দিলীপ কুমার থেকে এ আর রহমান হয়ে উঠার যাত্রা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
গতকাল ৫১ এ পা দিলেন সুর সম্রাট এ আর রহমান। ‘মাদ্রাজের মোৎজার্ট’ খেতাব পাওয়া এই সুর-জাদুকর ১৯৬৭ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন। ৫০ বছর বয়সেই পৌঁছে গেছেন খ্যাতি আর প্রাপ্তির স্বর্ণ শিখরে। শান্ত স্বল্পভাষী এই ব্যাক্তিকে ২০০৯ সালে ‘টাইম্স ম্যাগাজিন’ বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১১ সালে লন্ডনের ওয়ার্ল্ড মিউজিক ম্যাগাজিন তাকে ‘ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মিউজিক আইকন’ দের মধ্যে একজন বলে অভিহিত করে। জন্ম থেকেই এমন প্রাপ্তি নিয়ে তিনি ইতিহাসের অংশ হননি তিনি। শুরুটা হয়ে ছিল সিনেমার মতই।
৬ জানুয়ারি ১৯৬৭-তে মাদ্রাজে সঙ্গীতজ্ঞ আর কে শেখরের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম যখন হয় তিনি তখন তার নাম রাখেন এ এস দিলীপ কুমার। আর কে শেখর তখন মালয়ালম মুভিতে সুরকার রূপে কাজ করছিলেন। তার ছোট ছেলে দিলীপকে সাথে নিয়ে মুভি স্টুডিওতে যেতেন।
দিলীপের বয়স যখন মাত্র চার তখন তাকে দক্ষভাবে হারমোনিয়াম বাজাতে দেখে অবাক হয়ে যান সঙ্গীত পরিচালক সুদর্শনম মাস্টার। তিনি কাপড় দিয়ে সেই হারমোনিয়ামের রিড (কিবোর্ড) ঢেকে দিলেও দিলীপ একইভাবে বাজিয়ে যান। সুদর্শনম মাস্টারের উপদেশে শেখ চার বছর বয়স থেকেই দিলীপকে মিউজিকে ট্রেইনিং দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
ধনরাজ মাস্টার হন তার টিচার। দিলীপ শেখা শুরু করেন পিয়ানো বাজানো। আর তখনই জন্ম হতে থাকে এক সুরের জাদুকরের।
দিলীপের ছেলেবেলা ছিল খুব অভাব ও কষ্টের। একটি রহস্যময় রোগে মাত্র নয় বছর বয়সে তার পিতা মারা যান। ওই সময় সৃষ্টিকর্তার প্রতি দিলীপের ধারণা বদলাতে থাকে। পিতার চিকিৎসার জন্য টাকার অভাব, তার যন্ত্রণা, পরিচিত মানুষের তীব্র উদাসীনতা এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের উপেক্ষা দিলীপকে খুব কষ্ট দেয়। আরো কষ্ট দেয়, বিশেষত তার পিতার মৃত্যুর দিনটি। ওই দিনেই তার পিতার সুর আরোপিত প্রথম মুভিটি রিলিজড হলেও তা তিনি দেখে যেতে পারেননি। এগুলো এতই বেদনাদায়ক ছিল যে আজো এ আর রহমান এ নিয়ে কিছু বলতে চান না।
পিতা শেখর পেছনে রেখে যান তার স্ত্রী কস্তুরী (এখন করিমা বেগম) এবং তিন কন্যা ও এক পুত্র। কাঞ্চনা (দিলীপের বড়) এবং বালা (এখন তালাত) ও ইশরাত। এই তিন বোন ও মায়ের সংসার চালানোর সব দায়িত্ব এসে পড়ে বালক দিলীপের ওপর। ১১ বছর বয়সে তিনি ইলিয়ারাজা সঙ্গীত দলে যোগ দেন কিবোর্ড প্লেয়ার রূপে। ইতোমধ্যে তিনি গিটার বাজানো শেখেন। এভাবে এ আর রহমান চূড়ান্তভাবে মিউজিক ওয়ার্ল্ডে ঢোকেন। তাকে সব রকম অনুপ্রেরণা ও সাহায্য দেন তার মা যিনি চেয়েছিলেন প্রয়াত স্বামীর পদাঙ্ক যেন ছেলে অনুসরণ করে।
