বাংলা সাহিত্যের “শ্রেষ্ঠ মৌলিক বাংলা কবিতা”র সন্ধানে
প্রবন্ধ : বাংলা সাহিত্যের “শ্রেষ্ঠ মৌলিক বাংলা কবিতা”র সন্ধানে ।
– সাকিব জামাল
বাংলা সাহিত্যের মৌলিকত্ব কতোটুকু ? প্রশ্নটি আমার মত ক্ষুদ্র পাঠকের পক্ষে তোলা আদৌ সমীচীন কিনা ! তবুও তুলতে হচ্ছে কারন আমার স্বপ্ন বড় । বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমি বড় বড় স্বপ্ন দেখি । স্বপ্ন দেখি বিশ্ব সাহিত্যের বৈচিত্র্যময় পথে বাংলা সাহিত্য নেতৃত্ব দিবে । সেটি সম্ভব? সম্ভব হলে- কিভাবে সেই নেতৃত্ব আমাদের ছিনিয়ে আনতে হবে ?
বিশ্বজুড়ে কোন সাহিত্য, সংস্কৃতির “মৌলিকত্ব” হচ্ছে ঐ সাহিত্য নেতৃত্ব কতোটুকু দিতে সক্ষম – তার পরিমাপক । সব দেশের সাহিত্যিক তাই তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখার চেস্টা করেন । তথ্য প্রবাহের অবাধ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কাজটি ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে । কবি সাহিত্যিকদের লেখায় নতুনত্ব, অভিনবত্ব সৃষ্টি করা অসম্ভবরকম চিন্তার কারন হয়ে দাড়িয়েছে ।
আমাদের কি অবস্থা ? আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস কি বলে ? – বিষয়টি ব্যাপক গবেষণার । গবেষণা সাহিত্য নিয়ে, সাহিত্যিকদের নিয়ে হতেই হবে । এখানে আমরা মোটাদাগে পিছিয়ে আছি । যাহোক, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং যুগ বিন্যাস এর দিকে আমরা যদি অল্প-বিস্তর তাকাই তাহলে আমি দৈন্যরূপ দেখি মৌলিকত্বের ! আমার এই মতের সাথে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন এবং এটিই স্বাভাবিক । বিতর্কও সাহিত্যকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে ।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – চর্যাপদ থেকে শুরু যা প্রায় সর্বজন স্বীকৃত । এটি প্রাচীন যুগ। এরপর মধ্যযুগ যার বিস্তার ১২০০- ১৮০০ খ্রি: পর্যন্ত । এরপর১৮০১ সাল থেকে বর্তমান সময়কাল কে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ বলা হয়। প্রাচীন যুগ নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই এবং বর্তমানে বিশ্বনেতৃত্ব দিতে তা আমলযোগ্য সময়ও নয় ।
মধ্যযুগের সাহিত্যধারা ছিল দেবদেবী নির্ভর বা ধর্মনির্ভর। দেবদেবীর গুণকীর্তন করাই ছিল এই যুগের সাহিত্যের উদ্দেশ্য। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। যেমন – মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ সাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলী, জীবনী সাহিত্য, নাথ সাহিত্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ইত্যাদি। মধ্যযুগে বেশিরভাগ হিন্দু কবিগন তাদের ধর্মগ্রন্থ নির্ভর কবিতা রচনা করেছেন । যেহেতু সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে তেমন বিস্তারিত ছিলোনা সংগতভাবেই তা এই অঞ্চলের মৌলিক সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা যায় । পক্ষান্তরে এই সময়ের মুসলীম কবিগন পারস্য নির্ভর সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন । তারা বলতে গেলে অনুবাদ নির্ভর প্রণয়কাব্য বেশি রচনা করেছেন । তাই এটিকে “মৌলিকত্ব” সমৃদ্ধ সাহিত্য বলা যায়না এক অর্থে ! সুতরাং, মধ্যযুগের কবিতার প্রায় অর্ধেকাংশ মৌলিকত্ব দৈন্যতার রূপ ।
আধুনিক বাংলা কবিতা এর সময়কাল মোটামুটি ১৮০০ সাল থেকে শুরু ধরা হয়ে থাকে । এখানে যে পরিবর্তনটি লক্ষ্যনীয় তা হলো মধ্যুযুগে মুসলিম কবিদের পারস্য নির্ভর সাহিত্যচর্চার ক্ষয়িষ্ণু রূপ তবে তা যে পথে মোড় নেয় তাও অনুবাদ ভাবধারারই – ইংরেজি সাহিত্যের ছোঁয়া ।এখানেও মৌলিকত্বের অভাব থেকে গেলো । এরপর আর্ভিভুত হন মৌলিকত্ব নিয়ে বাংলা সাহিত্যের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে নতুনত্ব উপহার দেন । তাকে ঘিরেই একটি বলয় গড়ে ওঠে ।এই সময়টুকুই বাংলা সাহিত্যের মৌলিকত্ব বিবেচনাও সেরা যুগ । তবে এই সময়ে রবীন্দ্রভাবধারার বাইরে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে নতুনত্ব এবং মৌলিকত্ব দুটোই উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন ।
রবীন্দ্রবলয় ভেঙ্গে এরপর পঞ্চপান্ডব কবিগন দুর্দান্ত প্রভাবে আত্মপ্রকাশের চেস্টা করেন । কবিতার আধুনিকায়নে তারা শাক্তিশালী ভুমিকা রাখতে সক্ষম হন । এখানে একটু পুনরায় উল্লেখ করতে চাই আমার আলোচনার বিষয় কবিতার “মৌলিকত্ব”। তাই পঞ্চপান্ডবের কবিতার আধুনিকায়নে ভুমিকার পাশাপাশি তাদের মৌলিকত্ব আলোচনার দাবী রাখে । ত্রিশ দশকের কবিতায় বিষয়বস্তর ক্ষেত্রে যেমন নূতন এক অভিনবত্ব এসেছে তেমনি কাব্যশৈলীর ক্ষেত্রেও অপরিমেয় বৈচিত্র এনেছেন তরুণ এ সমস্ত কবি তাঁদের সৃজনশীলতায় – তবে মন ও মানসে রবীন্দ্র চেতনার দুর্দমনীয় প্রভাব অস্বীকার ও নিজস্ব কাব্যরীতি অনুসরনরত ও পাঁচ মহৎপ্রাণ কবি (পঞ্চপান্ডব) ছিলেন ইংরেজী সাহিত্যালোকেরই নাগরিক ! তাদের কবিতায় প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু তারা যেহেতু ইংরেজি কবিতার অনুকরণ বেশি করেছেন – তাই বাংলা সাহিত্যের মৌলিকত্ব একটু রবীন্দ্রযুগ থেকে এই যুগে কমেছে বললে ভুল হবেনা বোধহয় !
