দায়িত্ব নিচ্ছেন ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর
অনলাইন ডেক্স । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
আগামীকাল শনিবার ডাকসু নির্বাচনে জয়লাভকারীদের অভিষেক অনুষ্ঠান। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে একেবারেই নায়কোচিত উত্থান হয়েছে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুরের। তবে ভিপি পদে নির্বাচিত হওয়ার পর দ্বিমুখী আচরণ ও কথাবার্তায় জনপ্রিয়তার পারদ কিছুটা কমেছে। নানা নাটকীয়তার পর অভিষেকেও যাচ্ছেন তিনি। তাকে ঘিরে চলছে নানামুখী আলোচনা, সমালোচনা। শেষ পর্যন্ত নুর কি নায়ক থাকবে নাকি রাজনীতির খলনায়কে পরিণত হবে?
জানা গেছে, অনিয়মের নানা অভিযোগ এবং অধিকাংশ প্যানেলের প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জনের মধ্যে ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের নেতা নুরুল হক নুর। গত ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় এ নির্বাচন। নির্বাচনে ২৫টি পদের মধ্যে ২৩টিতে ছাত্রলীগ এবং দুটি পদে জয়লাভ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভিপি পদটিতে জয়লাভ করে নুরুল হক নুর।
আজ শুক্রবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে নুরুল হক নুর জানান, তিনি আগামীকাল শনিবার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তার সঙ্গে প্যানেলের সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনও দায়িত্ব নেবেন। এসময় নুরুল হক বলেন, শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে ডাকসুর কার্যকরী সভায় আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করব। পুনর্নির্বাচনের দাবিসহ শিক্ষার্থীদের অন্য যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো সমাধান করতে আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম চলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়ম এবং ডাকসু নির্বাচনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে আরও বেগবান করার জন্য আমরা দায়িত্ব নিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব অঙ্গসংগঠন বা কথা বলার জায়গা রয়েছে, সেসব জায়গায় অনিয়ম নিয়ে কথা বলতেই আমরা দায়িত্ব নিচ্ছি। এসময় দেশের সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দাবি করেন নুরুল হক।
বলেন, দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে মেধাভিত্তিক সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির পরিবর্তে অর্থ ও পেশিশক্তি নির্ভর অপরাজনীতির বিকাশ ঘটেছে। হলগুলো প্রশাসন যেন ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের কাছে ইজারা দিয়েছে। যে মেধা অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে, সেই মেধা ও অর্থনৈতিক অবস্থা দেখেই হলে তাদের আসন নিশ্চিত করতে হবে। কোনো শিক্ষার্থীকে জোর করে মিছিল-মিটিং করানো যাবে না এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে হলে সিট দেওয়া যাবে না। এসময় তার সঙ্গে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন, ডাকসুর জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা রাশেদ খান, এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ফারুক হোসেনও উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ব্যানারে কোটা সংস্কারের আন্দোলন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একাধিকবার ছাত্রলীগের হাতে মারধরের শিকার হন নুরসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। মূলত তখন থেকেই নুর সবার নজর পড়ে। কোটা আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে নুরুল হক নুরসহ আন্দোলনকারীদের প্রশংসা করা হয়। ক্যাম্পাসেও জনপ্রিয়তা পায় কোটা আন্দোলনকারীরা। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে প্যানেল দেয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। কাজেও লেগে যায়। নির্বাচনে নানা অনিয়মের মধ্যেও ভিপি হিসেবে নুরুল হক নুর জয়লাভ করে এবং নায়ক বনে যায়।
যদিও ডাকসু নির্বাচনের পর নির্বাচন বাতিলের দাবিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু হয়। তখন নুরু ভিপি পদ ও সমাজসেবা সম্পাদকের পদ ব্যতীত সব পদে নির্বাচনের দাবি করলে তার প্রতি মানুষের প্রত্যাশার জায়গায় কিছুটা ভাটা পড়তে শুরু করে। এরপর নির্বাচন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে একেক সময় একেক কথা বলা, দায়িত্ব নেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া, প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে তার সঙ্গে দেখা করে নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহারের বিষয়ে দাবি না তোলায় তাকে নিয়ে এক ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরপর থেকেই তাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। অনেককে বলতে শোনা যায়, যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ।
কেননা, প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গণভবনে গিয়ে নুরুল হক নুর যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে অনেকেই হতাশ হয়েছেন। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে একই সঙ্গে আন্দোলনে থাকা প্রগতিশীল ছাত্রজোট প্যানেলের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী বলেছেন, নুরের বক্তব্যে আমরা হতাশ। নুর না থাকলেও তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। লিটন নন্দী বলেন, নুরুল হক নুর প্রথমে আমাদের সঙ্গে পুনর্নির্বাচন চেয়েছেন। কিন্তু গণভবনে তিনি বলেছেন, এবারের নির্বাচনে কিছু ভুলত্রুটি ছিল। আগামী নির্বাচনে যাতে এ ধরনের ভুলত্রুটি না হয় সেজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। যেখানে আমরা পুরো নির্বাচনকে বর্জন করছি সেখানে তিনি এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।
নুরুল হক নুরকে প্রশ্ন করে রাজনীতি বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আপনি (নুরুল হক নুর) নির্ভীক তারুণ্যে বুড়িয়ে যাওয়া একজন সুলতান মনসুর। প্রধানমন্ত্রী ডাকলে আপনি অবশ্যই যেতে পারেন, উনাকে আপনার মাতৃসমও মনে হতে পারে। কিন্তু আপনাকে বলতে হবে কেন আপনি উনার কাছে আপনার ও আপনার সঙ্গীদের ওপর চালানো বহু নির্মম নির্যাতনের বিচার চাইতে ভুলে গেলেন?