গানের ভুবনে ঢোকার ফলে দিলীপের আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। যদিও তিনি খুব নামকরা দু’টি শিক্ষায়তনে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এদিকে তার প্রতিভায় অনেকে আকৃষ্ট হন এবং তাকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিকে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেন। এখানেই ওয়েস্টার্ন ক্যাসিক্যাল মিউজিকে একটি ডিগ্রি আয়ত্ত করার পর তিনি ইন্ডিয়ায় ফিরে আসেন। তখন তার স্বপ্ন পশ্চিমের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সাথে আধুনিক ইন্ডিয়ান সুরের সম্মিলন ঘটানো।
দিলীপ তখন অ্যাডভার্টাইজিং ফার্মে যোগ দেন এবং জিঙ্গল (বিজ্ঞাপনী স্লোগান) লেখা এবং এতে সুর দেয়ায় মনোনিবেশ করেন। প্রায় পাঁচ বছর তিনি বিজ্ঞাপনী ব্যবসায়ে কাজ করেন। ওই সময় তিনি ইসলামি আধ্যাত্মিক গানের দিকে ঝোঁকা শুরু করেন। তার প্রথম পূর্ণাঙ্গ যে মিউজিক অ্যালবামটি তিনি প্রকাশ করেন এর নাম ছিল দিন ইসাই মালাই (Deen Isai Malai)। ইসলামি আধ্যাত্মিক গানের এই সঙ্কলনটি ছিল তামিল ভাষায়।
ঠিক এরপরই তার জীবনে দ্বিতীয় বারের মত নেমে আসে ঘোর অমানিশা। ১৯৮৮ সালে অর্থাৎ দিলীপের বয়স যখন একুশ তখন তার বোনের গুরুতর অসুখ হয়। কোনো চিকিৎসাতেই কাজ হচ্ছিল না। সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন তখন পরিবারের এক বন্ধুর উপদেশে তারা যান শেখ আবদুল কাদের জিলানি নামে মুসলিম পীরের কাছে।
তার দোয়ায় অতি আশ্চর্যজনকভাবে দিলীপের বোন দ্রুত সেরে ওঠেন। পিতা ও বোনের অসুখের সময় সমাজের অবহেলা এবং তার বিপরীতে পীরের সদুপদেশ ও সাহায্য গভীরভাবে প্রভাবিত করে তরুণ দিলীপকে ধর্মান্তরিত হতে। তিনি ও তার পুরো পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। দিলীপ হয়ে যান এ আর রহমান।
মুসলমান হওয়ার পর তার নাম রাখা হয় আবদুল রহমান। কিন্তু পরে ইন্ডিয়ার তদানীন্তন শীর্ষ সুরকার নওশাদ আলী যিনি পশ্চিমি সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন তার সংস্পর্শে যখন এ আর রহমান আসেন তখন তিনি উপদেশ দেন আবদুলটা বদলে ফেলে বিখ্যাত তবলা বাদক আল্লাহ রাখার (Allah Rakha) নামে এ আর রাখতে।
এরপরই তার সাফল্যের প্রথম উড্ডয়নের সময় আসল। ১৯৯২ সাল। তামিল পরিচালক মণি রত্নম ২৫ বছর বয়সী এ আর রহমানকে সুযোগ দিলেন তার ‘রোজা’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার। তামিল ভাষায় তৈরি ছবিটি হিন্দিতে ডাব করা হয়েছিল। দুই ভাষাতেই রোজার সব ক’টি গান তুমুল হিট হয়। তার সাথেই প্রচারের আলো গিয়ে পড়ে এই ছবির সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহামানের উপর। তার দেয়া সুর কখনো ফ্লপ করেনি। জীবনের প্রথম ছবির জন্যই পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার আজ পর্যন্ত এই রেকর্ড অন্য কোনো সঙ্গীত পরিচালকের নেই।
জীবন্ত কিংবদন্তী এই সঙ্গীত পরিচালক স্লামডগ মিলিওনিয়ারের জন্য একসঙ্গে দুটি অস্কার পেয়েছেন। ২০১১ তে ড্যানি বয়েলের ওয়ান টোয়েন্টি সেভেন আওয়ার্সের জন্য অস্কারের নমিনেশন তালিকায় ছিল তার নাম। এছাড়াও একটি ‘বাফটা পুরস্কার’, একটি গোল্ডেন গ্লোব, চারটি ন্যাশনাল ফিল্ম এওয়ার্ড এবং ১৩ টি ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ড তার ঘরে শোভা পাচ্ছে।