বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বজোড়া সাংবাদিক

 

 

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বজোড়া সাংবাদিক
রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের নানা শক্তির অমূল্য অবদানে সমৃদ্ধ হয়ে মাত্র নয় মাসে বিজয় এনেছিল আজ আমরা যেন তার অনেকটাই ভূলে গেছি। কিন্তু ইতিহাস তো ইতিহাসই। ইতিহাস কথাও কয়-নির্বাক থাকে না। ইতিহাস আবার তখনই কথা কয় – যখন কেউ আমরা ইতিহাস জানতে চাই। এই জানবার আকাংখা থাকলে তবেই আমাদের পক্ষে ইতিহাস সঠিকভাবে জানা সম্ভব হবে।
মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পূর্বাপর ইতিহাস নিয়ে পৃথিবীর কোথাও কোন মতভেদ দেখা যায় বলে শুনি নি। যে দেশের মুক্তিযুদ্ধ সে দেশের মানুষ সে দেশের নানা রাজনৈতিক দল, সকলেরই তার দেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণভাবে একমত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে মতভিন্নতা আজও অনেকটা বিদ্যমান যদিও আমাদের মনে হয়।
ইতিহাস নিয়ে যদি আমরা কেউ বাড়াবাড়ি না করি মুক্তিযুদ্ধকে আমরা দলীয় করণ না করি তবে মতাভিন্নতা বা মতদ্বেধতা কমে আমরা প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়।
১৯৭১ এ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিরাজমান ভয়াবহ পরিস্থিতির ইতিহাস আমাদের কাছে অনেকটাই অজানা থাকার কথা ছিল কিন্তু তা থাকে নি দেশী-বিদেশী হাজার হাজার সাংবাদিকের দু:সাহসী সাংবাদিকতার কারণে। বাংলাদেশে ঐ নয়টি মাস আক্ষরিক অর্থেই ছিল অবরুদ্ধ। ঢাকা ও জেলাগুলি থেকে যে সকল দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ব্যক্তি মালিকানাধীনে প্রকাশিত হতো-তার প্রকাশনা এতটাই দুরূহ এবং পাক-সেনা নিয়ন্ত্রিত ছিল যে অনেকগুলি পত্রিকা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যে পত্রিকাগুলি বের হতো সেগুলি কঠোর নিয়ন্ত্রণ থেকেই বের করতে হতো। তাই পাক-সেনা বাহিনীর অত্যাচার নির্য্যাতনের এবং মুক্তিসেনাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই এর খবর সেগুলিতে আদৌ প্রকাশ করা যেত না।
ঐ সংবাদপত্রগুলি মূলত: সরকার যে যে খবর যেভাবে প্রকাশের অনুমতি দিত শুধুমাত্র সেগুলিই প্রকাশ করতে হতো। ইত্তেফাকের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক শহীদ সিরাজউদ্দিন হোসেন একদিনকার পত্রিকায় কৌশলে মুক্তিবাহিনীর একটি খবর ছোট করে প্রকাশ করলেও কার জন্যে তা হলো গোপনে সেই খবর জেনে সিরাজউদ্দিন হোসেনকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সামান্য কিছু দিন আগে তাঁর বাসা থেকৈ চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর দেহের অনুসন্ধান করেও পরে আর তা খুঁজে পাওয়া যায় নি। পাক-বাহিনীর বর্বরতা ছিল এমনই।
এমন ধরনের অত্যাচার, নির্য্যাতন ও নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে জীবন রক্ষা করা ও দেশের অভ্যন্তর থেকে খবর সংগ্রহ করে তা প্রকাশ করার ব্রত নিয়ে সারা দেশের বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সেখানে গিয়ে কিছু সংখ্যক যুক্ত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। বাদবাকী অনেকেই কোলকাতা থেকে অনেকগুলি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র নিয়মিত প্রকাশ করে সংগ্রহীত তথ্যাদি প্রকাশ করে পাকিস্তানী দেশের অভ্যন্তরে পাঠাতেন।
