নগর উন্নয়নে নাগরিক দায়িত্ব
নগর উন্নয়নে নাগরিক দায়িত্ব
অলোক আচার্য
শিক্ষক ও কলামিষ্ট
রাজধানীর দুই সিটির নির্বাচন শেষ হয়েছে। নতুন মেয়র পেয়েছে রাজধানীবাসী। নানা সমস্যার আবর্তে থাকা রাজধানীকে সমস্যা থেকে বের করে আনা তাদের সর্বপ্রথম প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে। ভোটাররা তাদের সমস্যা সমাধানের আশা করেই ভোট দিয়ে মেয়র নির্বাচিত করেছে। কিন্তু সমস্যা থেকে তারা মুক্ত হতে পারছে না। বরং আরো বেশি সমস্যার ভেতর প্রবেশ করছে। কারণ রাজধানী ঢাকা এখন বহুমুখী সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে বারবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনটারই সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যাগুলো এখন মারাত্বক আকার ধারণ করেছে। এগুলোর তালিকা তৈরি করলে অনেক লম্বা হবে। যে প্রার্থী নির্বাচিত হবেন তারা নিশ্চিত করবেন কোন সমস্যাটির সমাধান আগে করা প্রয়োজন। এসব সমস্যা কার্যত এই শহরটাকে অকার্যকর করে ফেলছে। এই যান্ত্রিক শহরে প্রাণ ফেরানোটাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সব দায়িত্ব কতৃপক্ষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হয়ে বসে থাকা যায় না। নগর উন্নয়নে নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। নিজেকে একজন সুনাগরিক হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইলে সুনাগরিকের গুণাবীল মেনে চলাও আবশ্যক। কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সবার সহযোগীতা প্রয়োজন। সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সব দেশের আইন মেনে চলতে হবে। নিজেদের পরিবর্তন না করলে শহর পরিবর্তন হয় কিভাবে? পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রতিদিনের অভ্যাস পরিবর্তনই যথেষ্ট।
আমরা যেমন নিজেদের বাড়িঘর পরিষ্কার রাখি,নিজেদের পোশাক পরিষ্কার রাখি ঠিক একই রকমভাবে নিজেদের শহর এমনকি দেশটাকেও পরিস্কার রাখতে হবে। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলার অভ্যাস, আইন না মেনে রাস্তা পারাপার এরকম ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ শহরকে এমনকি দেশকে পাল্টে দিতে পারে। নিজে না বদলে অন্যকে বদলানোর চেষ্টা করা বৃথা। যখন একটি দেশের প্রতিটি নাগরিক একজন সুনাগরিকের দায়িত্ব মেনে চলে সেখানে সমস্যার সমাধান করা যায় দ্রুততার সাথে। কারণ কোনো সমস্যাই নিজে নিজে আমাদের ওপর চেপে বসে না। আমরাই কেউ না কেউ দিনের পর দিন নিয়মশৃঙ্খলা না মেনে চলার কারণে আজ এই পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে। যদি প্রথমেই বায়ু দূষণের কথা বলি তাহলে আমরা এই দায় এড়াতে পারি না। ঢাকার মানুষের জন্য বড় ঝুঁকি হলো দূষিত বায়ু। বায়ু দূষণে ঢাকার অবস্থা সংকটজনক। ঢাকাকে সবুজ করতে হবে। সেই সবুজায়ন কিভাবে করা সম্ভব তার পরিকল্পণা করতে হবে। এই কাজটিও আমাদেরই করতে হবে। কারণ গাছ কেটে সবুজ দেশটাকে আমরাই গাছশূণ্য করে ফেলেছি। আজ যখন এই দূষণ ঠেকাতে সবুজায়ন অত্যন্ত প্রয়োজন তখন আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগীতার সাথে সাথে প্রতিটি বাড়িতে সবুজায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি রাস্তায় পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। সেই বৃক্ষের যতœও করতে হবে। যদি প্রতিটি বাড়িকে আমরা সবুজে পূর্ণ করতে পারি এবং রাস্তায় বায়ু দূষণ কমাতে পারি তাহলে দ্রুতই ঢাকাকে বিশুদ্ধ বাতাসের নগরী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। কারণ ঢাকার বাতাসে মাত্রারিক্ত ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে যা নিঃশ^াসের সাথে দেহের অভ্যন্তরে পৌছে নানা রোগের জন্ম দিচ্ছে। অথচ প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়েই বিষাক্ত বাতাস টানতে হচ্ছে এ শহরের মানুষকে। তাই শহরকে দূষণমুক্ত করতে হলে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাতাসের পর নিরাপদ পানির কথা বলতে হয়। পানি মানুষের নিত্যদিনকার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান। অথচ সেই পানির অবস্থাও সুবিধার নয়। ঢাকাবাসীকে পানযোগ্য পানির নিশ্চয়তা দিতে হবে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির চাহিদা তীব্র হয়। ঢাকার আশেপাশের নদীগুলোকে আমরা