প্রেমের প্রলয়
প্রেমের প্রলয়
-মাহবুব এইচ শাহীন
তেরো থেকে উনিশ বছর বয়সে জীবনের প্রেমের মহাপ্রলয় ঘটে। অনেক সময় এই বয়সী কিশোর-কিশোরীরা ভালোবাসার জন্য মা-বাবা, গুরুজন এমনকি সমাজকেও মানে না। তাদের হৃদয়ে সুনামি ঘটে যায়। সে সময় তাদের চোখ দিয়ে শুধু ভালোবাসা দেখে আর মনের গভীরে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে। ভালোবাসার জন্য সমাজ-পরিবার সব ত্যাগ করতে দ্বিধা করে না। তখন চোখের দৃষ্টি দিয়ে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছু দেখে না।
ওই বয়স পার হওয়ার পর ভালোবাসার ভয়ংকর অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ সময় ভালোবাসার জন্য খুন-খারাবি পর্যন্ত করে থাকে। কুড়ি বছর পর প্রেমের সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যৌনতা জড়িয়ে পড়ে। এ সময় যুবক-যুবতীরা প্রেম করার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিলনের জন্য থিসিস শুরু করে দেয়।
মানবজীবন ত্রিশের নিকটে হলে, ভালোবাসায় ভাটির টান লক্ষ্য করা যায় এবং বাস্তবতা মানবজীবনকে গ্রাস করে। শেষমেশ একজন জীবনসঙ্গিনী খুঁজে বিয়ে করে ফেলে। এ সময় প্রেমের আরেক অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটে। তখন প্রেম হয় ক্ষণিক অতিথির মতো। প্রেমের রস ক্ষরণ হয়ে গেলে, সাময়িকভাবে প্রেমচর্চা ঘুমিয়ে পড়ে এবং সময়ে পুনরায় জাগ্রত হয়। এমনি করে নিজ গতিতে চলতে থাকে প্রেমের গাড়ি। বলা যায় বিয়ের পর প্রেমের গতি হয় ধীর গতি।
বয়স যখন প্রৌঢ়ত্বে পড়ে, মানব হৃদয়ে প্রেম শেষ বারের মতো বিশালভাবে দোলা দেয়, যেমনিভাবে দোলা দেয় উঠতি বয়সে। এটি চেরাগ নিভে যাওয়ার আগ মুহূর্তের মতো। চেরাগের আলো নিভে যাওয়ার আগ মুহূর্তে দপ করে একবার বিশাল আলো দিয়ে জ্বলে উঠে নিভে যায়।
প্রৌঢ় বয়সে অনেক মানুষকে আবার একটি বিয়ে করতে মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়। তখনো সে সমাজ মানতে চায় না। এমনকি প্রেমে অন্ধ হয়ে তার দুই চোখের লজ্জার পর্দা উঠে যায়। অনেক সময় মেয়ের বয়সী নারীকে বিয়ে করে প্রেমের ক্ষুধা মিটায়।
প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কে মানুষ যখন খুব বেশি ভালোবাসা পায় তখনই সবচেয়ে সুখী বোধ করে। তবে, বিশ্বখ্যাত কিছু সাইকোঅ্যানালিস্ট থেকে শুরু করে কবি-সাহিত্যিকরা ঠিক উল্টো যুক্তি ও তার ব্যাখ্যা করেছেন। তারা মনে করেন প্রেম-ভালোবাসা মূলত পাওয়ার চেয়ে, দেওয়াতেই প্রকৃত সুখ।
জার্মান সাইকোঅ্যানালিস্ট ও সমাজবিজ্ঞানী এরিক ফ্রম তার ‘দ্য আর্ট অব লাভিং’ বইটিতে প্রেম বিষয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বইটিতে তিনি প্রেমকে একটি আর্ট বা কলা হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, প্রেম যদি বিদ্যা হয় তাহলে অবশ্যই তা শেখার জন্য জ্ঞান ও চর্চার প্রয়োজন। কিন্তু, অধিকাংশ মানুষ একে ভাগ্য বলেই মনে করে।
