পরিবারের তিন জনই অন্ধ
এস এম নাজমুল হোসেন, (শরীয়তপুর) গোসাইরহাট প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
জীবন ভাঙ্গা গড়ার এক অভিনব প্রতিষ্ঠান। কেউ হাঁসে, কেউ কাঁদে। কেউ রাজপ্রাসাদে, কেউ ফুটপাতে। কেউ জন্ম নিয়ে সোনার চামচ মুখে দেয়, কেউ ভুমিষ্ট হয়ে ক্ষুধার তারনায় আর্তচিৎকার করে। পৃথিবী নামক সংসারের বহুরুপ। এর তেজস্ক্রীয়তায় পুড়ে সোনা হয়, কেউ হয় অঙ্গার। জীবনের দোলাচল এক কঠিন বাস্তবতা। কারো অবশিষ্ট খাবার পরিত্যক্ত উচ্ছিষ্ট, সেটা কারো নিত্য দিনের আহার।
জীবনের পরতে পরতে দুঃখ আর অভাব যার নিত্য দিনের সঙ্গী। সেই আবুল কালামের বয়স এখন ৫৪ বছর। গোসাইরহাট উপজেলার ইদিলপুর ইউনিয়নের মিত্রসেনপট্টি গ্রামের মৃত ইউসুফ আলী মাল’র ছেলে। এক বছর বয়সে শিয়ালের কামড়ে গুরুতর আহত হয়। বাবা ইউসুফ আলী মাল ছেলের চিকিৎসায় শেষ সহায় সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করেও চোখের আলো ফিরিয়ে আনতে পারেননি। পর্যায় ক্রমে ৫ বছর বয়সে এসে দুটি চোখেই দৃষ্টি হারায় কালাম। সেই থেকে অদ্য পর্যন্ত অন্ধ কালামের কেটে গেছে ৫০টি বছর। দুটি চোখ নষ্ট হওয়ার কারনে কোনো কাজ কর্ম করতে না পেরে ভিক্ষা করা পেশা হিসাবে নিয়েছেন।
বিশ বছর বয়সে ফাতেমা নামে এক মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। কালাম ও ফাতেমার ঘরে জন্ম নেয় রাসেল ও শিল্পী নামে দুই সন্তান। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, রাসেল ৫ বছর বয়সে নদীতে গোসল করতে নামলে চোখে বালু ঢুকে তারও চোখ দুটি নষ্ট হয়ে যায়। ৩ বছর বয়সে শিল্পী চুলায় গরম ডালের পাতিলে পড়ে স্থায়ীভাবে অন্ধত্ব বরন করে। এখন রাসেলের বয়স ২২ ও শিল্পীর বয়স ১৮ বছর। কষ্টের নদী কখনো অতিক্রম করতে পারেনি। দৈনিক ভিক্ষা করে যা পায় তাই দিয়ে রুটি রুজির ব্যবস্থা হয়। দীর্ঘশ্বাস আর স্মিত হাসির মধ্যে সান্তনা খুঁজে পায় চির অভাবী আবুল কালাম। কোনো অনুরাগ নাই। স্ত্রী ফাতেমার দিন পার হয় স্বামী ও ছেলে-মেয়ের খেদমত করে। তাদের সবার মনের মধ্যে কষ্টের যে পাহাড় জমেছে তা তাদের সাথে কথা বলে অনুমান করা যায়।
গোসাইরহাট পট্টি ব্রিজের পূর্ব পাড়ে তিন নদীর মোহনায় জীর্ণ-শীর্ণ একটি দোচালা টিনের ঘর। সেখানে বসবাস করেন আবুল কালাম চার সদস্যের পরিবার নিয়ে। ছেলে-মেয়েও অন্ধ হয়ে পাড়ি দিয়েছেন বিশটি বছর। দুজনই পূর্ণ বয়স্ক যবুক-যুবতী। অভাব তার অষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকলেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রাসেল ও শিল্পীকে ভিক্ষা করতে দেননি সামাজিক চক্ষু লজ্জায়। সারাদিন পরিশ্রম করে হাত পেতে যে দক্ষিনা পান, তা দিয়ে কোনো রকম সংসার চলে আবুল কালামের। খেয়ে না খেয়ে, অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে