বিপ্লবী চার সহযোদ্ধা স্মরণে
বিপ্লবী চার সহযোদ্ধা স্মরণে
রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
এডভোকেট হরিসাধন দেবব্রহ্ম নামক দরিদ্রজনদের বিশ্বস্ত বন্ধুকে কিছুদিন হলো আমরা হারিয়েছি। তিনি হলেন চট্টগ্রামর সন্তান, যোগ্য সন্তান এযুগের। আমাদের সকলের অহংকার। হরিসাধনকে ভুলে যাওয়া তো দূরের কথা, ভুলে থাকাও অত্যন্ত দুরূহ।
পেশায় হরিসাধন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। সে হিসেবে গভীর ঘনিষ্ঠতা ছিল বাংলাদেশের জীবিত দিকপাল আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিষ্টার আমীর-উল-ইসলামের সাথে। এ দুইজনের চেম্বারে হরিসাধন যেতেন ঐ আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নয়। আইনের সাহায্য নিতে নানা কারণে অক্ষম মানুষদের জন্য আইনী সাহায্য চাইতে। তাঁরাও অক্লান্তভাবে দাঁড়াতেন হরিসাধনের পাশে। এই দরিদ্রজনদের মামলার ব্যয় নির্বাহ করতে অক্ষম মানুষদের কোর্ট ফি, দরখাস্ত টাইপ করা থেকে খুঁটিনাটি যা ন্যূনতমভাবে একটি মামলা শুরু করতে প্রয়োজন তাও বহন করতে অক্ষম জানলে যেভাবেই হোক তা সংগ্রহ করে মামলা দায়ের করতেন হরিসাধন এবং শেষ পর্য্যন্ত তা পরিচালনা করে দরিদ্র আইন সাহায্য প্রার্থীর আইনী বিজয় নিশ্চিত করতে শতভাগ সৎপথে থেকে পরিশ্রম করতেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যাবত।
কিন্তু আইনজীবী হরিসাধন যত বড় তার চাইতে অনেক বড় তার দেশ প্রেম, মানবপ্রেম। পরিপূর্ণ আত্মপ্রচার বিমুখ হরিসাধনের সাথে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কার্য্যালয়ে প্রথম পরিচয়। বেশ অনেক দিন আগের কথা। হঠাৎ একদিন হরিসাধন বলে বসলেন, “রণেশ দা, আপনার জেলায় কি পান চাষ হয়? বললামঅবশ্যই হয়-কিন্তু কেন? পান চাষীদের অনেক সমস্যা-আছে। সরকার সমস্যাগুলির সমাধান করছে না। তাই পানচাষী সমিতির পাবনা জেলা শাখা খুলতে তাদের সাথে চাক্ষুষ আলোচনা করতে চাই। বললাম, “তথাস্তু”।
হঠাৎ একদিন পেয়ে গেলাম হরিসাধনের চিঠি। তাতে দিন তারিখ উল্লেখ করে ঐ দিন সীমিত আকারে পাবনা জেলা পাট চাষ সমাবেশের আয়োজন করতে অনুরোধ জানিয়েছে সে অনুযায়ী আয়োজনও করা হলো। কৃষক সমিতি নেতাদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কারণ এঁটা তাদেরও কাজে। পান চাষীরাও তো এক অর্থে কৃষক জমিতে পাতা জন্মায়-সেই পাতাকে আমরা পানপাতা বলি। দেশে-বিদেশে তার বিপুল চাহিদা।
যা হোক, কৃষক সমিতির কেউ এলেন না। দু’তিন ঘন্টা আলোচনার পর পান চাষী সমিতির পাবনা জেলা কমিটি গঠন করে কমিটিকে কিছু দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কিছুদিন কিছু সাংগঠনিক কাজকর্ম চালানো পর সমিতি কেন্দ্রীয় জেলা পর্য্যায়ে মূলত: অচল হয়ে পড়ায় সংগঠনটির অনানুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘটলো মূলত: কর্মী অভাবে।
কিন্তু হরিসাধন নিরুৎসাহিত হন না। চির আশাবাদী হরিসাধন বিত্তহীন, নিম্নেবিত্তদের সংগঠন না থাকলে নিজ উদ্যোগে নানা সংগঠন গড়ে তুলতেন। সংগঠনের আর্থিক সমস্যা নিজের পকেট থেকেই মেটাতেন ছোটখাট ব্যাপারে যদি প্রয়োজনীয় কয়েকটি টাকা নিজ পকেটে থাকে। না হলে সহানুভূতিশীলদের কাছে হাত পাততেন। ওকালতিতে নিজের সামান্য রোজগারের পূরো টাকাটাই এসব কাজে ব্যয় করতেন গরীবের স্বার্থে। ফলে সংসার হতো মারাত্মকভাবে বঞ্চিত। হয়তো বা উপার্জনের টাকা গরীবের কাজে ব্যয় করে বাসায় এসে অভূক্ত স্ত্রীসহ পূরো সংসারটাই অনাহারে রাত কাটাতে বাধ্য হতেন।
