মনীষা নস্কর এর লেখা – দিয়ে এলাম প্রথম ভোট
দিয়ে এলাম প্রথম ভোট
——————— মনীষা নস্কর
কাল জলদি জলদি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকাল সাতটা থেকে ভোট শুরু ! ঘুম কি ছাই আসে ??
‘ভোট দিতে যাবো’ ‘ভোট দিতে যাবো’ — মনটা খালি লাফাচ্ছিল উচ্চিংড়ের মতো। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। ঘুম তো ভাঙলো ঠিক পাঁচটায়, মোরগের কঁক্কর কোঁ -তে। (ইয়ে , মানে , ওটাই আমার অ্যালার্ম টোন। হেঁ হেঁ )
বাড়িসুদ্ধু লোককে ঠেলে তুললাম। ‘ওঠো। ভোট দেবো। দেরী হয়ে যাচ্ছে। ’ বিস্তর চেঁচামেচির পর আমার পিতৃদেব গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। ব্যাটা দুধওয়ালা আজও দেরী করছে। অতএব, জননী রয়ে গেলেন তার অপেক্ষায়। আমি আর পিতৃদেব চললুম ভোটদান করতে। জননী পূর্ব অভিজ্ঞতাবলে দুটি ছাতা গছিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির মোটামুটি কাছেই আছে একটা অত্যন্ত ওঁচা স্কুল। সেখানেই প্রত্যেক বছর ভোট পর্বটি চলে।
সকাল সাতটাতেই কত্তো লোক ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। অজগর সাপের মতো এদিক ওদিক দিয়ে লাইন। ঢুকলাম স্কুলটার মধ্যে।
ইরিবাবা! এটা স্কুল ?
চতুর্দিকে পানের পিক, কুত্তার প্রাতঃকালীন (বেশ বড়ো বড়ো সাইজের) প্রসাদ ! ক্লাসরুমগুলো তো ছোটো ছোটো গুহার মতো। না ঢোকে আলো, না ঢোকে হাওয়া। দেওয়ালে দেওয়ালে হিজিবিজি টুকলি। বেশ বড়ো একটা মাঠ আছে। অনেকগুলো লাইন এখানে, যেন একটা বড় অজগরকে সাত আটটা টুকরোতে কেটে ধরাশায়ী করা হয়েছে। তবে ছেলেদের লাইন আর মেয়েদের লাইন আলাদা ! যাক বাবা , লোকগুলোর বগলের গন্ধ শুঁকতে হবে না।
গুটগুট করে গিয়ে দাঁড়ালাম লাইনের শেষে। আমাদের পাড়ায় এত্তো লোক কোথায় ছিল রে বাবা ! সবাই দেখি আমায় চেনে। কয়েকজন কাকিমা গোছের মহিলা হেসে হেসে শুধোলেন, ‘হেঁ হেঁ , ভোট দিতে এলে বুঝি?’
— ( না রে মুটকি , তোর মুখ দেখতে এসেছি ) অবশ্য আমিও হেঁ হেঁ করে মাথা নাড়ি।
— ‘ কত্তো বড়ো হয়ে গেলে ! ভোট দিতে শুরু করে দিলে ’
— ( হ্যাঁ ঢেপসি , তুই ও বুড়ি হয়েছিস !) প্রকাশ্যে এরও উত্তর হিসেবে বিতরণ করি লাজুক হাসি। ইয়ে , এটাই তো ‘সভ্যতা’ !
