নারী-পুরুষের সম-অধিকারঃ সংবিধানে ও বাস্তবে-২
সিডনীর কথামালা-৬৮
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
E-mail:raneshmaitra@gmail.com
এই বিষয়ে আমার প্রথম দফার লেখার এক জায়গায় উল্লেখ করেছি, সর্বত্র এই বৈষম্য বাংলাাদেশে বিরাজিত। কি সামাজিক, কি পারিবারিক, কি অর্থনৈতিক, কি ধর্মীয় সকল ক্ষেত্রেই এই বৈষম্য সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে দিব্যি সক্রিয় রয়েছে এবং এই বৈষম্যের পরিধি দিনে দিনে বিকশিত হচ্ছে তার বিস্তারলাভ ঘটছে রাষ্ট্রের নিস্পৃহতার জন্যে।
প্রথমেই আমরা দেখি পরিবার যেখানে ছেলে ও মেয়ে উভয় লিঙ্গই মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়ে থাকে। প্রতিদিনই কোন না কোন পরিবারে শিশুরা জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু যা আমরা করে থাকি তা হলো মেয়েটির চাইতে ছেলেটির গুরুত্ব বেশী দিয়ে তার শিক্ষ-দীক্ষা, পোষাক-আশাক, হাত-খরচা, কোচিং, খেলাধুলা প্রভৃতির দিকে অনেক বেশি নজর দিয়ে থাকি। কিন্তু মেয়েটির ব্যাপারে তার পরনের কাপড় আর ওড়নার দিকে নজরটা বেশী। লেখা পড়া মেয়েদের নয়, তারা তো ঘরে থাকবে-বাইরে যাবে না। ছেলেটির স্বাস্থ যাতে ভাল হয় বা ভাল থাকে তার জন্যে পুষ্টিকর খাবার তার জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দ দেওয়ার পুরাতন রেওয়াজও বহাল তবিয়েতে আছে। কিন্তু তা নেই মেয়েটির ক্ষেত্রে।
মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিই অভিভাবকের পছন্দের উপর। মেয়ে তা না মানতে চাইলে ধিক্কার জোটে তার কপালে। কিন্তু ছেলের ক্ষেত্রে? ছেলে যদি কোন মেয়েকে পছন্দ করে তবে সেটাকে প্রাধান্য দিতে অভিভাবকদের কুণ্ঠা নেই।
আবার মেয়ের বিয়েরে পর জামাইটির জন্য বিশেষ রান্না বান্নার আয়োজন রুই মাছের মুড়োটা, ইলিশের বড় পেটিটা, মুরগীর রানটা তো জামাই এর পাতে দেওয়ার জন্যেই নির্দিষ্ট থাকে। কিন্তু পরের ঘরে চলে যাওয়া মেয়েটাও তো জামাইএর সাথেই এসেছে। তার পাতে? কেউ কেউ আমরা মেয়েটিকে জামাই-এর পাতের না খাওয়া অংশটুকু দিয়েই যেন মেয়েকে জামাইতুষ্টির কর্তব্যবোধে জাগ্রত করার চেষ্ট করি মনে করি এই চেষ্টা করাটা হলো এক মহান‘ দায়িত্ব’ পালনের মত।
স্বশুর বাড়ী যাবার পর যখন মেয়েটি সন্তান-সম্ভবা হয়-দ্রুতই ডাক্তারী পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। সে আয়োজন যতটা মেয়ের স্বাস্থ পরীক্ষার জন্য তার চাইতে বহুগুনে বেশী তার গর্ভের সন্তান মেয়ে না ছেলে তা জানবার জন্য। যদি ঘটনাক্রমে মেয়ে সন্তান পেটে এসে থাকে – বৌ এর কদর কমে যায়। অনেকেই চান ঐ গর্ভজাত মেয়েটিকে যেন আলোর মুখ না দেখে – তাকে পেটেই নষ্ট করে দিতে।
এ জাতীয় নানাবিধ লিঙ্গ-বৈষম্য আজও আমরা অনেকেই আমাদের পারিবারিক জীবনে লালন করি। যার ফলে মেয়েরা মানসিকভাবেই পুরুষকে তাদের চেয়ে বেশী মর্য্যাদা সম্পন্ন বলে মনে করতে শেখে যা তাদের মনে এক ধরণের হীনমন্যতা-বোধেরও জন্ম দেয়। বিশেষ করে , যখন তারা দেখে যে তাদের মায়েরাও তাদের বাবাকে অধিক সম্মান দেখান – তখন তাদের মনে ছোট বেলা থেকেই ঐ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গড়ে ওঠে – যা তার আজীবন নিজেকে ছোট মনে করে ভাবতে শেখায়। এভাবেই পরিবার পর্য্যায়ে পুরুষতন্ত্র দানা বাঁধে যুগ যুগ ধরে নারীর এই আচরণে পুরুষও যার পর নাই খুশী।
পারিবারিক জীবন থেকেই গড়ে ওঠা এই বৈষম্য মেয়েটির যতই বয়স বাড়তে থাকে ততই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে এঁটে ধরতে থাকে। “টাইট নয়-ঢিলে পোষাক পার,” “পর পুরুষের সামনে যেও না”, সর্বদা ওড়না ব্যবহার করবে” “ঘনিষ্ঠ কোন পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাইরে যেও না,” “সন্ধ্যার আগেই বাড়ী ফিরবে”,“মেয়েদের হলো স্বামী-সন্তানদের সেবা-পরিচর্য্যা করা” যেমন বড় হতে থাকে-তেমনি আবার মনের গভীরে হীনমন্যতা বোধও বাড়তে থাকে।
