সেলিনা জাহান প্রিয়ার ছোট গল্প – নায়িকা দেখা
নায়িকা দেখা
—————– সেলিনা জাহান প্রিয়া
সাভার মনো মিয়ার বাড়িতে তখন সিনেমার শুটিং হয়। সিনেমা মানেই ব্যাপক বিনোদন। সাভার বংশী নদীর পারে মনো মিয়ার বাড়ি, এখনো সবাই চেনে। সাভার বাজারের মিষ্টি খুবই ভাল এর দাম কম। ১৯৮৪ সাল। তখন ঘরে ঘরে আজকের মত টেলিভিশন নাই। মাসে একটা সিনেমা দেখাত বাংলাদেশ টেলিভিশনে।
রোজার মাসে কোন সিনেমা বা ছবির গান প্রচার হত না। যে দিন বাংলা সিনেমা হবে সেই দিন তো, যার বাসায় টেলিভিশন আছে তার বাসায় ঈদ বলা চলে। তখন ওয়াসিম ও অলিভিয়া’র সিনামে মানেই সুপার হিট।
সাভার থানায় তখন বদলি হয়ে আসে আজিজ নামে এক পুলিশ। সাভার থানার সামনে একটা বিশাল পুকুর। আজিজ মিয়া মাঝে মাঝে পুকুরে চুরি করে মাছ ধরে। পুকুরে একদম কর্নারে তখন একটা বিশাল গাছ ছিল সেখানে হাজার হাজার কলা বাদুর পাখি থাকত। আজিজ মিয়া সেই গাছের আড়ালেই বড়শী ফেলে রাতে মাছ ধরত। থানার ওসি সাহেব তাকে খুব পছন্দ করত। কারন সে ওসি সাহেবের যে কোন গোপন কাজ গোপনেই করে দিত।
আজিজ মিয়ার বউ একদিন না কোন কিছু না বলেই থানায় আসে। আজিজ মিয়া বুঝতে পারে শাশুড়ির সাথে মানে আজিজ মিয়ার মায়ের সাথে কোন কিছু নিয়া ঝগড়া হয়েছে। আজিজ মিয়ার বউ আবার আজিজ মিয়ার মামাত বোন। ফুফু ভাইজি এক জাত তাই ঝগড়াটা একটু বেশি।
আজিজ মিয়ার বউকে আজিজ মিয়া অনেক ভালবাসে। কারন তাকে বিয়ে করতে তার বাবার কতবার যে পা ধরতে হয়েছে এক মাত্র আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না। আজিজ মিয়ার বউয়ের নাম রোজিনা। আজিজ মিয়া সখ করে রোজি ডাকে।
থানার পাশের একটা বাসা নিয়ে নিল। ওসি সাব সব ব্যবস্থা করল। থানা থেকে দুইটা চোকি পর্যন্ত ওসি সাব দিয়েছে। বাসার সামনেই নদী আশ-পাশে হিন্দু বাড়ি বেশি।
আজিজ মিয়া পুলিশের চাকুরী করে ব্যবহার খুব ভাল, তার রোজিনা ও খুব ভাল, অল্প দিনে আশ পাশের সবার সাথে একটা ভাল সম্পর্ক হয়েছে।।
একদিন আজিজ পুলিশের বউ জানতে পারল সাভারে নাকি সিনেমার শুটিং হয়।
যেই শুনল আর তার ঘুম নেই। কি করে সে তার স্বামী কে বলে সে সিনেমার শুটিং
দেখবে। কোন ভাবেই সাহস করতে পারছে না। এই দিকে খুব গরম। রাতে হাত পাখা দিয়ে জামাইকে বাতাস করতে করতে একবার বলল এই। এই খানে কোথাই নাকি
নায়ক-নায়িকারা সিনেমা করতে আসে। আজিজ মিয়া বলল এখন অনেক রাত ঘুমাও
সকালে ডিউটি আছে। রোজি আর সাহস পেল না কিছু বলার।
বিকালে আজিজ মিয়া একটা মিল্লাত ফ্যান কিনে বাসায় আসে। গ্রামের মেয়ে রোজি
ফ্যানের বাতাসে মনের মত ঘুমায়। এখন আর হাত পাখা লাগে না। কিন্তু সে শুটিং দেখার কথা মন থেকে ভুলতে পারছে না। নায়িকারা কি সুন্দর। তার মনে খুব সখ কাজ থেকে সে নায়ক নায়িকা দেখবে। রোজি তার মাকে আর ভাইকে চিঠি লিখে সে খুব ভাল আছে। আজিজ একটা নতুন ফ্যান কিনেছে। অনেক মজার বাতাস। তার বাসায় বিজলী বাতি আছে। প্রতিদিন মিষ্টি খেতে পারে। এক সের মিষ্টির দাম কুড়ি টাকা। আর এই খানে খুব কাছেই সিনেমার শুটিং হয়। তবে তারে এখনো নেয় নাই।
রোজির খুব জ্বর। সকাল থেকে কিছুই খায় নায়। আজিজ মিয়া সাভার বাজারে সাহা বাবুর ফার্মেসি থেকে জ্বরের দাওয়াই এনেছে। কিন্তু জ্বর ভাল হচ্ছে না। ডাক্তার বলল অধিক চিন্তা থেকে এই অসুক। আজিজ মিয়া চিন্তায় পরে গেল রোজির কি এমন চিন্তা। রোজির মা ও ভাই চলে আসছে। জ্বর তো কমার নাম নাই। আজিজ মিয়া রোজির মাথায় হাত দিয়ে বলে এবার জ্বর কমলে তোমাকে মনো মিয়ার বাড়িতে শুটিং দেখাতে নিয়া যামু।