ঐ খবরগুলি থেকে একটি অংশ নিয়মিত প্রকাশ করতো আকাশবানী। আকাশবানীতে এই খবরগুলি প্রকাশে নিষ্ঠা ও দায়িত্বের সাথে উদ্যোগী ছিলেন পাবনার সন্তান প্রণবেশ সেন।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিকামী কোটি কোটি মানুষের সর্বাধিক প্রিয় সংবাদ মাধ্যম ১৯৭১ এর নয় মাস ব্যাপী ছিল আকাশবাণী ও বি.বি.সি। অন্য সময়ে সম্ভব না হলেও সন্ধ্যার পরে দল বেঁধে গোপনে ঝোপ জঙ্গলে কোথাও ট্রাসনজিষ্টার রেডিও নিয়ে গিয়ে সকলে এই খবর শুনতেন। শব্দ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ঘরে অথবা কোন কোন চায়ের ষ্টলেও এমন খবর শুনবার ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ।
২৫ মার্চের ভয়াল রাতে পাক-বাহিনী যখন ঢাকার ঘুমন্ত নিরস্ত্র জনতার উপর বর্বর আক্রমণ চালাতে শুরু করে, আক্ষরিক অর্থেই দেশটি তখন হয়ে পড়ে অবরুদ্ধ। ঢাকা হয়ে পড়ে সারা দেশে থেকে বিচ্ছিন্ন। ঐ রাতের অন্ধকারে তথাকথিত “অপারেশন সার্চলাইট” এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলিতে ঘুমন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর, পীলখানার ই.পি.আর সদর দফতর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নৃসংস বর্বরতার সাথে পাক-সেনারা অতর্কিতে গোলা নিক্ষেপ করে অসংখ্য বাঙালীকে হত্যা করে তার নজির সম্ভবত: হিটলারের জামানী বাদ দিলে পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
তখন ঢাকা সমগ্র বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পড়েছিল একথা আগেই বলেছি। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল গোটা পৃথিবী।
কিন্তু তার পরেও পৃথিবীময় বাংলাদেশের পাক-বাহিনীর নির্মম গণহত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসলীলা, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ, শরনার্থী শিবিরের বর্ণনা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহের বিবরণ গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছিল। আর স্থান পাওয়া সম্ভব হয়েছিল অসংখ দেশী-বিদেশী দুঃসাহসী সাংবাদিকদের নিষ্ঠাবান সাংবাদিকতার করণে।
২৫ মার্চ রাতে পাক-সেনারা যখন রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে সময়ে “অবরুদ্ধ বাংলাদেশ কণ্ঠরুদ্ধ সংবাদপত্র এই ব্যানারে শিরোনাম প্রস্তুত করেছিল “দ্যা পিপল” কিন্তু সে রাতেই পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হয়ে “দ্য পিপল” অফিসের দু’জন সাংবাদিক নিহত হন। এ ছাড়া ২৬ মার্চ ইত্তেফাক এবং ২৮ মার্চ সংবাদ অফিসও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সংবাদ অফিসে শহীদ সাবের নিহত হন। অলিখিতভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সংবাদপত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ করে।
ঢাকার ভেতরে সাংবাদিকেরা যেমন মুক্তিযুদ্ধেগৌরবময় অবদান রেখেছেন,তেমনই ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরাও সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে সংহত ও বিস্তৃত করার কাজে। পাক-বাহিনী যেহেতু একবারে সব জেলায় আক্রমন সুরু করতে পারে নি তাই ঢাকার বাইরের অনেক জেলা একাত্তরের মার্চের পরেও কয়েকমাস মুক্ত ছিল? এসব মুক্ত জেলা এবং মুজিবনগর থেকে মে মাসে অনেক পত্র-পত্রিকা বেরিয়েছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে এসব মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে এই পত্রিকাগুলি অসামান্য অবদান রেখেছে। আর রেখেছে স্বাধীন বাংলা বেতার।
