বিশ্ব ইজতেমা শুরু হচ্ছে শুক্রবার, এ বছর ৩২ জেলার মুসল্লি
টঙ্গীর তুরাগতীরে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হচ্ছে আগামী শুক্রবার। এরই মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এবারও দুই পর্বে ইজতেমা হতে যাচ্ছে। তবে প্রথমবারের মতো দেশের মোট ৩২টি জেলা নিয়ে এ বছর ইজতেমার দুই পর্ব হবে।
আগামী বছরের বিশ্ব ইজতেমা বাকি ৩২ জেলা নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) ফজরের নামাজের পর থেকে আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। এবার প্রথম পর্বে অংশ নেবেন ঢাকার একাংশসহ ১৭টি জেলার তাবলিগ অনুসারীরা। আগামী রোববার (১০ জানুয়ারি) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্বের ইজতেমা শেষ হবে।
এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে ১৭টি জেলার মুসল্লিরা অংশ নেবেন। জেলাগুলো হচ্ছে ঢাকা, শেরপুর, নারায়ণগঞ্জ, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, গাইবান্ধা, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, নড়াইল, মাদারীপুর, ভোলা, মাগুরা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও পঞ্চগড়।
১৯৬৭ সালে টঙ্গীর পাগার গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব ইজতেমা। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টঙ্গীর বিভিন্ন মৌজায় বিশ্ব ইজতেমার জন্য ১৬০ একর ভূমি বরাদ্দ দেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশে ইজতেমাস্থলের ব্যাপক উন্নয়নে রাস্তাঘাট, অসমতল ভূমি সমতলকরণ, আট হাজার পাকা শৌচাগার, পাকা গোসলখানা, অজুখানা, বিদেশি মুসল্লিদের জন্য পয়ঃপ্রণালি, রান্নাবান্না, থাকার জন্য স্থায়ী টিনশেড ঘর নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, ড্রেন-কালভার্ট নির্মাণ ও অন্যান্য উন্নয়নের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ জাহিদ আহসান রাসেল ইজতেমার সার্বিক উন্নয়নে তদারকি করছেন।
তাবলিগ জামাতের উদ্যোগে প্রতিবছর এ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় টঙ্গীর তুরাগতীরে। ১৬০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ইজতেমা মাঠে বিশ্বের প্রায় সব মুসলিম দেশ থেকেই তাবলিগ জামাতের অনুসারী ধর্মপ্রণ মুসলমানরা অংশ নেন। তাঁরা এখানে তাবলিগ জামাতের শীর্ষ আলেমদের বয়ান শোনেন এবং ইসলামের দাওয়াতি কাজ বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেওয়ার জন্য জামাতবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যান। প্রতিবছরের মতো এবারও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ও কলকারখানার শ্রমিক-মালিকসহ বিভিন্ন পেশার মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা বিশ্ব ইজতেমার মাঠে প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করেছেন। ময়দানে মুসল্লিদের কাতারবদ্ধ হওয়ার জন্যে পুরো মাঠে দাগ কাটা সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া ইজতেমা ময়দানে জেলাওয়ারি মুসল্লিদের স্থানও (খিত্তা) নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
ইজতেমা মাঠের প্রস্তুতির কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কলেজের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ জানান, সব কাজ করা হচ্ছে মোশায়ারার (পরামর্শ) মাধ্যমে। বিদ্যুৎ, পানি, প্যান্ডেল তৈরি, গ্যাস সরবরাহ প্রতিটি কাজই আলাদা আলাদা গ্রুপের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। বিদেশি মেহমানদের জন্য ইজতেমা মাঠের উত্তর-পশ্চিম পাশে বিশেষ কামরা তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মুসল্লিদের তুরাগ নদ পারাপারের জন্য সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সদস্যরা তুরাগ নদের নয়টি স্থানে ভাসমান সেতু নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করেছেন।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের টঙ্গী অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, ইজতেমা মাঠে স্থাপিত উৎপাদন নলকূপের মাধ্যমে প্রতিদিন তিন কোটি লিটারেরও বেশি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের সকল পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অজু-গোসলের হাউস ও টয়লেটসহ প্রয়োজনী স্থানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া পাকা দালানে প্রায় ছয় হাজারের মতো টয়লেট ইউনিট রয়েছে। এদের মধ্যে নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত অজু-গোসলখানা এবং টয়লেটগুলো এরই মধ্যে সংস্কার করা হয়েছে।
