবা বিদেশে তখন লক্ষীর মতো সংসার সামাল দিতেন তার স্ত্রী বাসন্তী দেবী।
পিসি সরকারের দুই মেয়ে এবং তিন ছেলে। বড় ছেলে প্রফুল্ল চন্দ্র সরকার ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার। মেজ ছেলে অ্যাপ্লাইড সাইকোলজিতে মাষ্টার্স করে বর্তমানে পিতার পেশায় নিয়োজিত। তিনি বর্তমানে জুনিয়র পিসি সরকার নামে খ্যাত। ছোট ছেলে কমার্শিয়াল পাইলট।
বিশ্ব বিখ্যাত এ জাদুকর দশম বারের মতো জাপানে ‘ইন্দ্রজাল’ প্রদর্শনের জন্য আমন্ত্রিত হয়ে তিনি দলবল নিয়ে জাপানে যান। কিন্তু তার আর ফিরে আশা হয়নি। জাপানেই ১৯৭১ সালের ৬ জানুয়ারি তাবেৎসু (সাপোরো) শহরে জাদু সম্রাট পিসি সরকার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৭ বছর।
জাদু শিল্পকে যিনি বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রতে ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্বের বুকে বাংলার ও বাঙালীকে গৌরবোজ্জ্বল জাতি হিসেবে নতুনভাবে পরিচিত করেছেন, সেই প্রতুল চন্দ্র সরকারকে (পিসি সরকার) আমরা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আমাদের বাঙালীর বুক আজও তাঁর জন্য গর্বে ফুলে ওঠে।
সম্পাদনায়- মাহবুব এইচ শাহীন/প্রকাশক ও সম্পাদক/কাগজ২৪