এরিকের মতে যেহেতু প্রেমের প্রবৃত্তি বর্জন করা সম্ভব না, সেজন্য এই ব্যর্থতা থেকে বাঁচার একটাই উপায়— তা হলো এই ব্যর্থতার কারণগুলো অনুসন্ধান করে প্রেমের অর্থ অনুধাবন করা। আর এর প্রথম উদ্যোগ হলো—এটা বোঝা যে, প্রেম হলো একটি কলাবিশেষ। প্রকৃতভাবে বেঁচে থাকাটাও এক ধরনের কলা বা অনুশীলন। অন্য যেকোনো কলা বিদ্যা শিখতে হলে যেভাবে অনুশীলন করা প্রয়োজন, প্রেমের ক্ষেত্রেও সেইভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।
এরিক বলেছেন, মানুষের গভীরতম চাহিদা হলো তার বিচ্ছিন্নতাবোধের অবসান, তার একাকীত্বের বন্দিশালা থেকে মুক্তি। সব যুগের এবং সব সংস্কৃতির মানুষ এই একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সচেষ্ট— কী করে বিচ্ছিন্নতা জয় করা যায়, কী করে মিলন সাধন করা যায়। নিজের ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন অতিক্রম করে ঐক্যসাধন করা যায়।
এরিকের মতে, অন্য আরেক জনের সঙ্গে প্রেমের মিলনে আবদ্ধ হওয়ার চেয়ে আর কোনো বড় আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে নেই। এটাই মানুষের আদিমতম ক্ষুধা। এটাই মনুষ্যজাতিকে, সম্প্রদায়কে, পরিবার ও সমাজকে একত্রে বেঁধে রেখেছে।
তার মতে, প্রেম মূলত দেওয়ার জিনিস, পাওয়ার জিনিস না। দানের ফলে একটি নতুন ভাব জন্মায় এবং দাতা-গ্রহীতা উভয়ে এই ভাবের মাহাত্মটি উপলব্ধি করে কৃতজ্ঞতাপ্লুত হয়ে ওঠে। প্রেমের ব্যাপারেও—প্রেমদানের মাধ্যমে প্রেমাস্পদের হৃদয়েও প্রেমের উদয় হয়।
বয়স ও মানসিক অবস্থা ভেদে প্রেমের ক্ষেত্রে কয়েকটা নীতির কথাও উল্লেখ করেছেন এরিক ফ্রম। যেমন- শিশুসুলভ প্রেমের নীতি হলো, ‘যেহেতু আমি ভালোবাসা পাই, তাই আমি ভালোবাসি ‘; অপরিণত প্রেমের নীতি হচ্ছে, ‘যেহেতু তোমাকে আমার প্রয়োজন, তাই তোমাকে ভালোবাসি’ আর পরিণত প্রেম বলে, ‘যেহেতু ভালোবাসি, তাই তোমাকে আমার প্রয়োজন’।
তিনি বলেছেন, দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিশ্বাসের অনুশীলন শুরু হয়। তাই প্রথম স্তরে লক্ষ্য রাখতে হবে কখন ও কী অবস্থায় এই বিশ্বাস হারাতে শুরু করে। প্রেম বিশ্বাসের বস্তু, এটি বিশ্বাসে মেলে। যে ব্যক্তির বিশ্বাস যত ছোট, তার প্রেম তত ছোট।
এতোদিন ভেবেছি- প্রেমে আনন্দ ও বেদনা আছে। সত্যিই আনন্দ আছে যা বিমোহিত করে, পাগল করে, মহা আনন্দ দেয় আবার প্রেম যখন চলে যায় তখন জীবনটাকে লন্ড-ভন্ড করে দিয়ে যায়। অর্থাৎ প্রেম মহাপ্রলয়ের মতো এসে মহা আনন্দে ভাসিয়ে নি:স্ব করে রেখে যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতায় লিখেছেন, ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান– গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।