ডেসকো কর্তৃপক্ষ জানায়, ইজতেমা এলাকায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। উত্তরা, টঙ্গী সুপার গ্রিড ও টঙ্গী নিউ গ্রিডকে মূল ১৩২ কেভি সোর্স হিসেবে নির্বাচন করা হবে, যাতে যেকোনো একটি গ্রিড অকেজো হলেও সামগ্রিক বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত না হয়। ইজতেমা এলাকায় চারটি স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর এবং পাঁচটি ট্রলি-মাউন্টেড ট্রান্সফরমারও সংরক্ষণ করা হবে।
ফায়ার সার্ভিসের টঙ্গীর স্টেশন অফিসার মোর্শেদ আলম জানান, ইজতেমাস্থলে তাদের একটি নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে সার্বক্ষণিক কর্মকর্তাসহ ফায়ারম্যানরা থাকবেন। ময়দানের প্রতি খিত্তায় অগ্নিনির্বাপকসহ ফায়ারম্যান, গুদাম ঘর ও বিদেশি মেহমানখানা এলাকায় তিনটি পানিবাহী গাড়ি, তিন সদস্যের ডুবুরি ইউনিট, একটি স্ট্যান্ডবাই লাইটিং ইউনিট এবং পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স থাকবে। তিনি আরো জানান, ইজতেমা মাঠের ধুলাবালু নিয়ন্ত্রণে তাঁদের উদ্যোগে ইজতেমা মাঠের আশপাশের এলাকায় পানি ছিটানো হবে।
টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার পারভেজ আলম জানান, ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা দিতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মেডিকেল অফিসারদের তালিকা ও ডিউটি রোস্টার করা হয়েছে। মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে মন্নু গেট, এটলাস গেট, বাটা কারখানার গেট ও টঙ্গী হাসপাতাল মাঠসহ ছয়টি অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এখানে হৃদরোগ, অ্যাজমা, ট্রমা, বার্ন, চক্ষু এবং ওআরটি কর্নারসহ বিভিন্ন ইউনিটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিকিৎসা দেবেন। রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক ১৪টি অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন থাকবে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা
গাজীপুর জেলা তথ্য কর্মকর্তা মো. নূরুল হক জানান, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে বুধবার (৬ জানুয়ারি) থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বৃহত্তর জেলাগুলোর ঢাকাগামী যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। এছাড়া দুই পর্বের আখেরি মোনাজাতের দিন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে আবদুল্লাহপুর থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত অংশসহ গাজীপুরে বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকবে। তিনি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানান, আগামী ১০ জানুয়ারি ও ১৭ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের দিন সকাল ৬টা থেকে গাজীপুরের কালীগঞ্জ-টঙ্গী মহাসড়কের মাঝুখান ব্রিজ থেকে স্টেশন রোড ওভারব্রিজ পর্যন্ত সড়কপথে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। টঙ্গীর কামারপাড়া ব্রিজ থেকে মুন্নু টেক্সটাইল মিল গেট পর্যন্ত সড়কপথেও থাকবে একই নির্দেশনা।
পন্টুন ব্রিজ নির্মাণ ও মুসল্লিদের চলাচলের সুবিধার্থে কামারপাড়া ব্রিজ থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত তুরাগ নদের সব ধরনের নৌ-যান চলাচল নোংর করা, ৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার থেকে ১৭ জানুয়ারি বন্ধ থাকবে। প্রয়োজনে নৌ-যানগুলো টঙ্গী ব্রিজের পূর্ব পাশে এবং কামারপাড়া সেতুর উত্তর পাশে নোংর করতে পারবে।