এখানে দুজন কবিকে স্মরণ করা উচিত একজন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং অন্যজন কবি ফররুখ আহমদ । এই দুই কবি রাজনীতি কবিতায় ভিন্নমাত্রা দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হন । দুজন আবার রাজনৈতিকভাবে দুই মেরুতে অবস্থান করেছেন । তবে মানবিক কবিতা, অধিকারের কবিতা তাদের হাতে কন্ঠ খুজে পেয়েছিল – এই বিবেচনায় তাদের কবিতাও নতুনত্ব এবং মৌলিকত্ব বহন করে কম-বেশি । আরও একটি ধারা যা কবি জসিম উদ্দীন এবং বন্দে আলী মিয়া আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন – গ্রাম বাংলার কবিতা : এটিও বেশ মৌলিকত্ব বহন করে বাংলা সাহিত্যে ।
এরপর কবিতার উৎকর্ষ হয়েছে নাকি স্থির অবস্থায় আছে বিষয়টি অমীমাংসিত । তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি অবশ্যই কবিতা উৎকর্ষতা লাভ করেছে তবে মৌলিকত্ব খুব একটি বাড়েনি ! কারন এরপরের কবিগন – কেউ রবীন্দ্র , কেউ নজরুল, কেউ জীবনানন্দ, কেউ সুকান্ত, কেউ ফররুখকে অনুসরন করে এগিয়েছেন ।
এখন একটু উত্তরাধুনিকে তাকাই । অনেকে বলেন – এটি কোন যুগই নয় । এটি অধুনিক যুগেরই বর্ধিত সময় । আবার কেউ এটিকে সতন্ত্র যুগ বিন্যাস হিসেবেই দেখেন ।তবে অনেকে একমত নাও হতে পারেন – আমার মতে এই যুগবিন্যাসটি এখনো বাংলা সাহিত্যে শৈশবকালে আছে । উত্তরাধুনিক কবিতা এর বিচার করেন পাঠকেরা । এই যুগে এক কবি অন্য কবিকে বিচার দায়ভার থেকে নিস্কৃতি পান অথবা ক্ষমতা হারান । এই সময়টিই আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এই সময়ে বাংলা সহিত্যের অনেক কবিই পান্ডিত্য দেখাতে পেরেছেন । কবিতায় নতুন নতুন উপকরণ যোগ করেছেন । আবার অনেকে তিরিশ দশকের কবিদের দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত হয়েছেন । কবিতাকে এরা সাধারন পাঠকের জন্য দুরহ করে দিয়েছেন ! তবে মৌলিকত্ব অন্য সাহিত্যের সাথে তুলনামূলক খুব একটি চোখে পড়ার মত নয় । এই যুগের কবিদের মধ্যে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পাওয়া কবির সংখ্যা নেহাত কম ।
যাহোক, মূল বিষয়ে আলোকপাত করলে দেখা যায় – মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য এবং অন্যান্য কিছু ধর্মীয় কবিতা মৌলিক বাংলা কবিতা । আধুনিক যুগের রবীন্দ্র-নজরুল এর কবিতাও অধিকাংশ মৌলিক । তারপরে নতুনত্ব এসেছে মৌলিকত্ব কমেছে ! এতটুকু যুগবিন্যাসের প্রেক্ষিতে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষন ।
অন্যআঙ্গিকে অর্থাৎ কবিতারধারা অনুসারে- গীতিকাসমূহ, পুথি কবিতা, মরমী গানের কবিতা, বিভিন্ন আঞ্চলিক কবিতাগুলো প্রায় শতভাগ মৌলিকত্ব ধারণ করে ।
সুতরাং বাংলা কবিতার ইতিহাস বিবেচনায় বাংলা কবিতার মৌলিকত্ব খুব একটা কম না হলেও আরও বেশি হবার দাবী রাখে । এই বিষয়ে আমাদের গবেষনাধর্মী মন নিয়ে সাহিত্য সাধনা করতে হবে । নতুন এবং মৌলিক বিষয় বৈজ্ঞানিকদের মত নিরলস ভাবতে হবে । নতুন ধারা উদ্ভাবন মৌলিকত্ব নিশ্চিত করে । এমনকি যদি আমাদের কোন কবি বিশ্ব সাহিত্যে অনুপস্থিত এমন কোন ধারা আবিস্কার করতে সক্ষম হন তা হবে শ্রেষ্ঠ মৌলিক বাংলা কবিতা…