সংসারের মায়া ছেড়ে গেল যে জন, দাও প্রভু দাও তারে অনন্ত জীবন!
নিকোলাস বিশ্বাস, বিশেষ প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
আজ ১২ জুলাই ২০২১ স্বর্গীয় তুফান বিশ্বাস মহাশয়ের প্রয়াণের ৪০তম দিবস যাকে স্থানীয়ভাবে ‘চল্লিশা’ বলা হয়। গত ৩ জুন ২০২১ খ্রীষ্টাব্দে তুফান বিশ্বাস বার্ধক্যজনিত কারণে পরলোকগত হন। তিনি গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্গত মুকসুদপুর উপজেলাধীন বানিয়ারচর গ্রামের বাসিন্দা। তুফান বিশ্বাস ছিলেন এলাকার একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী কাঙ্গালী ভোজ ও জাতীয় শোক দিবস আয়োজক কমিটির স্থানীয় সভাপতি ছিলেন যারা দীর্ঘ চরাই-উৎরাই পার হয়ে প্রায় ৩৫ বছর যাবৎ নিজস্ব তহবিল গঠন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদৎ বার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় পালন করে আসছেন।
প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করে আজ রোজ সোমবার দিনব্যাপী বিশ্বাস-বাড়িতে তার আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সমন্বয়ে বিশেষ গান-প্রার্থনা ও স্মৃতিচারণ-সভার পরিকল্পনা ছিল কিন্তু দেশের বর্তমান করোনার ভয়াল পরিস্থিতির কারণে এটা করা সম্ভব হয়নি। তবে যথাযত স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্পসংখ্যক লোকের উপস্থিতিতে স্থানীয় ক্যাথলিক চার্চের যাজক ফাদার জার্মেইন সঞ্চয় গমেজের পৌরহিত্বে স্বর্গীয় তুফান বিশ্বাসের স্মরণে পবিত্র ‘খ্রীষ্টযাগ’ উৎসর্গ করা সহ তার আত্মার চির কল্যাণে বিশেষ প্রার্থনা-সভার আয়োজন করা হয়।
স্বর্গীয় তুফান বিশ্বাস খ্রীষ্টধর্মের অনুসারী। তাই খ্রীষ্টধর্মের ঐতিহ্য অনুযায়ী মৃত্যুপরবর্তী ৪০ দিন মৃতব্যক্তির আত্মার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথাগত বিশ্বাসমতে এ সময় পরলোকগত ব্যক্তির আত্মা প্রভুর রাজ্যের উদ্দেশ্যে অন্তিম যাত্রা শুরু করে এবং এক পর্যায়ে স্বর্গধামে পৌছায়। পবিত্র বাইবেলে এই ‘চল্লিশা’ সম্পর্কে তেমন কিছুর উল্লেখ নেই তবে ‘৪০ সংখ্যাটি’ নিয়ে বাইবেলে বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এগুলো হল: ক) নোহ্ নবীর আমলে সংঘটিত ৪০ দিন ধরে জলপ্লাবন; খ) ভাববাদী মোশীর সিনাই পর্বতে ধ্যান-প্রার্থনার জন্য এক নাগাড়ে ৪০ দিন অবস্থান; গ) মরুপ্রান্তরে একটানা ৪০ দিন যীশুর উপবাস/রোজা পালন; এবং ঘ) পুনরুত্থানপরবর্তী ৪০ দিন পার্থিব জগতে অবস্থান করার পর যীশুর স্বর্গারোহন। শেষের ঘটনাটি খ্রীষ্ট-ধর্মাবলম্বীদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, খ্রীষ্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, মৃত্যুর পর নির্দিষ্ট সময়ে তাদের আত্মা অনন্তকালের জন্য প্রভুর রাজ্যে স্থান পায়।
