তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা ক্ষতিপুরণ দেয়ার নির্দেশ
আইন-আদালত ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আজ রোববার বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। আলোচিত এই মামলাটির রায়ে তিনদিন ধরে পর্যবেক্ষণ দেন আদালত। এর আগে দ্বিতীয় দিনের সাক্ষীদের বর্ণনা ও রাষ্ট্রপক্ষের সাবমিশনের বর্ণনা করেন। গত বুধবার প্রথম এই রায় পড়া শুরু হয়।
২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জ জেলা জজ আদালতে মোটরযান অরডিন্যান্সের ১২৮ ধারায় বাস মালিক, চালক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করা হয়। পরে মামলাটি হাইকোর্টে বদলির নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করেন বাদীরা। নিহত তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ প্রায় ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১৩ আগষ্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীর। তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটির সঙ্গে চুয়াডাঙ্গাগামী একটি বাসের সংঘর্ষ ঘটে। তাতে তারেক-মিশুকসহ মাইক্রোবাসের পাঁচ আরোহীর মৃত্যু হয়। আহত হয় আরো কয়েকজন।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে। পরে ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মানিকগঞ্জে মোটরযান অর্ডিন্যান্সের ১২৮ ধারায় বাসমালিক, চালক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মানিকগঞ্জ জেলা জজ ও মোটর কেইমস ট্রাইব্যুনালে দুটি মামলা করেন।
এরপর মোকদ্দমা দুটি জনস্বার্থে হাইকোর্টে বিচারের জন্য সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ অনুসারে আবেদন করা হয়। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের ডিভিশন বেঞ্চ এক রায়ে মোকদ্দমা দুটি হাইকোর্টে বিচারের পক্ষে মত দেন। এজন্য উপযুক্ত বেঞ্চ গঠন বিষয়ে পদপেক্ষ নিতে প্রধান বিচারপতির কাছে মামলা দুটির নথি ও আদালত বদলির আবেদনের নথি পাঠানো হয়।
পরে প্রধান বিচারপতি বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য বিচারপতি জিনাত আরার নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চে পাঠান। ওই বেঞ্চে এই মামলার স্বাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। মামলায় ক্যাথরিন মাসুদের পক্ষে ৭ জন, বাস মালিকের পক্ষে ৫ জন এবং ইন্সুরেন্স কোম্পানির পক্ষে একজন হাইকোর্টে স্বাক্ষ্য দেন।
আদালতে ক্যাথরিনের পক্ষে ড. কামাল হোসেন ও সারা হোসেন, বাস মালিকের পক্ষে আব্দুস সোবহান তরফদার ও রিলায়েন্স ইন্সুরেন্সের পক্ষে ইমরান এ সিদ্দিকী ও এহসান এ সিদ্দিকী শুনানি করেন।
ফিরে দেখা তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের জীবন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় করা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে আজ বুধবার। ‘কাগজের ফুল’ চলচ্চিত্রের শুটিং লোকেশন নির্বাচন করতে গিয়ে ২০১১ সালে মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বাংলাদেশের দুই মেধাবী সন্তান। কেমন ছিল তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের জীবন?
১৯৫৭ সালে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তারেক মাসুদ। বাবার নাম মশিউর রহমান মাসুদ ও মায়ের নাম নুরুন নাহার মাসুদ। তারেক মাসুদের শিক্ষা জীবন মাদ্রাসায় শুরু হলেও পরবর্তীতে তিনি স্কুলে ভর্তি হন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮২ সালের শেষ দিকে এসএম সুলতানের উপর আদম সুরতের মাধ্যমে প্রথম ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। ১৯৮৯ সালে এটি মুক্তি পায়।
এরপর থেকে তিনি বেশ কিছু ডকুমেন্টারি, এনিমেশন এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ২০০২ সালে তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মাটির ময়না মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং দেশে-বিদেশে বিশেষ প্রশংসা অর্জন করে। বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগঠন শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তারেক মাসুদ। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেয়ার পাশাপাশি কয়েকটি সাময়িকী ও পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখালেখি করতেন।
তারেক মাসুদ ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার হাত ধরেই বিশ্বে পৌঁছায় এদেশের চলচ্চিত্র। তার নির্মিত মুক্তির গান ও মাটির ময়নাসহ অনেক সিনেমাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে।
এ পর্যন্ত তার প্রকাশ হওয়া চলচিত্র ও ডকুমেন্টারিগুলো হলো, রানওয়ে, আ ক্যাইন্ড অফ চাইল্ডহুড, মাটির ময়না, নারীর কথা, মুক্তির কথা, ইন দ্য নেইম অফ সেফটি, ভয়েসেস অফ চিলড্রেন, মুক্তির গান, ইউনিসন, সে, আদম সুরত, অন্তর্যাত্রা, নর সুন্দর।
মিশুক মুনীর ছিলেন এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তারেক মাসুদের প্রায় সব সফল চলচ্চিত্রে ক্যামেরার কাজটি করেছেন তিনি। ক্যামেরার পেছনে থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে পথ দেখিয়েছেন দক্ষ হাতে।
পড়ালেখা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিক বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি প্রথম ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে “ভিডিও জার্নালিজম কোর্স”-এর সূচনা করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে পুরোদস্তুর সাংবাদিকতায় যুক্ত হন।
মিশুক মুনীর ১৯৯৯ সালে একুশে টেলিভিশনের প্রথম যাত্রায় হেড অফ নিউজ অপারেশনের দ্বায়িত্ব নিয়ে দেশে আন্তর্জাতিক ধারার টেলিভিশন সাংবাদিকতার জন্ম দেন। নিজ হাতে গড়ে তোলেন একুশে টেলিভিশনের সংবাদ টিম। তিনি ২০০১ সাল পর্যন্ত একুশে টিভির বার্তাপ্রধান (পরিচালনা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০২ সালে দেশের গন্ডি ছাপিয়ে সরাসরি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখেন মিশুক মুনীর। আফগানিস্থানে চিত্রায়িত প্রামান্য চিত্র রির্টান টু কান্দাহারের প্রধান চিত্রগ্রাহক ছিলেন তিনি। কাজ করেছেন বিশ্বনির্মাতাদের সঙ্গে।
২০০৭ সালে কানাডীয় সাংবাদিক পল জেয়োর সাথে প্রতিষ্ঠা করেন আন্তর্জাতিক সংবাদ টেলিভিশন রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্ক। সেখানে তিনি সম্প্রচার প্রধান ও পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন। টরন্টোর ব্রেকথ্রো ফিল্মস, জে ফিল্মস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে ফ্রিল্যান্স ক্যামেরাপারসন ও প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন।
মিশুক মুনীর একাডেমি অব কানাডিয়ান সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশনের এবং কানাডিয়ান ইনডিপেনডেন্ট ক্যামেরাম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এবং কানাডিয়ান সোসাইটি অব সিনেমাটোগ্রাফির সহযোগী সদস্য ছিলেন।
সম্প্রচার সাংবাদিকতার রূপকার মিশুক মুনীর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিবিসির ভিডিওগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন।