দিনাজপুরে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের রেকর্ড ভঙ্গ।
ভূপেন্দ্র নাথ রায়, খানসামা(দিনাজপুর) প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
দিনাজপুরে বিদ্যুতের রেকর্ডসম লোডশেডিং ও ভ্যাপসা গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত। গত ১০-১৫দিন যাবত বৈরি হাওয়া এবং বৈশাখী ঝড়ের কারনে বিদ্যুৎ বিভ্রাট চরমে উঠেছে। এর উপরে হঠাৎ ভ্যাপসা গরম ও প্রচন্ড রোদে শিল্প-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় প্রভাব পড়েছে। কোল্ড ষ্টোরেজ গুলোতে রক্ষিত পন্য, বীজ হুমকির মুখে। সেখানে ডিজেল চালিত জেনারেটর দিয়ে এত দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ আর্থিকভাবে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দিনাজপুর, দশমাইল জাহানারা কোল্ড স্টোরেজের মানেজারের সাথে কথা হলে তিনি জানান, এবছর চাষীদের বীজ সংরক্ষণ ছিল উল্লেখযোগ্য। বিদ্যুৎ না থাকায় এখন ঠিকমতো মেশিন চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বীজ সঠিক মাত্রায় হিমে রাখা হুমকির মুখে। কিছু বীজ গরম আবহাওয়ায় নষ্টের পথে।
অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলো চরম বিপাকে পড়েছে এবং বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম এগুলোর প্রতিদিনের উৎপাদন। কর্মচারীদের বসিয়ে রেখে লোকসান গুনতে হচ্ছে শিল্প কলকারখানা গুলোকে। বিশেষ করে দিনাজপুরের একমাত্র বড় শিল্প চালকল গুলোতে উৎপাদন মারাত্বক ভাবে ব্যহত হচ্ছে। ধারনা করা হচ্ছে, সামনে পবিত্র রমজান মাসে এই লোড শেডিংয়ের কারনে চালের দাম কেজি প্রতি ৩ থেকে ৪ টাকা বৃদ্ধি পেতে পারে। সরেজমিনে দেখা যায়, কেজি প্রতি চাল দুই থেকে তিন টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রানীরবন্দরে এক ক্রেতার সাথে কথা হয়, তিনি বলেন, গত সপ্তাহে চিড়া ভাজার কেজি ছিল ৬০ টাকা। আজ ভাজা চিড়া কিনলাম ৬৫ টাকায়। দোকানদারকে বেশী টাকার কথা জিজ্ঞেস করলে সে মোকামের কথা বলেন যে ঠিকমতো বিদ্যুত না থাকার কারনে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন হচ্ছে না।
এ দিকে পাকেরহাট সমিল কারখানার শ্রমিকরা বলেন বিদ্যুত না থাকার কারনে তাদের সারা দিন বসে থাকতে হচ্ছে। সারাদিন মিলে তারা ৫০ সেফটি কাঠ চিড়তে পারছে না। ফলে মালিককে টাকা দেয়া দূরের থাক ৪/৫ জন শ্রমিকের দিন মজুরি পাচ্ছে না। অথচ, সারাদিন প্রচন্ড গরমে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তাদের পেশা বদল ছাড়া উপায় থাকবে না।
কথা হয় চিরিরবন্দরের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের সাথে। তারা বলেন, প্রতিদিন ২৪ ঘন্টায় গড়ে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা। প্রচন্ড দাবদাহ গরমে তাদের ক্লাস করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া সন্ধা বেলা বিদ্যুৎবিহীন কোন ক্রমে পড়ালেখা করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের পড়া প্রস্তুত না হওয়ার ফলে প্রতিদিন শিক্ষকের বকা খেতে হচ্ছে।
খানসামার কম্পিউটার কম্পোজের দোকান গুলো শুধু খোলাই রয়েছে। কোন কাস্টমার আসলে জিঞ্জাসা না করেই কেটে পড়ছে। এ ব্যাপারে কথা হয় তুলশী রায়ের সাথে। সে বলে, অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারনে তার দুইটি কম্পিউটারই পড়ে আছে। যদিও আইপিএস আছে কিন্তু বিদ্যুত না থাকার কারনে তা কোন ব্যাক-আপ দিচ্ছে না। কথা হয়, প্রিয়নাথ বাবুর সাথে। তিনি বলেন, তার ল্যাপটপ দুই ঘন্টা ব্যাক-আপ দেয় এবং বিদ্যুৎ না থাকলেও গ্রাহকের জরুরী কাজ করে দেন। কিন্তু গত দুইদিন যাবত বিদ্যুত বিপর্যয়ের কারনে ল্যাপটপ চালুই করতে পারছে না। এ কারনে এক প্রকার বাধ্য হয়েই এর পাশাপাশি ফ্লেক্সিলোড চালিয়ে যাচ্ছেন। খবর নিয়ে জানা যায় অন্য উপজেলার চালচিত্র প্রায় একই। বিদ্যুৎ না থাকার কারনে কেউ কেউ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বাড়িতে বসে আছেন। দিনাজপুর জেলার খোদ কাচারীতে কম্পিউটার অপারেটররা খোশ গল্প কিংবা এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