স্বর্গীয় তুফান বিশ্বাসের তয় সন্তান নিকোলাস বিশ্বাস বলেন: আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমাদের প্রিয়তম পিতা (তুফান বিশ্বাস মহাশয়) তার অন্তিমযাত্রা সমাপণে প্রভুর রাজ্যে স্থান পেয়েছেন এবং এখন তাঁর সঙ্গেই আছেন। তিনি আরো বলেন, গত ৪০ দিন ধরে আমাদের গৃহে আমার স্ত্রী সীমা বিশ্বাসের উদ্যোগে প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্বল্পপরিসরে আমার প্রয়াত পিতার আত্মার কল্যাণে গান-প্রার্থনা সহ রোজারিও মালা সম্পন্ন করা হয়েছে।
শ্রীমান তুফান বিশ্বাস ১৯২৮ সালের ৮ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারে তারা ছিলেন মোট চার ভাই। এদের মধ্যে তিনি ছিলেন মেঝো। তার পিতার নাম শ্রীমান বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস এবং মাতার নাম শ্রীমতি অন্তি রাণী বিশ্বাস। বিপিন এবং অন্তি তাদের চার ছেলের নামগুলো রেখেছিলেন প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও তার ছন্দময়তায়। বড় থেকে ছোট ছেলের নাম পর্যায়ক্রমে রেখেছিলেন – ঝড়ু বিশ্বাস, তুফান বিশ্বাস, পবন বিশ্বাস এবং গগন বিশ্বাস। উল্লেখ্য যে, তারা সবাই পরলোকগত হয়েছেন। ভাইদের মধ্যে তুফান বিশ্বাসই সবার শেষে পরলোকগত হলেন।
তুফান বিশ্বাসের বাবার পরিবারে খুবই অভাব-অনটন ছিল। এজন্য অল্প বয়সেই তাকে অর্থ উপার্জনে নামতে হয়েছিল। তবে কোন কাজকেই তিনি অবহেলা করেননি। তাই শুন্য হাতে শুধুমাত্র পরিশ্রম আর সততাকে পূঁজি করে তিনি এগিয়ে গেছেন এবং পরিবারে স্বচ্ছলতা বয়ে এনেছেন। এজন্য তাকে অনেক চরাই-উৎরাই পার হতে হয়েছে। তুফান বিশ্বাস সর্বদা কম কথা বলতেন কিন্তু কাজ করতেন বেশী। তিনি অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন না বটে কিন্তু ছিলেন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতি সহ সর্বক্ষেত্রে তার ছিল সমান পদচারণা।
স্বর্গীয় তুফান বিশ্বাস সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টে সর্বদা সমব্যাথী হওয়ার চেষ্টা করতেন এবং সাধ্যমত তাদের পাশে দাঁড়াতেন। গত বছর করনাকালীন সময়ে- মে, জুন ও জুলাই মাসগুলোতে তিনি তার সাধ্যমত পাড়া-প্রতিবেশীদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন এবং ত্রাণসামগ্রী দিয়েছেন। তিনি এলাকার জনকল্যাণমূলক কাজেও বিশেষ ভূমিকা রাখতেন। উল্লেখ্য যে, জলিরপাড় বঙ্গরত্ন (ডিগ্রী) কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য শুরুর দিকে তিনি আট শতক জমি দান করেন। এছাড়াও, তিনি এলাকার বেশ কয়েকজন ছেলেকে পড়াশুনার জন্য অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন।
সংসারের মায়া ছেড়ে তুফান বিশ্বাস চিরদিনের জন্য পরমপিতার কাছে চলে গেছেন। তিনি আর কোনদিন এই ধরাধামে ফিরবেন না। আশা করি তার রেখে যাওয়া গুণাবলী ও আদর্শ সমাজের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বরণ করবে। আজকের এই বিশেষ দিনে প্রভুর চরণে আমাদের বিনম্র মিনতি: দাও প্রভু, দাও তারে অনন্ত জীবন! আমেন!!