তিল তিল করে কিছু পয়সা জমিয়ে পনের বছর আগে ১১ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে। পরিতৃপ্তির তৃপ্তিতে তৃপ্তমান হয়ে খুজে নেন মাথা গোজার ঠাই। কিন্তু রাক্ষুসে নদী এ দুঃখী পরিবারের সুখ সইতে পারেনি। বিগত চার পাঁচ বছরে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ৮ শতাংশ জমি গ্রাস করে ফেলেছে। বাকি ৩ শতাংশের উপর মুখ ভার করে দাড়িয়ে আছে দোচালা একটি টিনের ঘর। তাও চূড়ান্ত পর্যায়ে যেকোন মুহুর্তে গিলে খাওয়ার অপেক্ষায়। ঘর নদীর এত কাছাকাছি যে, নেত্র যুগলের তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়লে নদীর পানিতে মিশে একাকার হয়ে যাবে। নদীর ছলাত ছলাত ঢেউয়ের মধুর গর্জন তাদের কাছে আতঙ্ক হয়ে দাড়িয়েছে। ঘুমের ঘরে কখন যেন ঢেউর ধাক্কায় সারা জীবনের অর্জিত সর্বশেষ সম্বল টুকু নিঃশ্বেস করে দেয়। ভাগ্য বড় নিষ্ঠুর ! পৃথিবীর রং, রুপ ও যৌলস কিছুই তাদের উপভোগ করার সুযোগ হয়নি। মানবতা ও মনুষত্বের দরজাগুলো সীলগালা। তাই তাদের করুন আর্তনাদ কোথাও পৌছেনি। তবুও অধম্য ইচ্ছা শক্তি তার দমে যায়নি। এখনো সে স্বপ্ন দেখে চিকিৎসা হলে ছেলে-মেয়ের দৃষ্টি ফিরে পাবে। পরিবারের চার সদস্যের মধ্যে প্রধান উর্পাজনক্ষম ব্যক্তি সহ তিন জনই অন্ধ। অথচ, সরকারী কোনো তালিকায় তাদের নাম নেই। তাদের কাছে পৌছেনি প্রতিবন্ধি ভাতা, ভিজিএফ ও হতদরিদ্রদের কার্ডসহ সরকারী কোন আর্থিক সহযোগিতা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র, তাদের দায়িত্ব কী কেউ নিবেনা?
আবুল কালামে সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, নিজে অন্ধ হওয়ার সময় নিজের চিকিৎসা করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ছেলে-মেয়ে অন্ধ হওয়ার পর টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারিনি। বিত্তবানদের কাছে আমার ছেলে-মেয়ের চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাই।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, তাদের নামে এখনো প্রতিবন্ধি ভাতার আবেদন পাইনি। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তালিকা দিলে তাদের প্রতিবন্ধি ভাতা দেওয়া হবে।
২নং দাসের জঙ্গল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি, মোঃ আলাউদ্দিন মৃধা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তাদেরকে আমি চিনি। তাদের পরিবারে তিন জনই অন্ধ। তারা খুব মানবেতর জীবন যাপন করছে। তারা কোনো সরকারী অনুদান পায় না। মিডিয়ার কাছে সংবাদ পৌছানোর পরে এরপর জানতে পারলাম এখন একজনে পায় আর দুইজন এখনও পায় না। এটা চরম অমানবিক।
ইদিলপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার মোঃ হাবিবুর রহমান ঘরামী বলেন, আমার কাছে তারা সাহায্যের জন্য কখনো আসেনি। আসলে সহযোগিতা করবো।