সমাজ কি চোখে নারীদেরকে দেখতে চায় তাও আমাদের অজানা নয়। নারীর পারিবারিক অবস্থান যতটা তার জন্যে অমর্য্যাদাকর সমাজ দৃষ্টিতে নারী তদোধিক অসম্মান অমর্য্যাদা পেয়ে থাকে। একদিক যেমন সমাজ চায় মেয়েরা ঘরেই আবদ্ধ থাকুক-তেমনই আবার দেখা যায় বিত্তশালী পরিবারের মেয়েদের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্মী আচরণ। বিত্তশালী যদি কোন পরিবারের মেয়ে সমাজের চোখে “কুরুচিপূর্ণ” পোষাক পরে বাইরে আসে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা চাকুরীস্থলে যাতায়াত করে-বয়ফ্রেন্ড নিয়ে রাত বিরেতে রাস্তাঘাটে, পার্কে, নদী বা দিঘীর পাড়ে বসে খোলামেলা ঢলাঢলী করে – আমাদের ‘অন্ধ’ সমাজের চোখ যেন তা সইতে আপত্তি করে না। যতটা সামাজিক অসহিষ্ণুতা তার সবটাই দরিদ্র/আধাদরিদ্র পরিবারের মেয়েদের ব্যাপারে।
তাই বৈষম্যপূর্ণ আচরণের শিকার দরিদ্র ঘরের বা বিত্তহীন ও স্বল্পবিত্ত পরিবারের মেয়েদের নানাবিধ অসহায়তা হামিশাই তাদেরকে পীড়িত করে চলেছে। ব্যাহত হচ্ছে তাদের শিক্ষাজীবন, পথে ঘটে চলাফেরা সবই ঝুঁকিপূর্ণ তাদের যৌন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে। তেমন ঘরের কোন মেয়ে যদি সুন্দরী হয় দেখতে তবে তো কথাই নেই। যৌন হেনস্থার হাত থেকে কোন ক্রমেই রেহাই নেই যেন। সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে, লোক-লজ্জার ভয়ে এমন ঘটনাগুলি চেপে যেতে হয় বলেই আমাদের গণমাধ্যমগুলিতেও অধিকাংশ যৌন-হেনস্থার খবর প্রকাশিত হতে পারে না। যে অংশ প্রকাশিত হয় তা ঘটনার শতকরা ১০ ভাগের বেশী নয় বলেই আমার অনুমান।
আবার এ ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা নারীর ও তার পরিবারের দুর্ভোগের ও অসহায়তার মাত্রাক্রমান্বয়েই বৃদ্ধি করে চলেছে। পথে-ঘাটে যৌন নির্য্যাতন ছাড়া বাড়তি যা অনেকের জীবনে ঘটতে দেখা যায়, তা হলো অপহরণ, ধর্ষণ, গণ-ধর্ষণ, খুন অথবা অপরহণ করে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও বিয়ে। আর এ কাজে সমর্থকেরাও যেন অভাব ঘটান। নাবিলিকারাও এদের হাত থেকে রেহাই পায় না।
এগুলি দেখিয়ে হিন্দু নেতারা, যাঁদের অনেকেই ধীরে ধীরে মৌলবাদী উগ্র চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন, তাঁরা হিন্দু উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করে নারীর সমান অধিকার বা স্বামী-পিতার মৃত্যু ঘটলে তাতে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি প্রাপ্তির বিরোধিতা করে আসছেন। তাঁদের যুক্তি হলো-যেখানে হিন্দু মেয়েরা অপহৃত হয়ে জোর পূর্বক ধর্মান্তরিত হচ্ছেন বিয়েও করা হচ্ছে তাঁদের অমতে সেখানে ঐ মেয়েরা সম্পত্তি পেলে এমন ঘটনা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। কিন্তু এ যুক্তি দুটি কারণে চোখে টেকে না।
প্রতমত: এত নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার সাংবিধানিক বিধান লংঘন করা হয় এবং
দ্বিতীয়ত: এই যুক্তি মেনে নিলে হিন্দু মেয়েদের তো চাকুরী-বাকুরী করতেও দেওয়া উচিত নয়। কারণ তাতে তো তাঁরা মাসে মাসে বেতনÑভাতা সরকারী চাকুরী এবং উচ্চপদে হলে গাড়ী পর্য্যন্ত সরকারী খরচে পাবেন। এতে তো ঐ বিপদ আরও বাড়ার আশংকা থাকায় হিন্দু মেয়েদের গৃহবন্দী করে রাখা প্রয়োজন।