মৃত্যুর দিন দশেক আগে বহুকাল পর হরিসাধনের সাথে শেষ সাক্ষাত ঘটে ঢাকায় ঐক্য ন্যাপের কেন্দ্রীয় কার্য্যালয়ে।শ্মশ্রুমন্ডিত মুখমন্ডল, জীর্ণশীর্ণ রোগাক্রান্ত দেহ। তাই চিনতে পারছিলাম না। বিষয়টা উপলব্ধি করেই ঐক্য ন্যাপের সভাপতি জননেতা পংকজ ভট্টচার্য্য পরিচয় করিয়ে দিলেন কিন্তু বিশ্বাস হতে চাচ্ছিল না যে এই মানুষটি সেই বহু পরিচিত ও অত্যন্ত আপন চির চঞ্চল, বয়োকণিষ্ঠ সহযোদ্ধা হরিসাধন দেবব্রহ্ম। অনেকটা উৎকণ্ঠিত চিত্তেই কুশল বিনমিয় করলাম। বস্তুত: হরিসাধন এসেছিলেন পংকজবাবুর কাছেই কোন বিশেষ প্রয়োজন।
এই মানুষটি সেই বহু-পরিচিত ও অত্যন্ত আপন চির-চঞ্চল পরিচিত ও অত্যন্ত আপন চির-চঞ্চল, বয়োকণিষ্ঠ সহযোদ্ধ হরিসাধন তেবব্রহ্ম। অনেকটা উৎকণ্ঠিত চিত্তে কুশল বিনিময় করলাম। বস্তত: হরিসাধন এসেছিলেন পংকজ বাবুর কাছেই কোন বিশেষ প্রয়োজনে। তাঁর প্রয়োজনীয় কাজ সেরে অমনি ফিরে গেলেন। বুঝিনি চিরতরে চলে যাবার আগের বিদায়ী সাক্ষাত হবে সেটা। কিন্তু তাই হলো। হারালাম আরও একজন বিপ্লবী সহযোদ্ধাকে।
মীরইকবাল হোসেন পূরো নাম মীর মো: ইকবাল হোসেন। বাড়ী বগুড়া শহরে। ১৯৫৩ এর শেষ দিকে গিয়েছিলাম বগুড়ার ছাত্র ইউনিয়নের কার্য্যকলাপ দেখতে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে। বগুড়াতেও তখন একজন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে। বগুড়াতেও তখন একজন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন যাঁর নাম দুর্গাদাস মুখার্জী। মুখার্জীকে চিনতাম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হওয়াতে। কিন্তু আরও অনেক নেতা কর্মীর সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটেছে বগুড়া গিয়ে। তাদেরই একজন মীর ইকবাল।
সদর উদ্দিন নামে একজন মেডিক্যালের ছাত্র ছিলেন বগুড়া জেলা ছাত্র ইইনিয়নের সভাপতি। গোপনে তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক সদা-সক্রিয় দুর্গাদাস মুখাজী। মনে পড়ে, একটি স্কুল ঘরে আমরা বসলাম কর্মীসভা, বর্ধিত আকারে থাকলেও প্রায় সম সংখ্যক কর্মী দাঁড়িয়ে সভার বক্তব্য শুনছিলেন। সে এক বিশাল সংগঠন। বলা চলে চোখ ধাঁধাঁনো। অথচ ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাই তো বাহান্নর শেষের দিকে। এত অল্প সময়ে এত বৃহৎ সংগঠন কি করে গড়া হলো জানতে চাইলাম। দুর্গাদাসের উত্তর, কোন যাদুমন্ত্র নেই বগুড়াতেসংগঠনগড়ে তোলার ব্যাপারে। রাজনীতিকে প্রাধান্য না দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের ও শিক্ষা ব্যবস্থার নানা অসংগতি ও সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করি আমরা। এই যে স্কুল ঘরে কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই স্কুলটি পরিচালনা করি আমরা। বগুড়াতে ছাত্র ইউনিয়ন এমনই আরও ৪টি অর্থাৎ মোট ৫ টি স্কুল পরিচালনা করে থাকে। বিনাবেতনে গরীবের সন্তানদেরকে বই-খাতা, শ্লেট-পেন্সিল প্রভৃতি ছাত্র ইউনিয়ন মানুষের কাছে থেকে চাঁদা তুলে সরবরাহ করে থাকে। এগুলি ছাড়াও এ জাতীয় আরও কিছু কার্য্যক্রম আমরা পরচালনা করে থাকি। ফলে ছাত্রসমাজ ও অভিভাবকদের বিপুল সমর্থন-সহযোগীতা আমরা পেয়ে থাকি। আর একই কারণে বাছাই করে আমরা সংগঠনের কর্মী নেতা তৈরী করি । রাজনৈতিক ক্লাস? গোপনে পরিচালনা করা হয় বাছাই করা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে।
এভাবে গড়ে তোলা নেতৃস্থানীয় কর্মী বাহিনীর বিশিষ্ট একজন মীর ইকবাল হোসেন। তখন নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্র। ছাত্র ইউনিয়নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালকও। নিজে গড়া প্রাথমিক পর্য্যায়ের ছেলে মেয়েদেরকেও একটি স্কুলে ৪/৫ জন করে শিক্ষক বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান। তাঁরা নিজেরাও উচ্চ শ্রেণী বা কলেজে পাঠরত এবং সবাই ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয়।
ফলে সম্ভব হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নকে গণ ছাত্র সংগঠনে পরিণত করা। অসাম্প্রদায়িক যে কোন দলের সমর্থকের সদস্য হতে কোন বাধা ছিল না। রাজনৈতিক দলের লেজুড় বৃত্তি সংগঠন হিসেবে ছাত্র ইউনিয়ন তখন করে নি। তবে উৎসাহিত করেছে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এবং সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী ক্রিয়াকর্মকে। যেমন ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে এসে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের সাথে সামরিক চুক্তি সই করলো পাকিস্তান। সেই মুহুর্তে সমগ্র পূর্ববাংলায় ছাত্র ইউনিয়ন দাবী তুললো-শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে তুললো “মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত থাক” “পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল কর”। কেন এ দাবী ছাত্র ইউয়িন নেতা-কর্মীরাও দেশব্যাপী সভা-সমিতি মিছিল করে জানিয়েছে, এতে পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ক্ষতি হয়েছে।
ফলে এ দাবীও জনপ্রিয়তা অর্জন করে ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক-রাজনৈতিক শক্তিও অনেকখানি বৃদ্ধি পায়। বগুড়ার ক্ষেত্রে মীর ইকবাল ও অন্যান্য নেতারা ছিলেন এসব দাবীতে সোচ্চার এবং তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যুক্তি সমৃদ্ধ বক্তব্য দিতে অসাধারণ নৈপুন্য সম্পন্ন।
আবার ভাল ছাত্র এবং ভাল বক্তা হিসেবেও সুনাম কুড়াতে সক্ষম হয়েছিল মীর ইকবাল হোসেন। কিছুকাল পরেই আরও একটি দাবী সংযোজিত হল সিয়াটোসেন্টো চুক্তি বাতিল কর। ঐ চুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় এবং বাগদাদ চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এশিয়ার আফ্রিকার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হরণ করেছিল।
মাষ্টার্স ও আইন (এলএলবি) পাশ করে ওকালতি পেশায় নিয়োজত হন ইকবাল। এই পেশাতেও অল্প সময়ের মধ্যে তিনি দক্ষতা অর্জন করেন এবং জেলা পর্য্যায়ের একজন প্রথম শ্রেণীর আইনজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সমর্থ হন। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে ইকবাল ন্যাপের বগুড়া জেলা কমিটির সম্পাদক নিবাচিত হন। রুশ-চীন দ্বন্দ্বের ফলে ন্যাপ বিভক্ত হলে তিনি মস্কোপন্থী ন্যাপের বগুড়া জেলা কমিটির অন্যতম নেতা নির্বাচিত হন।
পরবর্তীতে ন্যাপের আরও বিভক্তি হলে ইকবাল রাজনৈতিকভাবে নিষ্কিৃয় হয়ে এক পর্য্যায়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন কিন্তু আওয়ামী লীগারদের কাছে তিনি ন্যাপ নেতাই থেকে যান।
অত:পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত গঠিত হলে ইকবাল ঐ আদলতের একজন প্রসিকিউটার নিয়োজিত হন। বেশ কয়েকটি মোকর্দমা অত্যন্ত সাফল্যের সাথে পরিচালনার পর প্রসিকিউটারদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কলহ সৃষ্টি হওয়া মাত্র তিনি পদ্যাগ করেন।
কর্মব্যস্ত প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব মীর ইকবাল হোসেন মাত্র কয়েকদিন আগে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। হারালাম দুজন ঘনিষ্ট এবং বিপ্লবী সহযোদ্ধাকে। এখানেই শেষ নয় ডা. কাজী রবিউল হোসেন দু’জনের প্রসঙ্গে লেখা শেষ করতে না করতেই পেলাম আর এক বিপ্লবী সহযোদ্ধা ডা. রবিউল হোসেনের মৃত্যু সংবাদ। তিনি যশোরের বাসিন্দা হয়ে শেষ দিনগুলো কাটালেন নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে। রবিউলও আমার বয়ো কনিষ্ঠ এবং যতদূর মনে পড়ে একেবারে প্রাক-মাধ্যমিক ছাত্র থাকা কালেই (পঞ্চাশের দশকে) ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। নিজের কর্মগুণে গোপন কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্যপদও পেয়ে যান।
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ডাক্তারী পড়েন এবং এম.বি.বি. এস পাশ করে একাধারে ডাক্তারী এবং পার্টির কাজে অব্যাহতভাবে দীর্ঘদিন নিয়োজিত থাকার পর শুরু হয় তাঁর রোগাক্রান্ত জীবনের । ইতিমধ্যে কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তন করে যশোর শহরের বাসিন্দা হন। যশোর রবিউলের পৈতৃক শহর কিনা আমার জানা নেই তবে জানুয়ারীর তৃতীয় সপ্তাহে তিনি যশোরেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
একটি নিষ্ঠাশীল বিপ্লবী বন্ধু ও সহযোদ্ধা হিসেবে এতটাই কাছাকাছি ছিলাম যে তাঁকে ভুলতে পারব না বহুদিন।
আনোয়ারুল হক
বিগত ৩০ জানুয়ারী সকাল নয়টায় পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি অধ্যাপক শিবজিত নাগের পাঠানো মেসেজ থেকে জানতে পারলাম ঐদিন সকাল ৯ঢার দিকে আমার বাল্যবন্ধু পাবনার প্রবীন সাংবাদিক মৃত্যু বরণ করেছেন। আনোয়ার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ষাটের দশকের শুরুতে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে মুক্তির জন্য কারাগারের অফিস কক্ষে আনার পর ডেপুটি জেলার একটি Invitation Card আমার হাত দিলেন। খুলে দেখি আনোয়ারের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র। খুবই ভাল লাগলো এই ভেবে যে বন্ধুটির জীবনের এই বিশেষ মুহুর্তে পাবনাতে গিয়ে অংশ নিতে পারব।
অত:পর কারামুক্তির দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে মেইন গেট খুলে দেওয়া হলো। কিন্তু এ কি? সামনেই পুলিশের এক বিরাট বহর। সাদা পোষাকে একজনও ছিলেন পুলিশের কাছাকাছি। আমি জেল ওয়ার্ডারকে বললাম, রাজশাহী রেল ষ্টেশনে যাবার জন্য একটি রিক্সা ঠিক করে দিতে। অমনি সাদা পোষাকধারী ম্যাজিষ্ট্রেট এসে জানালেন, একটু থামতে হবে। প্রশ্ন করি “কেন? আপনাকে তো চিনলাম না”। উনি ম্যাজিষ্ট্রেট বলে পরিচয় দিতেই গোয়েন্দা কর্মকর্তাসহ একজন পুলিশ অফিসার এসে বললেন, “রণেশ বাবু, আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।” বললাম, “মুক্তির পর আমি তো জেলখানার এলাকার বাইরে যেতেই পারি নি। এর মধ্যে আবার কি অপরাধ করলাম?” জবাবে বলা হলো আজকেই আপনি Grounds detention পেয়ে যাবেন-তখন জানতে পারবেন।” আবার কারান্তরাল-তবে পুলিশ সঙ্গে নিয়ে কাছাকাছি চায়ের দোকানে দিয়ে এক পেয়ালা কফি খেয়ে মুক্তির সামান্য স্বাদ নিয়ে আবার ঢুকে পড়লাম জেল ওয়ার্ডে। দেখি যে ইতিমধ্যেই খাট এবং বিছানাপত্র এনে ঠিক মতই সাজানো আছে। মনটা খারাপ লাগলো আনোয়ারের বিয়েতে যোগ দিতে না পারার জন্য।
আনোয়ার রাধানগর মজুমদার একাডেমীর ছাত্র। বাহান্নার ভাষা আন্দোলনের মিছিলে হাজারো ছাত্রের সাথে সেও অংশগ্রহণ করে। পরে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেয়। এগুলি ঘটে আমাদের হাতেই। স্বল্পভাষী. প্রচার বিমুখ, সততার প্রতীক বন্ধু আনোয়ারকে চিনতে আমরা ভুল করি নি।
আনোয়ার শৈশবেই পিতৃহারা এবং সংসারের বেশ ক’জন ভাই-বোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম হওয়াতে সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধেই বর্তায়। কায়ক্লেশে সংসারটা চালিয়ে নিয়েছে সে। হঠাৎ করে মা, মেজভাই, তারপর সেজ ভাই সংসারের মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেলে আনোয়ার মানসিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। যা হোক ইতি পূর্বেই ম্যাট্রিক পাশ করে ইউনাইটেড ব্যাংক অব ই-িয়ার পাবনা শাখায় চাকুরী পাওয়াতে সমস্যাগুলি কমে আসে যদিও তা যথেষ্ট ছিল না।
আনোয়ার ছোট বেলায় সিনেমা দেখায় খুবই অভ্যস্ত ছিল। এ ব্যাপারে তার সাথী ছিল তার বন্ধু আনসারুল ইসলাম। আর একটু বড় হলে আনোয়ার খুবই বই পড়তো বিশেষ করে উপন্যাস। অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির ঊন এর নিয়মিত পাঠক ছিল সে।
পাবনার প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান শিখা সংঘ, উদীচী, জাহেদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ, জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ সহ পাবনার সকল প্রগতিমুখী সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও কর্মকর্তা ছিলেন আনোয়ার।
ছাত্র ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে, ছাত্রজীবন শেষ হলে ন্যাশনাল আওয়ামীী পার্টি (ন্যাপ) তে যোগ দেন এবং সম্ভবত: ৭০ এর দশকে কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদও লাভ করেন। কোনদিনই আনোয়ার কোন রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেন নি-তবে অতি অবশ্যই ছিলেন শ্রোতা-অত্যন্ত আগ্রহী শ্রোতা।
আনোয়ারুল হকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য জীবন হলো সাবাদিকতার। শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের স্নেহ ধন্য আনোয়ার ১৯৬১র মার্চে ইত্তেফাকের পাবনাস্থ সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তিতে কিছু ভূমিকা রেখে ছিলাম বটে কিন্ত নিয়োগের স্থায়ীত্ব বিধানে তার যোগ্যতাই মুখ্য। ১৯৬১ সালের মে মাসে পাবনাতে প্রাদেশিক মফ:স্বল সাংবাদিক সম্মেলন ও পাবনা প্রেস ক্লাবের অন্যতম সংগঠক। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও পরে পাবনার ভুট্টা আন্দোলনে আনোয়ার দীর্ঘদিন কারাজীবন যাপন করেন।
আমার আগেই চির বিদায় নেওয়া এবং শেষ সাক্ষাত না হওয়ার বেদনা আমাকে পীড়িত করবে আজীবন। আনোয়ারের অপর বৈশিষ্ট ছিলো তার নিখাদ অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা।
বন্ধু আনোয়ারের অমর আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক। আনোয়ারকে এবং অপর তিনজন বিপ্লবী সহযোদ্ধাকে লাল সালাম।
- প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।