নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ
অনলাইন ডেক্স । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
নির্বাচন নিয়ে টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ) যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, এটি সঠিক হলে তা দেশের গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য ইতিবাচক নয়। এতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতিও মানুষের আস্থা কমেছে। ফলে দেশের গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, সদ্যসমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মঙ্গলবার একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা (টিআইবি)। ভোটে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। লটারির মাধ্যমে দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ৫০টি আসনের ওপর এই গবেষণা করা হয়েছে। এতে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে, এমন ৪৭টিতেই অনিয়ম পাওয়া গেছে।
সংস্থাটি বলেছে, ৩৩টি আসনে আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ভরে রাখা হয়। টিআইবির তথ্য অনুসারে সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলা হলেও ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ বলা যায় না। নির্বাচন নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের পক্ষে মত দিয়েছে সংস্থাটি।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, টিআইবির প্রতিবেদনে যেসব তথ্য এসেছে, তা অত্যন্ত গুরুতর এবং উদ্বেগজনক।
তিনি বলেন, এই প্রতিবেদন সত্য হলে, তা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য ইতিবাচক নয়। তার মতে, নির্বাচন নিয়ে অনিয়মের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। এটি কোনোভাবেই তুচ্ছ করা যাবে না।
তিনি বলেন, কমিশনকে আইনে অনেক ক্ষমতা দেয়া আছে। ফলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের অবশ্যই এসব বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সবকিছু মিলে গণতন্ত্রের ভালো কিছু হয়নি।
টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ৫০টি আসনে অনিয়মের ধরনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ৪১টি আসনে জাল ভোট হয়েছে। ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা ছিল। ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারা হয়েছে। ২১টি আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে। ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল দেয়া, ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ২০টিতে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছে।
এছাড়া ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে। ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়ার মতো অনিয়ম পাওয়া গেছে।
টিআইবি বলেছে, নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন সব দলের সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ নিশ্চিত, বিরোধীদের দমনে সরকারের বিতর্কিত ভূমিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, সব দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীর নিরাপত্তা সমানভাবে নিশ্চিত করা, নির্বাচনী অনিয়ম ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সরকারি দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের উপযুক্ত ভূমিকা। এতে কার্যত নির্বাচন কমিশন সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি।
এছাড়া নির্বাচনের সময়ে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ যেমন পর্যবেক্ষক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, মোবাইলের জন্য ফোর-জি ও থ্রি-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ, জরুরি ছাড়া মোটরচালিত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, টিআইবি একটি আন্তর্জাতিক এনজিও। তারা মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করেছে। এখানে অনেক অনিয়মের কথা বলেছে। আর এ ধরনের সংস্থার গবেষণা বিশ্বাসযোগ্য হয়।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে টিআইবির প্রতিবেদনে যা এসেছে, তা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্য খারাপ সংবাদ। আর টিআইবি বিস্তারিত প্রতিবেদনের বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণ দিয়ে একটি তদন্ত চাইতে পারে। তবে প্রশ্ন হল- তদন্ত কে করবে। ইসি নির্বাচনের আয়োজন করেছে। ফলে এই প্রতিষ্ঠান দিয়ে তদন্ত সম্ভব নয়। কারণ নির্বাচন কমিশন বলে দিয়েছে, এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। আর সরকারি দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছে। তাদের মাধ্যমেও তদন্ত সম্ভব নয়। এ অবস্থায় বিচার বিভাগই একমাত্র তদন্ত করতে পারে। আর কোনো সংস্থা দিয়ে তদন্ত সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে যারা টিআইবির প্রতিবেদন মানেনি, তাদেরও তথ্যপ্রমাণ দিয়ে, নিজেদের সত্যতা প্রমাণ করতে হবে।
টিআইবির গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল ও জোটের কোনো কোনো কার্যক্রম নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। যেমন, সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করায় সরকারের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন সমর্থক গোষ্ঠী সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা এবং নির্বাচনমুখী প্রকল্প অনুমোদন করেছে।
পাশাপাশি নির্বাচনের প্রায় এক বছর আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণা, বিরোধী পক্ষের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নেয়ায় বাধা দেয়া হয়েছে। আর সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেয়ার পরও নির্বাচনের সময় পর্যন্ত ধরপাকড় ও গ্রেফতার অব্যাহতসহ সরকারবিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেয়া এবং প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। এসব ঘটনা নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে।
জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অবশ্যই ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ভূমিকাও ছিল পক্ষপাতমূলক ও বিতর্কিত। আর এসব অভিযোগের কারণেই নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ এবং বলা যায়, অভূতপূর্ব একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার ফলাফলও অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য।
অন্যদিকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০টির মধ্যে ৩৬টি আসনে বিরোধী দলের প্রচারে বাধা দেয়াসহ ৪৪টি আসনে সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই দলীয় নেতাকর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ বা প্রশাসন কর্তৃক হুমকি ও হয়রানি, প্রার্থী ও নেতাকর্মী গ্রেফতার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও কর্মী কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে ভয়ভীতি দেখানোর তথ্য পাওয়া যায়।
এ ছাড়া গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১৯ আসনে সহিংসতাসহ প্রার্থীদের নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারি, সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর করা, পুড়িয়ে দেয়ার চিত্র দেখা গেছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, টিআইবির প্রতিবেদন নির্বাচনের সুষ্ঠুতাকে কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে গত দু’বছরে জাতীয় ও স্থানীয় যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ নির্বাচন কমিশন খুব ভালো কিছু করতে পারবে, মানুষের মধ্যে সেই আস্থা জন্ম হয়নি। ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনেক বেশি যত্নবান হতে হবে।
গবেষণায় নির্বাচনী ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও কার্যকর করতে ৬টি সুপারিশ করেছে টিআইবি। এগুলো হল- ১) নির্বাচনে বহুমুখী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া, ২) নির্বাচন কমিশনকে তাদের ব্যর্থতা নিরূপণ করে জনসমক্ষে প্রকাশ করে কমিশনের গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত, ৩) নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করার মাধ্যমে সৎ, যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ, ৪) দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ অন্যান্য অংশীজনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, ৫) নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ ডিজিটালাইজ করা এবং ৬) নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের তথ্য সংগ্রহের জন্য অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা টিআইবির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, এটা আমরা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করছি। এটা ঠিক রিপোর্ট না। কারণ পত্র-পত্রিকার যে তথ্য পেয়েছি, তাতে এরকম কোনো রকমের কোনো অভিযোগ পাইনি। কোনো জায়গায় আপনারা (সাংবাদিকদের) এমন (অনিয়মের খবর) দেখাননি, তারা (টিআইবি) যেভাবে বলেছেন। নির্বাচনে সে ধরনের অনিয়ম হয়েছে।
তিনি বলেন, শুধু গণমাধ্যম নয়, আমাদের কর্মকর্তা, নির্বাচনী তদন্ত কমিটি, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছ থেকে আমরা নির্বাচনের তথ্য নিয়েছি। নির্বাচনে এমন ঘটনা হয়নি। টিআইবি যে রকম বলেছে, তার সত্যতা নেই।
এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে টিআইবির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, এ প্রতিবেদন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও একপেশে। এতে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বক্তব্য প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে টিআইবি প্রতিবেদনটি দিয়েছে মাত্র। অন্য কিছু নয়। সূত্র-যুগান্তর।