এদিক ওদিক চোখ চালাচ্ছি। উফ্ , কোন পাড়ায় বাস করি রে ভাই ! তাকানোর মতো এক পিস্ ও ছোকরা নেই।
অগত্যা কানদুটোকে কাজে লাগালাম। পাড়ার গিন্নিবান্নিদের মশালাদার গসিপ , কাকুদের অফিসের চালগুলোই আপাতত আমার ওয়ান অ্যাণ্ড ওনলি এনটারটেইনমেন্ট।
মহিলা লাইন থেকে উড়ে আসছে —
—‘হলুদ বাড়ির মেয়েটাকে দেখেছো ? ওর আর বিয়ে হবে বলে মনে হয়না। দিন দিন যা ধুমসি হচ্ছে। ’
—‘আরে দত্তদার মেয়ের চালচলন বাপু আমার মোটেই সুবিধের ঠেকে না। করিস তো বাপু কল সেন্টারে চাকরি। তার আবার কতো ফাঁট। কায়দা করে আবার বলা হয় ‘বিপিও তে জব করি’। রোজ রাতে তো এক একটা ছেলে এসে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে যায় !’
(এখানে বলে রাখি, উক্ত দিদিটি আমার বেশ পরিচিত। রাতে অফিসের গাড়ি করে বাড়ি ফেরে। গাড়ির কলিগদেরই হয়তো মহিলাটি ‘এক একটা ছেলে’-র আখ্যা দিলেন।)
— ‘আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের ঘোষালবাবুর মেজো ছেলে এবারও জয়েন্টে চান্স পায়নি। ওদিকে আমার ছেলে তরতর করে থার্ড ইয়ারে উঠে গেল। সহ্য হয়না গো সেটা ওদের। সহ্য হয়না। আমার বাবুসোনার পড়ার সময় নিয়ম করে ওদের রেডিও চালানো চাই-ই চাই। হিংসে গো হিংসে। ’
—‘হ্যাঁ গো, আজ তো ছুটির বাজার। কত্তা-গিন্নি কি ফেরার পথে বাজার সেরে নেবে?’
—‘বাজারের কথা তুলো না ভাই। ঢ্যাঁড়স চল্লিশ টাকা কিলো, ফুলকপি তো আগুন। এমনকি ডিমটারও দাম বাড়িয়ে দিল। কালই তো ……’
( বাকিটা শুনতে পাইনি। আমার পেছনে দাঁড়ানো মহিলাটি আমার পিঠে খোঁচা মেরে মেরে ডাকছিলেন।)
মহিলাটিকে চিনি। এনার বাড়ির পাশ দিয়ে যখনই যাই, হেব্বি হেব্বি রান্নার গন্ধ পাই। মহিলা মাটন কষা আর চিংড়ির মালাইকারি দারুণ বানান। চেখে দেখার সৌভাগ্য অবশ্য হয়নি। আর যে ভবিষ্যতেও হবে না, তাতে একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গেলাম।
হয়েছে কী , মহিলার ছাতার শিকগুলো আমায় বড্ড খোঁচাচ্ছিল। কখনো চুলে ঢুকে পরিপাটি করে বেঁধে আসা চুল খোলার তাল করছিলো, কখনো আমার পাতলা জামাটা ছিঁড়ে দেবার ফন্দি আঁটছে। এদিকে সামনের জনের দিকেও বেশি এগোতে ভয় লাগছে। সামনের জনের মাথায় বিচ্ছিরি বোঁটকা গন্ধ, গুচ্ছ গুচ্ছ উকুনের ডিম আটকে রয়েছে চুলে। বাধ্য হয়ে খুললাম আমার নিজের বেগুনী ছাতা। শুরু হল ছাতা-যুদ্ধ। আমি শক্ত করে ধরে আছি আমার ছাতা। মহিলা কিছুতেই নিজের ছাতা সোজা করতে পারছেন না। আমায় খোঁচা মেরে ডেকে বললেন , ‘অ্যাই মেয়ে, ছাতা বন্ধ করো, দেখছো না আমি দাঁড়াতে পারছি না। ’
আমি মিষ্টি করে হেসে বললুম , ‘এইতো দিব্বি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ছাতা বন্ধ করলে যে আপনার ছাতার খোঁচা খেতে হবে আমায়। ’
— ‘সামনে আরেকটু এগোতে পারছো না ?’