বস্তুত: মেয়েরা সম্পত্তির মালিক হন সাধারণভাবে এটা কোন পুরুষই চান না বলেই তাঁরা এ জাতীয় যুক্তি আনেন, ধর্মের দোহাইও দিয়ে থাকেন। যেমন দেখা যায় মুসলিম মহিলাদের ক্ষেত্রেই। সামান্য এবং বৈষম্যপূর্ণ হলেও কি মা, বোন প্রভৃতি মৃত স্বামী পিতার সম্পত্তির কিছু অংশে অধিকারী হলেও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তা আইনের বইতেই সীমাবদ্ধ থাকছে – বাস্তবে তার প্রয়োগ কচিত – কদাচিতই ঘটে। সুবিধা হলো-বোনটাতো বিয়ে হয়ে দূরে চলে যায়-ফলে বাবার সম্পত্তি আইনে পেলেও তা ভোগ করে থাকে তার ভাইএরা। তারা সম্পত্তির কোন আয়ও সচরাচর বোনদেরকে দেন না। বোনেরাও মেনে নিতে বাধ্য হনÑভাইএর সাথে বিবাদ-বিসম্মাদে লিপ্ত না হয়ে।
অথচ এই বৈষম্য যে নারীজীবনে কী ভয়াবহ অভিশাপের মত নানা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে সে ব্যাপারে রাষ্ট্র নীরব। অজুহাত এগুলি ধর্মীয় আইন। ঠিক একই কথা তো বলে থাকেন উভয় ধর্মের মৌলবাদীরাই। মৌলবাদীরা তো আবার সংবিধানই মানতে চান না কারণ সংবিধান মানুষ রচনা করেছে। আর ঐ আইনের ¯্রষ্ঠা আল্লাহ্ বা ভগবান।
কিন্তু ইতিহাস তো বলে অন্য কথা। বিজ্ঞজনেরাও বলেন ভিন্ন কথা। তাঁরা স্পষ্টত:ই বলেন, ঐ বিধি-বিধানগুলিও মানবসৃষ্ট। নজরুল তাঁর বিখ্যাত কবিতায় বলেছেন, “মানুষ এনেছে গ্রন্থ,
গ্রন্থ আনে কি মানুষ কোন।”
আমরা পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্রব্দ্যিাসাগর হিন্দু ধর্মের সংস্কার করে বিধবা-বিহাহ বৈধ করেছিলেন। স্বয়ং নিজ পুত্রকে এক বিধবা মেয়ের সাথে বিবাহ দিয়ে এ ব্যাপারে পথ প্রদর্শকের কাজ করেছিলেন।
ভারত সরকারের কথা তো আগেই বলেছি। তারা দীর্ঘ ছয় দশক আগে ধর্মীয় আইনগুলির সংস্কার করে নারীর উত্তরাধিকারে স্বীকৃতি, বিবাহ-রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক এবং অপরিহার্য্য ক্ষেত্রে তালাকের ভৈধতা দিয়েছেন। ভারতে যদি এভাবে সংস্কার করা যায় বাংলাদেশে সরকার কেন তা করতে পারবেন না? কেন মৌলবাদী নেতাদের পক্ষ থেকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে খসড়া তৈরী করে দিতে হবে। এভাবে খসড়া তৈরীর বিধান কিন সংবিধানে আছে?
মুসলিম আইনেও সংস্কার হয়েছে পাকিস্তান আমলেই। জেনারেল আইউবের শাসনামলে মুসলি পারিবারিক আইন সংস্কার করে পুত্র যদি স্ত্রীর আগে মারা যায় তবে তার বিধবা স্ত্রী ভাই এর অংশ পাবে এমন বিধান করেছে ঐ আইনের সংশোধন। সকল বিধবা নারীই মুসলিম সমাজে কি পাকিস্তানে কি বাংলাদেশে দিব্যি এই আইনের সুফল ভোগ করছেন। তাহলে কেন মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন করে এক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য দূর করা হবে না?
আজ প্রায় এক বছর হলো অষ্ট্রেলিয়ায় আছি। এখানে এর আগেও তিনবার এসেছি সাকুল্যে চার দফায় প্রায় সাড়ে তিন বছর কাটালাম সিডনীতে। এখানকার অধিবাসী বাঙালি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেকের সাথেই হৃদ্যতার সম্পর্ক স্বভাবত:ই গড়ে উঠেছে। এখানে অনেকেরই মৃত্যু ঘটে এবং তারপার এখানকার উত্তরাধিকার আইন মোতাবেক নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই সমান অংশ অংশীদার হন। কে, একে তো ধর্মদ্রোহী আইন বলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-মুসলমান কারও তরফ থেকেই সামান্যতম অভিযোগ উত্থাপিত হয় না।
তাই ধর্ম আসলে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণে কোন বাধা নয়। মূল বাধা হলো মৌলবাদী চিন্তাধারা। তাই সংবিধানে স্পষ্টাক্ষরে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লেখা থাকলেও তার বাস্তব প্রতিফলন আজও ঘটানো হচ্ছে না। লংঘিত হচ্ছে সংবিধান নির্য্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারী সমাজ।
- প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪–এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।