সেলিনা জাহান প্রিয়ার রহস্য গল্প-নীলার নীল ডায়রি
রহস্য গল্প– নীলার নীল ডায়রি
—————————সেলিনা জাহান প্রিয়া
শীতের সকাল বেশ কুয়াশা পড়ছে অরন্য কুয়াশার জন্য ঠিক মতে গাড়ি চালাতে পারছে না। এমনিতে সারারাত ঘুমাই নি। রাত ৮ টায় রাঙ্গামাটি থেকে ঢাকার পথে রওনা দিয়েছে রাস্তার অবস্তা ভাল না সস্কারের কাজ চলছে।
অরন্যের চোখের বাতি নিভু নিভু করছে। কিন্তু এখন আর ঘুমিয়ে কাজ নেই। ভাবছে নাস্তাটা করে নিবে রাস্তার কোন হোটেল থেকে। মানি ব্যাগ টা পকেটে নিয়ে গাড়ি থামালো কুমিল্লার ময়না মতির কাছে একটা হোটেলে।
শীতের সকাল। রাস্তা ঘাটে লোক জন তেমন নেই। দোকান গুলো এখনো খোলেনি। অরন্য আলী হোটেলের দিকে হাঁটছিল। ঘুমের কারনে চোখ খোলা রাখতে পারছি না। ভাল করে চোখে মুখে পানি দিয়ে নাস্তা করে তিন কাপ চা গ্লাসে ঢেলে নীল। চা শেষ করে আবার গাড়ি ছাড়লো। ভোর তখন প্রায় ছয়টা। কুয়াশার মধ্য কিছু বুঝে উঠার মনে হল গাড়িতে কেউ ধাক্কা খেয়েছে। গাড়িটা থামালো। পিছনে একটু দূর হাঁটার পর দেখলো ফুপিয়ে কাঁদছে। যাক বাবা বেঁচে আছে। নীল রঙের শাড়ি পরা একজন মহিলা।
–কি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন?
– না সাইড গ্লাসের বারি ছিল।
— রাস্তা দেখে পার হবেন না।
— আরে রাস্তা পার হতে চাই নাই। বাস মনে করে হাত দেখিয়ে ছিলাম।
অরন্যের গা দিয়ে যেন ৪৪০ ভোল্ট এর বিদ্যুৎ ছুঁয়ে গেলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এ তো আকাশ থেকে নেমে আসা নীল পরী। মনে মনে বললো পরী তোমার ডানা গুলো কোথায়?
মেয়েটি কান্না ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির চোখে কিছু একটা আছে। অদ্ভুত এক মায়া যা দেখলে মনে হয় বুকের ভেতর কোথায় যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা সৃষ্টি হয়।
মেয়েটিকে আবার জিজ্ঞাস করলো- কাঁদছেন কেন? ব্যথা তো পান নাই। মেয়েটি কিছু বলল না। ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
অরন্য দাড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে মেয়েটি ভয় পাচ্ছে। অবশ্য ভয় পাবারই কথা। সারা রাত ঘুমাই নি। চোখ লাল টমেটো হয়ে আছে। চেহারার ১২ টা বেজে আছে।
অরন্য বলল – আপনি কি কোনো সমস্যায় পরেছেন? এখনে বসে এভাবে কাঁদছেন। মেয়েটি অরন্যকে অবাক করে দিয়ে বলল- আমাকে একটু আপনার সাথে নিতে পারবেন?
অরন্য ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। মনে মনে এটাই ভাবছিল।
অরন্য বলল— পারব। আপনার সাথে কি কেউ নেই?
না।
ঠিক আছে আপনি একটু সামনে আসেন ওই খানে আমার গাড়ি আছে।
মেয়েটি উঠে বসলো গাড়িতে।
অরন্য নীরবতা ভেঙ্গে মেয়েটিকে জিজ্ঞাস করলো?
আপনার নাম কি?
মেয়েটি মুখ তুলে তাকালো। কিন্তু কিছু বলল না। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।
হঠাৎ মেয়েটি বলে উঠলঃ আমি নীলা। আমার বাসা ঢাকা। বান্ধবির সাথে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম এখানে বাস থেকে নেমেছিলাম। কারন আমার এক বন্ধু এখানে থাকবে বলেছিল।
অরন্যঃ আপনার সাথে মোবাইল নেই।
না। আমি মোবাইল ব্যবহার করি না।
আপনার বাবা-মা কারো ফোন নাম্বার আছে?
আমি নম্বর মনে রাখতে পারি না।
তো এখন কি করবেন?
জানি না। মেয়েটি আবার ফুপিয়ে কান্না শুরু করল।
আচ্ছা আপনি কান্না থামান। আপনি কাঁদবেন না। প্লীজ। আপনার বাসার ঠিকানা জানেন?
জানি।
ঠিক আছে আমি আপনাকে ওখানে পৌছে দিয়ে আসব। আপনি চিন্তা করবেন না।
আপনি কিছু খেয়েছেন?