গাড়ি পার্কিং
ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে আসা মুসল্লিদের সুবিধার্থে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ১০ জানুয়ারি সকাল ৬টা থেকে বিভিন্ন স্থানে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চান্দনা চৌরাস্তা হয়ে আগত মুসল্লিদের বহনকারী যানবাহন পার্কিংয়ের জন্য মহাসড়ক পরিহার করে টঙ্গীর কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিল কম্পাউন্ড, মেঘনা টেক্সটাইল মিলের পাশে রাস্তার উভয় পাশে শফিউদ্দিন সরকার একাডেমি মাঠ প্রাঙ্গণ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে টিআইসি মাঠ, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠ, চান্দনা চৌরাস্তা হাইস্কুল মাঠ, তেলিপাড়া ট্রাকস্ট্যান্ড এবং নরসিংদী-কালীগঞ্জ হয়ে আগত মুসুল্লিদের বহনকারী যানবাহন টঙ্গীর কে-টু ও নেভি সিগারেট কারখানা সংলগ্ন খোলা স্থান ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) এস এম আলম জানান, বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে উল্লিখিত সড়ক পরিহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বৃহত্তর জেলাগুলো থেকে ঢাকাগামী সকল যানবাহন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী হয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এলাকায় প্রবেশের পরিবর্তে চান্দনা চৌরাস্তা, কোনাবাড়ী, কালিয়াকৈর-চন্দ্রা, বাইপাইল, নবীনগর, আমিনবাজার হয়ে চলাচল করবে।
ইজতেমা চলাকালে নামাজের সময় তুরাগ নদের পশ্চিম পাড়ে ইমামের সামনে না দাঁড়িয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এবার দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমায় দেশি-বিদেশি ৩০ থেকে ৩৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ইজতেমায় ২৮টি স্পেশাল ট্রেন
আগামী ৮ থেকে ১০ এবং ১৫ থেকে ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ২৮টি স্পেশাল ট্রেন চালু করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এই জন্য অতিরিক্ত ২০টি কোচ সংযোজন করা হবে। প্রয়োজনে কোচ আরো বাড়ানো হবে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ইজতেমার প্রথম দিন শুক্রবার ঢাকা-টঙ্গী-ঢাকা দুটি জুমা স্পেশাল ট্রেন চলাচল করবে। আখেরি মোনাজাতের আগের দুদিন জামালপুর ও আখাউড়া থেকে দুটি করে চারটি ট্রেন চলবে। আর লাকসাম-টঙ্গী একটি ট্রেন চলবে। আখেরি মোনাজাতের দিন ঢাকা-টঙ্গী সাতটি, টঙ্গী-ঢাকা সাতটি, টঙ্গী-লাকসাম একটি, টঙ্গী-আখাউড়া দুটি, টঙ্গী-ময়মনসিংহ চারটিসহ মোট ২১টি স্পেশাল ট্রেন চলাচল করবে।
এ ছাড়া ১০ ও ১৭ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের দুদিন মহানগর প্রভাতি অথবা গোধূলি, আখেরি মোনাজাতের পরদিন ১১ ও ১৮ জানুয়ারি তিস্তা এক্সপ্রেস এবং ইজতেমার প্রথমদিন ৮ ও ১৫ জানুয়ারি (শুক্রবার) সূবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো সাপ্তাহিক বন্ধের দিন চলাচল করবে। বিশেষ ট্রেন চলাচলের সুবিধার্থে সুবর্ণ এক্সপ্রেস, তিস্তা এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেস, মহুয়া এক্সপ্রেস, তুরাগ এক্সপ্রেস, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ কমিউটার, ঢাকা-টঙ্গী কমিউটার, ঢাকা-জয়দেবপুর কমিউটার ও ঢাকা-কুমিল্লা কমিউটার আখেরি মোনাজাতের দিন বন্ধ থাকবে। ইজতেমা উপলক্ষে সাধারণ যাত্রীর সঙ্গে অতিরিক্ত দেড় লাখ যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা হয়েছে।
রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক জানান, যেকোনো প্রকার নাশকতা ঠেকাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইজতেমা উপলক্ষে ঢাকা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সব স্টেশনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হবে। এ ছাড়া কর্তব্যরত অতিরিক্ত/সহকারী পুলিশ সুপার এবং একজন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের অস্থায়ী অফিস থাকবে। যেখানে নাশকতা সেখানেই প্রতিরোধ করা হবে।