রোজি চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে তুমি মিছা কথা বলছ না তো। আমি কিন্তু রোজ স্বপ্নে দেখি নায়ক নায়িকা। রোজির ভাই রতন বলল দুলা ভাই আমাকে ও নিতে হবে। তিন দিনের মধ্যে জ্বর চলে যায়।
আজিজ মিয়া ওসি সাহেব কে বলে স্যার আমার বউ শুটিং দেখতে চায়। ওসি বলল ঠিক আছে আগামী পরশু আবার শুটিং আছে। থানায় পুলিশ চাইছে। তুমি বউ নিয়ে যাইও। আমি ঐ বাড়ির ম্যানেজার কে বলে দিব।
আজিজ পুলিশ তার বউ কে বিকালে বাসায় এসে বলে কাল তারা মনো মিয়ার বাড়িতে
সিনেমার শুটিং দেখতে যাবে। এই কথা শুনার পর রোজির আর রাতে ঘুম নাই। সারা রাত চিন্তা করছে সে নায়িকা দেখবে। নায়িকা মানেই স্বপ্নের মানুষ তারা।
খুব সকালে উঠে সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে নিজে নিজেই যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেল।ছোট ভাই কে সে রেডি করে নিল। আজিজ মিয়া বলল তুমি চিন্তা কর না। আমি রিক্সা পাঠাইয়া দিমু তুমি আর রতন চলে এসো। রোজি এখন রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে তার ভাই কে নিয়ে। অনেক রোদ আর গরম। রিক্সা চলে আসে তাদের নিতে। রোজি রিক্সায় চড়ে রিক্সা চালককে বলে আপনি চিনেন মনো মিয়ার বাড়ি।
রিক্সাওয়ালা বলে কি যে কন আপা এই সাভারে সবাই মনো মিয়ার বাড়ি চিনে।রিক্সাওয়ালা একটা গান গায়, মনো মিয়া বাড়িতে বিয়ার বাজনা বাজে। রোজি কে নিয়ে রিক্সা চলে আসে মনো মিয়ার বাড়িতে।
মানুষ আর মানুষ। আজিজ পুলিশ তার বউ কে নিয়ে গাছ তলায় দাঁড়া করায়। চার দিক মানুষ আর মানুষ। রোজি বোকার মত চেয়ে আছে। এমন সময় একটা শুটিং শুরু হল। একজন বলল ক্যামেরা একস্যান। রোজি তার স্বামী কে বলে ঐ ব্যাটা তো বদমাইশ তারে এত লোক বাতাস করে কেন। আজিজ বলে এটা এটিএম সামসুজ্জামান। রোজি বলে দেখ টেলি ব্যাটা। আজিজ বলে টেলি সামাদ। রোজি আজিজ কে বলে বার বার খালি অ্যাকশান অ্যাকশান বলে কেন।
আজিজ বলে আমি কি পরিচালক যে বলব। চার দিক মানুষ আর মানুষ। মনু মিয়ার
বাড়ির ভিতরে শুটিং হবে তাই রোজি কে নিয়ে আজিজ মিয়া বাড়ির ভিতরে যায়। শুটিং চলছে। রোজি বলে বার বার খালি অ্যাকশান অ্যাকশান বলে কেন। গরমে প্রায় খারাপ অবস্থা। বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখে চিত্র নায়িকা ববিতা, নতুন আর আনোয়ারা। রোজি খুব অবাক হয়। জিবনে এত কাছে থেকে কোন দিন দেখবে ভাবতে পারে নাই। আজিজ মিয়া কে দেখে সাভার বাজারের এক ক্যামেরা ম্যান বলল। ভাই ভাবির সাথে একটা ছবি তুলে দেই। রোজি এই কথা শুনে মহা খুশি। ক্যামেরা ম্যান ববিতা আর নতুন এর পিছনে দাড়াইয়া একটা ছবি। ববিতার সাথে একটা ছবি। এমন করে প্রায় পাচ টা ছবি তুলে।
রোজি ববিতা কে বলে আপা আমি কি আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পাড়ি। ববিতা একটু হেসে তাকে জরিয়ে ধরে বলে ভাই আমি তোমার মত একজন মেয়ে মানুষ। রোজি জিবনে চিন্তাও করে নাই যে ববিতা তাকে জরিয়ে ধরবে।
রোজি তো মহা খুশি। শুটিং দেখা শেষ করে বাসায় আসে। আজ সে মহা খুশি। নিজের চোখে সে ববিতা কে দেখেছে তাকে জরিয়ে ধরল। ছবি তুলল। পরের দিন রোজি তার হাতে সেই ছবি গুলি পায়। ছবি দেখে সে খুবই অবাক। সে তার বাড়িতে সবার কাছে চিঠি লিখে সাথে একটা করে ছবি দেয়। আজিজ মিয়া দুই দিন পর পর স্টুডিও থেকে ছবি আনতে যায়। আজিজ মিয়ার বউ কয়দিন পরে গ্রামে যায়। সেই সময় গ্রামের সবাই তার কাছে জানতে চায় নায়িকা কেমন দেখল। রোজি সবাই কে রাতে আসতে বলে। গ্রামের প্রায় তখন সকল বয়সের মেয়েরা চলে আসে রোজির বাড়িতে। রোজি সেই ছবি গুলো নিয়ে, হারিকেন জ্বেলে চাঁদের আলোর নিচে সবাই কে নিয়ে শুরু করে নায়িকা দেখার গল্প…………………..।