না। ঠিক আছে সামনে থেকে নাস্তা করেন। তার পর আমার রওনা দিব। মেয়েটি বলল থাক নাস্তা করবো না। আমার একটা উপকার করবেন।
হ্যা কেন করবো না। আপনি যে বেঁচে আছেন। মরে গেলে তো সারা জীবন আপনার জন্য দুঃখ পেতাম।
আসলে এক সময় আমরা সবাই মারা যাব। কেউ আগে কেউ পরে।
আপনার কি উপকার করবো বলুন। যে কুয়াশা সামনে গাড়িতে কিছুই দেখা যায় না।
আমি আসলে বাসা থেকে না বলে চলে আসছিলাম। আমার বান্ধবির বাড়িতে। আপনি আমার আব্বু কে বলবেন আমাদের ঘরে পুরাতন বুক সেলফে আমার একটা নীল রঙের ডাইরি আছে। ডাইরি টা পরে যদি আমাকে ক্ষমা করে তাহালে আপনি বলবেন আমার ঠিকানা মতো চলে আসতে। আমার ঠিকানা লিখা আছে বুক সেলফের ১১৩ নং বইয়ের ১১৩নং পাতায়।
আমি সামনে নেমে যাব। যদি আপনি আমার এ কাজ করে দেন তাহালে আপনি আব্বুর
সাথে চলে আসবেন। আমাকে মেঘনার টোল প্লাজায় নামিয়ে দিয়েন। আব্বু আসলেই ঢাকা
যাব।
অরন্য ভাবছে ভালই হোল জীবনে এমন একটা মেয়ে সে খুজছিল শান্ত ও নরম। মেয়েটি আরামে ঘুমাচ্ছে। অরন্য তাকিয়ে আছে নীলা মেয়েটি দিকে। কি নিস্পাপ মুখ। ঘুমন্ত মানুষ কে দেখতে নিস্পাপ লাগে। মেয়েটি দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে অদ্ভুত এক মায়ার জালে আটকা পরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মেয়েটির প্রেমে পরে গেছে। জানি না এমন কেন মনে হচ্ছে।
মেয়েটি হঠাৎ বললো থাক আমাকে ঐ বাস স্টপে নামিয়ে দিন। আমার বাসার ঠিকানা লিখে নিন।
অরন্য মেয়েটিকে তার মোবাইল নাম্বার লিখে দিল। ঠিকানা লিখে নিলো। মেয়েটি নেমে গেল। অরন্যের ঘুম হাড়িয়ে গেল। পাক্কা দুই ঘণ্টা। এর মধ্য কত কি?
যাই হোক বিকেলে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে উঠে বিকেল ৪ টায় নীলার বাসার সামনে দাড়িয়ে কলিং বেল বাজালো। এটা মাঝ বয়সী মহিলা দরজা খুলে দিলো। চেহারা একদম নীলার মত। অরন্য বলল -আপনি নিশ্চয় নীলার মা। মহিলা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত পর উনি বলল “তুমি নীলা কে কীভাবে চেন?
অরন্য বলল নীলার সাথে কি ভাবে দেখা হয়েছে।
উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমাকে কিছু না বলে উনি ভিতরে চলে গেলেন। অরন্য বোকার মত দাড়িয়ে রইলো। এর মধ্য অরন্য কে ডাক দিলেন। অরন্য কে একটি ছবি দেখালো। ছবিটি নীলার।
তুমি কি ওর কথা বলছ?
জি ওর কথা বলছি।
ঠিক আছে বাবা ভিতরে এসো।
নীলার মা কাঁদছে আর বলছে তাহলে আমার মেয়ে বেঁচে আছে। তুমি তাকে দেখেছ। নীলার বাবা কি বোকার মত কান্না করছ? কে বাবা তুমি। আমার মেয়ে মারা গেছে ৭ বছর হল। আমি তাকে নিজের হাতে লালমাই পাহারের পাশে এক গ্রামে মাটি দিয়ে এসেছি। কে বা কারা জানি ওকে মেরে রাস্তায় ফেলে গেছে। আমরা তা জানি না। মামলা টা সিআইডি তে আছে।
অরন্যের সারা শরীর আবার যেন ৪৪০ ভোল্ট এর বিদ্যুৎ ছুঁয়ে গেলো। বলেন কি? আমি যে আজ ভোরে আমার সাথে ঢাকা আসতে চাইলো। নীলার বাবা বলল তোমার মত একজন বছর খানেক আগে একবার তোমার মত বলেছিল। যখন শুনল সে মারা গেছে তখনেই সে তাড়াতাড়ি চলে গেল। আমাকে কি জানি বলতে চেয়ে আর বলল না। না বলেই চলে গেল। অরন্য বলল – আপনি জানেন না নীলা কিভাবে মারা গেল। কার সাথে চলে গেল। নীলার বাবা বলল – নিলা খুব কম কথা বলত। ও ছিল শান্ত স্বভাবের। আমরা জানতেই পারি নাই কে তাকে নিয়ে গেল। তবে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
অরন্য বলল- আপনার ঘরে পুরাতন বুক সেলফ টা কোথায়। আমাকে নিয়ে জান। অরন্য চেয়ে আছে শত শত বই। একটা একটা করে খুঁজে লাগলো নীল রঙের ডাইরি। পেয়ে গেল। নীলার বাবাকে ডাইরি টা দিল। আবার সে খুঁজতে লাগলো ১১৩ নং বই। পেয়ে গেল। ১১৩ নং পাতায় দেখতে পেল একটা চিঠি, ঠিকানা ও ফোন নাম্বার সব দেয়া আছে।
নীলার বাবা ডাইরি পড়ছে আর কাঁদছে। নীলার মা ফোন করে সিআইডি কে জানালো।
তিন মাস পরে সেই ঘাতক পুলিশে ধরা পড়লো। মাঝে মধ্য অরন্য আসে নীলার বাসায়। আজ অরন্য নীলার বাবাকে নিয়ে সেই লাল মাই পাহারের কাছে গেল। নীলার কবরে একটা বকুল ফুলের গাছ লাগালো। চারা বকুল গাছ কিন্তু কয়েকটা বকুল ফুল আছে। বেশ কিছু দিন পরের কথা।
অরন্য ঘুম থেকে উঠে দেখে তার বিছানার বালিশের পাশে কিছু বকুল ফুল…………………………।।