পাবনা এক্সপ্রেস নয় ঢালার চর এক্সপ্রেস? বিস্ময়কর
পাবনা এক্সপ্রেস নয় ঢালার চর এক্সপ্রেস? বিস্ময়কর
রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
মাত্র তো বছর খানেক হলো-অথবা তারও কিছু কম। এর মধ্যেই এমন কি ঘটে গেল যে “পাবনা এক্সপ্রেস” নামক গত বছর চালু হওয়া ট্রেনটির নাম বদল করা হলো-নতুন নাম দেওয়া হলো “ঢালার চর এক্সপ্রেস”।
পাবনাবাসী অন্তত: ৮০/৮৫ বছর ধরে আন্দোলন দাবী করে আসছিলেন পাবনা শহরকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করা। অবশেষে দীর্ঘ আন্দোলন, সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রকল্প গৃহীত হলো ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালার পর্য্যন্ত রেলপথ নির্মান করা হবে। সেটাও আবার সিঙ্গল লাইন। তবুও আন্দোলনকারী পাবনাবাসী মেনে নিলেন যে অন্তত: পাবনা থেকে রাজশাহী ট্রেনে যাওয়ার সুযোগ তো পাওয়া গেল।
ট্রেনটির নামকরণ করা হয়েছিল “পাবনা এক্সপ্রেস”। ভোরে ট্রেনটি ঈশ্বরদী থেকে পাবনা আসতো এসেই সকাল ৭.৩০ মি. এ রাজশাহীর পথে রওনা হতো। আবার রাজশাহী থেকে সন্ধ্যায় পাবনা এবং অত:পর পাবনা থেকে ঈশ্বরদী। এভাবেই চলছিল ট্রেনটি। ট্রেনের সময়ও করা হয়েছিল এমন যে ঠিক অফিস শুরুর আগদিয়েই পাবনা থেকে রাজশাহী পৌঁছানো যেত। অফিস-আদালত-কেনাকাটা প্রভৃতি সেরে সন্ধ্যায় পাবনা ফিরে আসা যেত। এ ব্যবস্থা আজও (১৫ জানুয়ারি) চালু আছে-তবে সম্ভবত: ২৬ জানুয়ারি থেকে সব পাল্টে যাচ্ছে।
রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের ইস্যুকৃত সার্কুলার অনুযায়ী ২৬ জানুয়ারি, ২০২০ থেকে “পাবনা এক্সপ্রেস” নামটি পরিবর্তিত হয়ে যাবে এবং নতুন নাম হবে “ঢালার চর এক্সপ্রেস”। ট্রেনটি ঢালার চর থেকে সকাল ৭টায় ছেড়ে পাবনা এসে পৌঁছাবে সকাল ৮.৩০মি. এর দিকে। আর রাজশাহী গিয়ে পৌঁছাবে বেলা ১১টার দিকে।
একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায়, ঢালার চরকে স্মরণীয় করার জন্যই এই নতুন নামকরণ। আর ঢালার চর এলাকার মানুষ যাতে ভোরে রওনা হয়ে পাবনাতে অফিস সময় ধরতে পারেন সেভাবেই সিডিউল নির্ধারণ করা হয়েছে।
অপরদিকে পাবনার মানুষেরা? তাঁরা বেলা ১১টায় রাজশাহী গিয়ে আর যাই করতে পারেন অফিস আদালতের কাজ করতে পারবেন না। কারণ বেলা ১১ টায় রাজশাহী ষ্টেশনে পৌঁছে অফিস আদালতে গিয়ে পৌঁছাতেই তো বেলা ১২ বেজে যাবে। সুতরাং পুনর্মুষিকো ভব। অর্থাৎ যে বাসে করে পাবনার লোকজনকে রাজশাহী যেতে হতো-অফিস আদালতের কাজের জন্য সেই পাবনা বাসীকে আবারও বাস বির্ভর হতে হবে।
তবে কি ঢালার চর বাসী যাতে পাবনাতে তাঁদের অফিস-আদালতের কাজ করতে পারেন সকাল সকাল পাবনা এসে সেই কারণেই এমনভাবে সময় পুনর্নিধারণ করা হলো? বিস্ময়করই বটে!
রেলওয়ে মন্ত্রণালয় তাদের প্রকল্প অনুযায়ী আজও ঢালার চর ষ্টেশন অনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করতে পারে নি। সদ্যই এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এখন উদ্বোধনের অপেক্ষা মাত্র। সেই কাজটির জন্য ২৬ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
যেহেতু ঢালার চর ষ্টেশনে রেল চলাচল ২৬ জানুয়ারি শুরু হবে তাই সেদিন থেকে “পাবনা এক্সপ্রেস” ট্রেনটির নাম পরিবর্তিত হয়ে তার নতুন নাম হবে “ঢালার চর এক্সপ্রেস।”
এ যাবত যতগুলি ট্রেনের নামকরণ করা হয়েছে তা কোন না কোন উল্লেখযোগ্য, বিখ্যাত ও সুপরিচিত স্থান, ব্যক্তি বা অন্য কোন দিন নির্ধারণ ব্যাপার নিয়ে-সেভাবেই পাবনা এক্সপ্রেস নামকরণ করা হয়েছিল। নামটি পরিবর্তন করে কি তবে অধিকতর পরিচিত খ্যাতনাম ব্যক্তি বা কোন ব্যক্তি বিশেষকে স্মরণীয় করার লক্ষ্যে করা হচ্ছে?