প্রায় মেরে ফেলেছি। খাল ধ্বংস করেছি। বাড়িঘর,ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে এনেছি। সেগুলো রোধ করতে হবে এবং উদ্ধার করতে হবে। অনেক কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। পানির অপচয় রোধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে নাগরিক দায়িত্ব রয়েছে। নিজেদের কর্তব্যটুকু নিজেদের পালন করতে হবে। শহরে বাইরে বের হয়েই প্রথম যে সমস্যায় পরতে হয় তা হলো যানজট। ঢাকার মানুষ দৈনিক রাস্তায় চলতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করছে রাস্তায় গাড়িতে। প্রতিদিন যানজটে পরে ঢাকার মানুষের লাখ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। এত কর্মঘন্টা নষ্ট হওয়ায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যানজট কেবল ঢাকার সমস্যা নয় বরং এশিয়ার কয়েকটি দেশ সহ অনেক বিশে^ই যানজট মারাত্বক সমস্যা হয়ে বসে আছে। বিশেষ করে যেসব শহরের জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে এবং শহরটি ঢাকার মতো অপরিকল্পিত। যার যেভাবে খুশি বড়বড় বিল্ডিং তৈরি করে রেখেছে। রাস্তার ভেতর গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। তবে ঢাকার মতো এত প্রকট আকার ধারণ করা শহরের সংখ্যা এত নেই। কিছু কিছু এলাকায় তো গাড়ির গতির চেয়ে মানুষের হাঁটার গতিই বেশি।! তাহলে একসময় কি ঢাকা স্থবির হয়ে যাবে? যানজট নিরসনে বহুবার বহু উদ্যোগ নেয়া হলেও কার্যত তা ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদিন ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ব্যক্তিগত গাড়ির চাপে ঢাকার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। দেখা যায় এক পরিবারে একটি গাড়ি হলেই চলছে, সেখানে একাধিক গাড়ি কিনে রাস্তায় নামাচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তি মালিকানাধীন গণপরিবহন, প্রাইভেট কার,মাইক্রো বাস মটরসাইকেল এসব যানবাহন প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা যেন থমকে আছে। এখানে কতৃপক্ষের সাথে সাথে নাগরিকের দায়িত্ব হলো ট্রাফিক আইন মেনে চলা। যারা গাড়ি চালাচ্ছে বা যারা রাস্তা পার হচ্ছে সবাইকে নিয়মের মধ্যে থেকে করতে হবে। নিয়মের ব্যতয় ঘটলেই দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। সেই বিশৃঙ্খলা শৃঙ্খলায় ফিরতে অনেক সময় লেগে যায়। যদি আমরা নিজেরাই নিজেদের পরিবর্তন করে নিয়ম মেনে চলার অভ্যাস করি তাহলে নগর উন্নয়নের পাশাপাশি একজন সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে নিয়ে গর্বও করতে পারি। উন্নত দেশে প্রতিটি নাগরিক সচেতন নিজের শহর নিয়ে,দেশ নিয়ে। একটি বাদামের খোসা যেখানে সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে। আমরা কেন পারবো না। পরিচ্ছন্ন শহর হলে তো আমরাই লাভবান হবো। পরবর্তী প্রজন্মকে একটি পরিচ্ছন্ন বাসযোগ্য শহর উপহার দিতে পারবো।
জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি তারা এখন দিচ্ছেন সেগুলো যেনো নেহায়েত মুখের কথা না হয় তা প্রমাণ করতে হবে। এতসব সমস্যা নিয়ে রাজধানীকে তিলোত্তমা নগরীর রুপে ফিরিয়ে দিতে হবে। কাজটি কঠিন। কিন্তু সদিচ্ছা থাকলে সেই কঠিন কাজের অনেক অংশই পূরণ করা সম্ভব। জনগণকে সাথে নিয়ে নব নির্বাচিত নগরপিতাদ্বয় ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলবেন। আর একটি সমস্যা হলো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ। গত বছর ডেঙ্গুর যে প্রকোপ আমরা দেখেছি, যে প্রাণগুলো আমরা ঝরে যেতে দেখেছি এমন অসময়ের মৃত্যু আমরা দেখতে চাই না। মশা নিধনে সফলতা দেখাতে হবে। এ কাজটি কতৃপক্ষকেই করতে হবে। আগামীতে ঢাকাসহ সারাদেশবাসীই এই সফলতা দেখতে চায়। সরকারের বরাদ্দের প্রতিটি অংশ যেনো জনগণের কল্যাণে ব্যয় হয় তাই দেখতে চায়। মানুষই এখানে যন্ত্র। তাই প্রাণটাই ফেরাতে হবে। শিশুদের জন্য উন্মুক্ত স্থান দিতে হবে যাতে তারা খেলাধূলা করে বড় হতে পারে। মোট কথা রাজধানীর অস্তিত্ত্ব রক্ষার জন্য এবং মানুষের বসবাসের উপযুক্ত করে তোলার জন্য সঠিক পরিকল্পণা এবং তার বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। বহু চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হবে। সেই কাজটি কতৃপক্ষের সাথে সাথে জনগণকেও নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে।