পুলিশি হত্যাকাণ্ড
সম্পাদকীয় ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
পুলিশ একজন সুস্থ মানুষকে ধরে নিয়ে গেল। এক বা দু’তিন দিনের মধ্যে তার মৃত্যু হলো। ঘটনাটা স্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ঘটনাটা আবার অস্বাভাবিকও নয়। যদিও বর্তমানে এমন মৃত্যুর ঘটনা খুব বেশি আলোচনায় আসে না। এর কারণ কী, এমন মৃত্যুর সংখ্যা কমে গেছে? নাকি এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু, স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে? মানুষকে আলাদাভাবে আর বিচলিত করে না?
সম্প্রতি আরেকটি মৃত্যু আলোচনায় এসেছে। ছাত্রদল নেতা জাকির হোসেন মিলনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশ হেফাজতে। এ মৃত্যুটিকে কেন্দ্র করে কিছু কথা।
১. বাংলাদেশের পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। ‘পুলিশ মানেই খারাপ’ জনমনে এ রকম ধারণা প্রায় স্থায়ী রূপ নিয়েছে। যদিও বাস্তবতা পুরোপুরি এমন নয়। এই লেখা যখন লিখছি, তখনও বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসারের কথা মনে পড়ছে। তারা নীতি-আদর্শের সঙ্গেই কাজ করছেন। আমাদের জানার বাইরেও নিশ্চয়ই আরও অনেক পুলিশ সদস্য আছেন, যারা ভালো কাজ করছেন। পুলিশ বাহিনীতে ভালোর সংখ্যা বেশি, না খারাপের সংখ্যা বেশি- সেটা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। সেই তর্কে যাব না। কম-বেশি যেদিকেই হোক, খারাপ কাজের দায়ভার নিতে হয় সবাইকে, পুরো পুলিশ বাহিনীকে। এর ভিত্তিতেই পাবলিক পারসেপশন তৈরি হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় পুলিশ বাহিনী যারা পরিচালনা করেন, তারা কোনোদিনই এই পারসেপশন কেন তৈরি হয়, তা নিয়ে ভাবেননি। মুখে কখনো টুকটাক কথা বললেও, কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেননি।
২. আদালতের নির্দেশনা মোটামুটি এ রকম, সাদা পোশাকে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে যেতে পারবে না। এই ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে এর ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটাতে দেখা গেল। ঘটনা ঘটালো পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ। গত ৬ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতর থেকে গ্রেপ্তার করা হলো জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবুকে। শফিউল বারীর নামে মামলা আছে, সেটা যদি হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলাও হয়, পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। বলছি, গ্রেপ্তারে আইনগত কোনো বাধা নেই। পুলিশ প্রেসক্লাবের বাইরে অবস্থান নিয়ে থেকে বের হওয়ার সময় বাবুকে গ্রেপ্তার করতে পারত। এমন কী পোশাক পরিহিত পুলিশ প্রেসক্লাবের ভেতরে ঢুকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভিত্তিতেও গ্রেপ্তার করতে পারত। পুলিশ এসবের কোনো কিছুই করেনি। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ প্রেসক্লাবে ঢুকে পিস্তল-রিভলভার হাতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। বাবুকে অস্ত্রধারী কয়েকজন জাপটে ধরেছে। এটা কি বিএনপির দুই গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, না বাইরে থেকে কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ এসে বাবুর ওপর আক্রমণ করল, বোঝার কোনো উপায় নেই। কেউ কেউ যখন আতঙ্কিত হয়ে হেলমেট ছুড়ে মারতে শুরু করেছে অস্ত্রধারীদের ওপর, তখন তারা চিৎকার করে বলেছেন, ‘আমরা পুলিশ আমরা পুলিশ’।
বাবুকে গ্রেপ্তার করার জন্যে পুলিশ আদালতের নির্দেশ অমান্য করল কেন? বাবু তো এমন কোনো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য না, অস্ত্রধারীদের নিয়েও তিনি প্রেসক্লাবেও আসেননি! তাহলে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে এভাবে গ্রেপ্তার করা হলো কেন?
এই ‘কেন’র উত্তর যদি পুলিশ পরিচালনাকারীরা খুঁজতেন, তাহলে পাবলিক পারসেপশন পরিবর্তন হতে পারত। তা না হয়ে এক্ষেত্রে পারসেপশন তৈরি হয়েছে সরকার বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই, গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা আদালতের নির্দেশ অমান্য করেছেন।
যে দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে আইন না মানার দৃশ্যমান অভিযোগ থাকে, সে দেশে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে না- সেটাই তো স্বাভাবিক।
৩. মানববন্ধন থেকেই ফিরছিলেন ছাত্রদল নেতা জাকির হোসেন মিলন। রমনা থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের গ্রেপ্তার করবে, এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। মামলা বা অভিযোগ না থাকলেও গ্রেপ্তার করে। বহু বছর ধরে এটা চলে আসছে। ফলে জাকিরকে গ্রেপ্তার করায় অবাক হচ্ছি না। অবাক হচ্ছি, ৩ দিনের রিমান্ডের পর চতুর্থ দিন জাকিরের মারা যাওয়া নিয়ে। জাকির সুস্থ, শক্ত সামর্থ্য যুবক। পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর এমন নির্যাতন করল যে, তিনি মারা গেলেন। স্বাভাবিকভাবে পুলিশ বলেছে, তার ওপর কোনো নির্যাতন করা হয়নি। রিমান্ডের পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জাকিরের মৃত্যু হয়েছে। হ্যাঁ, চিকিৎসাধীন অবস্থায় জাকিরের মৃত্যু হয়েছে। একথা অসত্য নয়। পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, জাকিরের হাত-পায়ের বিশটি নখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল? নখগুলো উপড়ে ফেলা অবস্থায় তো পুলিশ জাকিরকে গ্রেপ্তার করেনি। এমন কী হতে পারে, গ্রেপ্তার করার পর জাকির নিজেই নিজের নখগুলো উপড়ে ফেলছে? দেশটির নাম বাংলাদেশ বলেই এমন প্রশ্ন করছি। নিজে যদি নিজের নখ উপড়ে না ফেলে থাকেন, তা হলে উপড়ে ফেলল কে? এই প্রশ্নের জবাব পুলিশের দেওয়ার কথা, দায়ও নেয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে জবাব না দিলে বা দায় না নিলে, কোনো সমস্যা হয় না। আবার জবাব এভাবেও দেয়া যায় যে, ‘পুলিশের হেফাজতে জাকিরের মৃত্যু হয়নি।’ এই জবাবটিই দিয়েছেন পুলিশের আইজি।
৪. জাকির মৃত্যুবরণ করেনি, জাকিরকে পুলিশ পিটিয়ে নিপীড়ন-নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এভাবে হত্যা করা মানুষের শরীরেও ময়নাতদন্তে কোনো দাগ খুঁজে পাওয়া যায় না, বাংলাদেশে এমন ঘটনাও নতুন নয়।
গণমাধ্যমে সংবাদটি এসেছে। খুব গুরুত্ব যে পেয়েছে বলা যাবে না। রাজনৈতিক কলামও লিখেছেন দু’একজন। জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠনগুলো খুব একটা উচ্চবাচ্য করেনি। সম্ভবত সব হত্যাকাণ্ডে তাদের মানবাধিকার আঘাতপ্রাপ্ত হয় না। হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিটির রাজনৈতিক পরিচয় আমাদের মানবাধিকার কারিদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাকিরের পরিচয় বিএনপি-ছাত্রদল। বিএনপি বা ছাত্রদলের একজনকে নিয়ে কথা বললে, জাত চলে যেতে পারে। রাজাকার ট্যাগ লাগতে পারে। কী দরকার এসব ঝামেলায় জড়ানোর!
পুলিশ একজন যুবককে ধরে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলল, হাত-পায়ের নখগুলো উপড়ে ফেলল! তার রাজনৈতিক পরিচিতি বিবেচনায় নিয়ে মানবাধিকার নেতা-নেত্রীরা মৌনব্রত পালন করলেন। তাদের কাছে জাকির একজন মানুষ নন, জাকির একজন ছাত্রদল নেতা। সন্তানহারা জাকিরের মায়ের কান্না, স্ত্রী-সন্তানদের আহাজারি, মানবাধিকারের পাইকারদের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না।
৫. ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩’ করেছিল বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে। বহু ঘটনার পর, অনেক দাবির প্রেক্ষিতে হয়েছিল এ আইন। ১৯৯৮ সালে কলেজ ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল ডিবি পুলিশ। তারও আগে ১৯৯৫ সালে ইয়াসমিন পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের শিকার হয়েছিল। তখন মানবাধিকার কা-ারিরা এমন বোবা বা কালা বা অন্ধ ছিলেন না। দেশ-বিদেশের চাপের প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে আইনটি করা হয়েছিল। তারপর থেকেই পুলিশের পক্ষ থেকে এই আইনটি বাতিলের দাবি জানানো হচ্ছে। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই দাবি জানানো হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী আইনটি বাতিলের দাবি মোটামুটিভাবে নাকচ করে দিয়েছিলেন। একই দাবি বিষয়ে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী সরাসরিভাবে নাকচ করে দেননি।
আইনটি থাকবে কী থাকবে না, সময়েই বোঝা যাবে। তবে আইনটি থাকা বা না থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পুলিশের মানবিকতা বা আচরণে পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তন হবে, যদি রাজনৈতিকভাবে চাওয়া হয়। পুলিশ কী করবে কী করবে না, পুলিশ কীভাবে পরিচালিত হবে, সিদ্ধান্তটা পুলিশের নয়। সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিক সরকারের। সরকার যদি পুলিশনির্ভর না হয়ে জনগণ নির্ভর হয়, তাহলে সিদ্ধান্তে জনমতের প্রতিফলন ঘটতে পারে।
তবে সবকিছু নির্ভর করে সরকারের কাছে জনগণের গুরুত্বের উপর। সরকার যদি মনে করে দেশের মানুষের একটু শান্তিতে, নিরাপদে, আতঙ্কিত না হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তবে উদ্যোগ একরকম হবে। আর যদি সুশাসন নয়, ভয়ের সংস্কৃতিতে রেখেই শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হবে, তবে উদ্যোগ আরেকরকম।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা বা ভয়ের সংস্কৃতি দূর করার কোনো আলামত দৃশ্যমান নয়। সুতরাং…।
লেখক-গোলাম মোর্তোজা, সম্পাদক, সাপ্তাহিক।