এবারে আসি ঢালার চর প্রসঙ্গে। এটি পাবনা জেলার বেড়া থানার একটি ইউনিয়ন। এলাকাটিতে এযাবত বাস সার্বিসও চালু হয় নি তেমন কোন পাকা সড়কও নির্মিত হয় নি। গরুর গাড়ী, রিক্সা, ভ্যান প্রভৃতিই হলো সেখানকার যানবাহন। এবারে লাফ দিয়ে ট্রেন সার্ভিস চালু হবে। তা হোক। কিন্তু তাই বলে “পাবনা এক্সপ্রেস” নামটি পরিবর্তন করতে হবে কেন? সেটা হতে যাচ্ছে কাকে স্মরণীয় করতে?
ঢালার চর আদৌ কোন বাণিজ্যিক এলাকা নয়। সেখানে বড় কোন হাট-বাজার-স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় কিছুই নেই। তবে আছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি। পুলিশ ফাঁড়ি কেন? কারণ এলাকাটি সন্ত্রাসী এলাকা। বেড়া-সাঁথিয়া অঞ্চলের সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয় ছিল। আর ঐ সন্ত্রাসীদের দমনের জন্যই কিছুকাল আগে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছিল। আজও বেড়া-সাঁথিয়াই শুধু নয় পাবনা জেলার সকল এলাকার মানুষই ঢালার চর নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন।
সেই ঢালার চরের নামেই “ঢালার চর এক্সপ্রেস” নামে ট্রেন সার্ভিস চালু হতে যাচ্ছে?
বস্তুত: ঢালার চর পর্য্যন্ত রেল লাইন নির্মাণেরই কোন যৌক্তিকতা নেই। এই সার্ভিস অর্থনৈতিকভাবে লাভ জনক হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। অন্য কোন এলাকার মানুষের ঢালার চর যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই আদৌ। তবে সেখানকার আসামীদের আদলাতে যাতায়াতের জন্যে এতে হয়তো সুবিধে হবে। কিন্তু তার জন্যে “পাবনা এক্সপ্রেস ট্রেনটির নাম পরিবর্তন? আজব ব্যাপার তাজ্জব কা-ই বটেই।
এ ব্যাপার জন্মার সাথে সাথেই ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে পাবনার সর্বত্র। হয়েছে মানববন্ধন। বিপদে পড়েছে পাবনার আওয়ামী লীগ। এই নাম পরিবর্তনে জেলা আওয়ামী লীগের আদৌ কোন হাত নেই। তাদের অজান্তে কোন এক ব্যক্তির উদ্যোগে এই মহৎ কাজটি হয়েছে। তারা জানেন, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং ট্রেনটির উদ্বোধন করেছেন তখন তার নাম নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই। কারণ তো আসলেই ছিল না।
অনুসন্ধানে জানা গেল রেলওয়ের একজন সাবে জি.এম. যাঁর বাড়ী সুজানগর তিনিই এ কাজটির প্রধান হোতা। তিনি সম্ভবত: আগামী নির্বাচনে বেড়া-সুজানগর এলাকা থেকে সংসদ পদে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে আগ্রহী। ভেবেছেন, সুজানগর তো তাঁর নিজের থানা। এখন বেড়া থানার যে কয়টি ইউনিয়ন ঐ নির্বাচনী এলাকার মধ্যে পড়ে, ঢালার চর তারই একটি ইউনিয়ন। তাই “ঢালার এক্সপ্রেস” যা ঐ এলাকার মানুষেরও কল্পনার বাইরে ছিল-তা দেখে ঐ জি.এম. সাহেবের জনপ্রিয়তা ঐ এলাকায় বেড়ে যাবে। ব্যস, বিনা খরচের দামী উপহার পেয়ে ঐ এলাকার মানুষ সন্ত্রাসীরা সহ হাতে চাঁদ পেয়ে যাবেন।
সেই জি.এম. সাহেব (নাম উল্লেখ করলাম না) তিন চার দিন আগে এক রাত্রিতে কোন এক কাজে পাবনা প্রেসক্লাবে এসেছিলেন। পরিচয় পেয়ে পাবনার সাংবাদিকেরা তাঁর প্রতি উস্মা প্রকাশ করেন। আর পাবনার আওয়ামী লীগ নেতারাও বিষয়টি জানতে পেরে ঐ জি.এম. সাহেবকে সোজা বলে দিয়েছেন, “সাত দিনের মধ্যে যদি “ঢালার চর এক্সপ্রেস” নামকরণের সার্কুলারটি বাদিতল করাতে না পারেন তবে বোঝাপড়া আছে।
বিষাদগ্রস্ত মনে জি.এম. সাহেব বিদায় নিলেন।
এখন প্রশ্ন, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ কি “পাবনা এক্সপ্রেস” নামটি ফিরিয়ে আনতে পারবে? আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে অবশ্য না পারার কিছু নেই। কারণ ব্যাপারটিতো আসলে ক্ষুদ্র।
পাবনাবাসী অপেক্ষায় থাকছেন। সাতদিন শেষ হলে আন্দোলন পুনরায় শুরুর কর্মসূচীও নিচ্ছেন।