—‘দেখছেন তো আন্টি সামনের জনের মাথার অবস্থা। এরপরও যদি এগোতে বলেন, তাহলে বরং আপনি আমার জায়গায় আসুন, আমি আপনার জায়গায় যাচ্ছি। ’
মহিলা ঠোঁটদুটো যথাসম্ভব বেঁকিয়ে ‘হুঁহ্’ বলে গোমড়া মুখটাকে আরো গোমড়া করে রইলেন দাঁড়িয়ে। একটু বাদে কাকে জানি ফোন করে হুকুম দিলেন, ‘কখন আসবি ? জলদি আয়। আর শোন , আসার সময় ছাতা আনবি মনে করে। ’ বলা বাহুল্য , শেষ নির্দেশটি চাপা গলার হলেও আমার কান এড়ায়নি। রেডি হলাম নেক্সট আক্রমণের জন্য।
মিনিটদশেকের মধ্যে মহিলার মেয়ে হাজির। সদ্য সদ্য বিয়ে হয়েছে। ওটা সিঁদুর পরার স্টাইলেই বোঝা যায়। মেয়ে এনেছে দাদুর আমলের এক বিশাল কালো ছাতা।
এবার মা-বেটি দুজনের ছাতার খোঁচা এসে পড়ল আমার নিরীহ বেগুনি ছাতার ওপর। আমিও গায়ের জোরে ধরে রেখেছি আমার ছাতা। আর দু’মিনিট টিকতে পারলেই বেঁচে যাবো। সামনেই একটা শামিয়ানা টাইপ লাগানো আছে। চলে এলাম শামিয়ানার তলায়। এখানে অনেকগুলো লাইন এসে জড়ো হয়েছে বলে একটু বেশি ভিড়। বন্ধ করে দিলাম আমার ছাতা। মাথার ওপর শামিয়ানা ভরসা।
ওদিকে মা-বেটি যুদ্ধজয়ের চিহ্নস্বরূপ নিজেদের ছাতাদুটো খুলেই রেখেছে। চারপাশের লোকজন বেশ বিরক্ত হচ্ছে বুঝতেই পারছি। তক্কে তক্কে ছিলাম। একজন মিলিটারীর লোক বন্দুক হাতে আমার দিকে তাকাতেই হালকা ‘উফ্’ বলে মাথায় হাত বুলোতে লাগলাম। মিলিটারবাবু এলেন এগিয়ে। পেছনের মা-বেটিকে রামধমক !
‘এখানে রোদ নেই, বোকার মত ছাতা খুলেছেন কেন ? বন্ধ করুন। দেখতে পাচ্ছেন না , আপনাদের জন্য অন্যদের অসুবিধা হচ্ছে—’
মা-বেটি সুড়সুড় করে বন্ধ করলেন ছাতাদুটি।
এবার আমি ঢুকলাম বুথে। তার আগে একটা লোক কার্ড দেখলো, স্লিপ নিল। টিপছাপ দিলাম এক জায়গায়। আঙুলে কালি নিতে এগিয়ে গেলাম। বলে দিলাম, ‘দাদা , একটু সুন্দর করে লাগাবেন। ’ তারপর সেই অতি আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি। আমার সামনে অনেকগুলো বাটন। সবকটা আমার দিকে চেয়ে আছে — এখন আমিই শের। চিপে দিলাম একটা বাটন। কোনটা ?? হুঁ হুঁ , বলব কেন ?? :3 পিঁইইই করে একটা আওয়াজ হল আর সাথে একটা লাল আলো জ্বললো। হাসি হাসি মুখ করে বেরিয়ে এলাম। যাক্। অ্যাদ্দিনে দেশের একটা ‘ কাজ ’ করা হল ।
সেলফি তুলেছি খানকতক। তবে পোস্টাবো না। থাক ওগুলো আমার একার স্মৃতি হয়ে !!