আপনার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী রাশেদকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল, কেন ভুলে গেলেন প্রধানমন্ত্রীকে এটি বলতে? কেন ব্যর্থ হলেন ডাকসু নির্বাচনে কারচুপির বিষয়টি ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে? আপনাকে খুব দ্রুত এসব বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। অতীতে সব অত্যাচারের মুখে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আপনার দৃঢ় ভূমিকা দেখে আপনার মধ্যে তরুণ বয়সী বঙ্গবন্ধুর ছায়া দেখেছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মেরুদণ্ড কোনো শাসকের সামনে বিন্দুমাত্র নুয়ে পড়ত না। আপনার মেরুদণ্ড নুয়ে পড়লে আপনাকে তাই আর তরুণ বঙ্গবন্ধুর ছায়া মনে হবে না। বরং মনে হবে আপনি নির্ভীক তারুণ্যে বুড়িয়ে যাওয়া একজন সুলতান মনসুর।
সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা লিখেছেন- আপনি অন্য যা কিছু বলেছেন-করেছেন, তা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই, আপত্তিও নেই। ভালো মনে করেছেন, বলেছেন। বলতেই পারেন। কিন্তু কিছু বা মূল বিষয় বাদ দিয়ে কথা বললেন। কয়েকটি কথা সেটা নিয়ে। নির্বাচনের দিন ছাত্রীরা যদি হলে হলে প্রতিরোধ না করতেন, সব সংগঠন যদি সম্মিলিত প্রতিবাদ না করত, কোথায় থাকতেন আপনি? রোকেয়া হলের ছাত্রীরা অনশন করছেন, প্রতিবাদ করছেন, আপনার বক্তৃতায় তাদের কথা বললেন না?
শামসুন নাহার হলের ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি প্রধানমন্ত্রীর সামনে বলতে পারলেন, ‘আমার রোকেয়া হলের বোনদের সংকটের মধ্যে বিবেকের তাড়না থেকে একজন ছাত্রী হলের প্রতিনিধি হিসেবে বলতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে আর কেউ যেন কোনো মেয়েকে বোরখা পরলে শিবির কিংবা জিন্স পরলে গাঁজাখোর না বলে।
এ কথা শুনেও আপনার তাদের কথা মনে পড়ল না? সেদিন মাঝরাতে ছাত্রীদের এই হেনস্তা করার ঘটনা আপনি জানতেন না? রাজু ভাস্কর্যের সামনে যারা অনশন করলেন, তাদের কথা মনে থাকল না? রাশেদকে গুলি করে হত্যার হুমকি কারা দিল, আপনি জানেন না? রাশেদের মায়ের কথা মনে পড়ল না? নির্বাচন যদি মোটামুটি সুষ্ঠু হতো, রাতে যদি ভোট না হতো, আপনাদের সংগঠনের অনেকের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বিজয়ী হতে পারত রাশেদও। বক্তৃতায় নির্বাচনের এই ভয়াবহ অনিয়মের বিষয়ে কী বললেন? বিজয়ী একা হলেও, সবাই মিলেই তো আপনি ছিলেন, নাকি?
‘একা’ সবার চেয়ে কেউ বড় হতে পারে না। আপনি ‘একা’ হয়ে যাচ্ছেন। এক বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। এতদিন যারা পিটিয়েছে, প্রয়োজন ফুরালে আবারও পেটাবে। এতদিন সঙ্গে সবাইকে পেয়েছেন, তখন কাউকে পাবেন না। বহু নজির আছে। গণজাগরণ মঞ্চের কথা সবারই তো মনে থাকার কথা।