যুদ্ধে অংশগ্রহনের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধারা এসব পত্রিকাকে তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করতো। মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলি হলো, জয় বাংলা, বাংলাদেশ, বিশ্ববানী, মুক্তিযুদ্ধ জন্মভূমি বাংরার বানী, নতুন বাংলা, মুক্ত বাংলা, দাবানল, সংগ্রামী বাংলা, অগ্রদূত, স্বাধীন বাংলা, আমার দেশ, অভিযান, দি নেশন, স্বদেশ, সোনার বাংলা, সাপ্তাহিক একতা, সাপ্তাহিক বাংলার মুখ, সাপ্তাহিক আমার দেশ, পক্ষিক অক্ষৌহিনী, পাক্ষিক স্বদেশ, দর্পণ, ওরা দুর্জয় দুর্বার, কালান্তর প্রভৃতি।
অপরদিকে, একাত্তরের গণহত্যার চিত্র যাতে বিশ্ববাসী জানতে না পারে, সে লক্ষ্যেপাকিস্তানী বাহিনী বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিল। বন্দুকের মুখে যখন বিদেশী সাংবাদিকদের হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আটক করা হচ্ছিল, সায়মন ও এসোসিয়েটেড প্রেসের আলোক চিত্রী মাইকেরল লরেষ্ট হোটেলের ছাদে গিয়ে তাৎক্ষণিক বহিস্কারের হাতা থেকে রেহাই পান। তাঁরা দুই দিন অগ্নিদগ্ধ শহরের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেন এবং শহরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষত-বিক্ত লশের ছবি তোলেন। তল্লাশির হাত থেকে নানা কৌশলে সায়মন ড্রিং তাঁর নোটবইটি রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পরে করাচী হয়ে ব্যাংককে এসে সেনাবাহিনীর ভয়াবহ কর্মকান্ডের বিবরণ পাঠাতে সুরু করেন।
ডেইলি টেলিগাফ তার ৩০ মার্চ সংখ্যায় সায়মন ড্রিং এর “ট্যাংকস ক্রাশ বিভোল্টস ইন পাকিস্তান” শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। ফলে সারা বিশ্ব বিশদভাবে জানতে পারে বাংলাদেশে কি ঘটছে। ৫ এপ্রিল নিউজ উইক এ প্রকাশিত হয় দীর্ঘ প্রতিবেদন “পাকিস্তান প্লাঞ্জেস ইনটু সিভিল ওয়ার”, ১২ এপ্রিল ট্টামি ম্যাগাজিন পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ ও গণকাবরের বিবরণ প্রকাশ করে। ১৯ এপ্রিল নিকোলাস টোয়ালিন ডেইলি টেলিগ্রাফ এ লেখেন “ফার ফ্রাম দ্য হলোকাষ্ট”।
ভারতের দিল্লী ভিত্তিক দৈনিক গুলিসহ সব রাজ্যের পত্র-পত্রিকায় প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার ও গণনির্য্যাতন। ভারতের যে সকল সাংবাদিক নিরলসভাবে বাংলাদেশে পাক-বাহিনীর বর্বরতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কার্য্যকলাপ সম্পর্কে জাগ্রত প্রহরীর মত বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন তাঁদের মধ্যে মানস ঘোষ, প্রণবেস সেন, তুষার পন্ডিত, মনোজমিত্র, অমূল্য গাঙ্গুলি, আশীষ চক্রবর্তী, অনিল ভট্টাচায্য, বরুন সেনগুপ্ত, সুভাষ চক্রবর্তী, কিরীট ভৌমিক, মানিক চৌধুরী, উপেন তরফাদার, মুনৎ মুখার্জী, দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য,
বিদেশী পত্রিকাগুলির মধ্যে ভারতের ষ্টেটসম্যান, অমৃতবাজার, যুগান্তর, আনন্দবাজার সহ সকল দৈনিক, সাপ্তাহিক ও অন্যান্য পত্রিকাই নিজেরদের মুক্তিযুদ্ধের মত করেই মুক্তিযুদ্ধের খবর ও মতামত প্রকাশ করেছেন। বাইরের ইউরোপীয় ও অন্যান্য দেশের পত্রিকায় বিশেষ করে “সানডে টাইমস,” “দ্য টাইম,” “দ্যা ডেইলি াটেলিগ্রাফ, “মৈশ্চী ডেইলি নিউজ,” “ওয়াশিংটন পোষ্ট,” “ দ্য ফিলান্সিয়ান টাইমস,” “ইষ্টার ন্যাশনাল হেরাল্ড টিবিউন প্রভৃতি পত্রিকাও অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের খবর নিয়মিতভাবে তুলে ধরে বিশ্ববাসীর সক্রিয় সমর্থন আদায়ে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন।
এগুলিই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভে বহুদূর অগ্রসর করে দিয়েছিল।


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।


কাগজ টুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!