এদিকে কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে কথা হলে তারা জানান, বিদ্যুত ভোগান্তির কারনে তারা পত্রিকায় নিউজ প্রেরণ করতে পারছেন না।
কম দুরত্বের জনপ্রিয় যানবাহন ব্যাটারী চালিত ভ্যান, অটো রিক্সার অবস্থা আরো শোচনীয়। এগুলো রিচার্জ করতে কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। রেকর্ড পরিমাণ লোডশেডিংয়ের কারনে তারা ভ্যান রাস্তায় নামাতে পারছেনা। কোন কোন অটো রাস্তায় চললেও যাত্রীর কাছে দ্বিগুন ভাড়া নেওয়া অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে হাসপাতাল, ক্লিনিক গুলোর অবস্থা আরো ভয়ঙ্কর। বিদ্যুত বিহীন রোগী এবং তাদের পরিজন চারদেয়ালে ছটফট করছে বন্দী আসামীর মতো। রাতের বেলা সৌর বিদ্যুৎ কিংবা জেনারেটর থাকলেও ভ্যাপসা গরমে ফ্যান চলছে না। এই লোডশেডিং বিশেষ করে শিশুদের জন্য মারাত্বক বিপদজনক হয়ে পড়েছে। ভ্যাপসা গরমে সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
গত ২২ মে সন্ধায় কাল বৈশাখি ঝড়ের কারনে সারারাত বিদ্যুৎ ছিল না। ২৩ মে বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করা হলে, অফিস জানায় কিছু কিছু স্থানে লাইনের সমস্যা হওয়ায় মেরামত চলছে। ঐ দিন খানসামায় গড়ে দুইঘন্টাও বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধা ৮ টায় দিনাজপুর পল্লীবিদ্যুৎ অফিসে ফোন করলে এজিএম জানান, দিনাজপুরে মোট বিদ্যুতের চাহিদা ৪৩ মেগওয়াট। সেখানে সর্বোচ্চ যোগান পাচ্ছে মাত্র ১৯ থেকে ২০ মেগওয়াট। চিরিবন্দরের রানীরবন্দর পল্লী বিদ্যুতে খোজ নিয়ে জানা যায়, তাদের প্রাপ্য বিদ্যুৎ ১১.৫-১২ মেগওয়াট কিন্তু তারা পাচ্ছে ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৪ মেগওয়াট। এই অল্প পরিমাণ বিদ্যুৎ দিয়ে চাহিদা পূরণ আসলেই খুব কষ্টকর। তাই বাধ্য হয়েই সুসমভাবে অল্প পরিমাণে চিরিরবন্দর ও খানসামায় বিদ্যুৎ দেয়া হচ্ছে।
বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ আরো জানান, মান্ধাতা আমলের সামগ্রী এখনো বিদ্যুৎ লাইনে চলছে। এসব সামগ্রীর কোন স্থায়িত্ব নাই। ফলে সামান্য ঝড় বৃষ্টিতে চরম ভাবে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে। বিদ্যুৎ লাইনে ব্যবহৃত সকল সামগ্রী পরিবর্তন করা ছাড়া বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না। লাইনে নতুন আধুনিক সামগ্রী সংযোজন না করলে বিদ্যুৎ বিভাগের কিছুই করার থাকবে না। দীর্ঘ দিনের পুরাতন যন্ত্রপাতি সামান্য ঝড়েই নষ্ট হয়ে যায় ও অথবা পুড়ে যায়। বর্তমানে দেশের প্রতিটিক্ষেত্রে আধুনিকায়ন করা হলেও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগেনি। ফলে বিদ্যুতের ঘন ঘন বিপর্যয় ঘটেই চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যে চরম বিপর্যয় ঘটার আশংকা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এছাড়া বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
সাধারণ মানুষ মনে করেন ডিজিটাল বাংলাদেশে যখন আধুনিকায়নের হাতছানি ঠিক তখনি ডিজিটাল যুগের ভিত ও অত্যাবশ্যকীয় বিদ্যুতের চরম বিপর্যয়। এ যেন বাংলাদেশ আধুনিকায়নে এক বড় অন্তরায়। এ সমস্যার যুগোপযোগী ও টেকসই সমাধান করা না হলে বঙ্গবন্ধুর ডিজিটাল সোনার বাংলা করার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
- কাগজটুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।