সেলিনা জাহান প্রিয়ার- বৃষ্টির কদম ফুল ও নয়ন
বৃষ্টির কদম ফুল ও নয়ন (ছোট গল্প)
সেলিনা জাহান প্রিয়া
কেয়ানুর হাই স্কুলে পড়ে। গ্রামের কাচা রাস্তা বর্ষা কালে খুব কষ্ট জলে কাঁদা রাস্তা একাকার থাকে কিন্তু তার স্কুলে খুব ভাল লাগে তাই এই ভেজা কাদা মাখা পথে স্কুলে যায়। সময়টা ১৯৮৩ সাল খুব বৃষ্টি সকাল থেকে কিন্তু তার স্কুলে যেতে হবে কারন সামনে ফাইনাল, অংক আর ইংলিশ মিস করা যাবে না। তারা তিন বোন এক ভাই। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে বছর দুয়েক হল। মেজু দুলাভাই এর ছোট ভাই আমার চেয়ে চার ক্লাস নিচে পড়ে। এবার সে বৃত্তি পরীক্ষা দিবে। ওদের গ্রামে থেকে প্রতিদিন দু’মাইল রাস্তা সে হেটে আমার কাছে পড়তে আসে। ওরা তিন ভাই ওর নাম নয়ন। সকালে আসে আমার সাথে পড়ে একসাথে স্কুলে যায়। দু’জনের কত কথা। আস্তে আস্তে ওর সাথে আমার একটা মনের দারুন সখ্যতা গড়ে উঠে। ছোট মানুষ কিন্তু আমার জন্য তার কত কি। কাঁঠালে মুচি আনবে ভর্তা বানাতে। কলা পাতার বাসি বাজাবে স্কুলে যেতে। কারো বাড়ি থেকে বেলি জবা বা বকুল ফুল নিয়ে আসবে। একদিন আমি বললাম নয়ন কোথাও কদম ফুল নাই, ও মা পরের দিন কদম ফুল নিয়ে হাজির। কদম ফুল আমার খুব প্রিয়। যত দিন গাছে কদম ফুল থাকবে নয়ন আনবে সেই কদম ফুল আমার জন্য। বর্ষা কাল আর নয়নের কদম ফুল যেন এক সূতায় বাঁধা আমার মনের ফ্রেমে। সময় গড়িয়ে আমি স্বামীর ঘরে।
একদিন খবর পেলাম যে নয়ন নৌকা ডুবে মারা গেছে আমার কান্না দেখে আমার স্বামী বলল অবাক এত কাদছ কেন ওর জন্য!! আমাকে নিয়ে গেল মেজ দিদির বাড়িতে তিন দিন পরে।
নয়নের ঘরে আমি কাঁদতে লাগলাম আরও জোরে। এই ছোট ছেলেটা সারা দিন বুবু, বুবু করে আমাকে কত জালাত। কাচা তেতুল আর পিয়ারা পকেট ভরে নিয়ে আসত। ছবি একে বলত এটা আমার বুবুর ছবি।
আজ ২০০১ সাল এখন আমি ঢাকায়। আমার ছেলে এখন ক্লাস নাইন এ পড়ে। সকাল থেকে খুব বৃষ্টি আষাঢ় শেষ হবে হবে অল্প দিনের মধ্য হটাত আমার কদম ফুল দেখতে ইচ্ছা করছে। স্বামী কে ফোন করে বললাম আমার জন্য পারলে কয়েকটা কদম ফুল নিয়ে এসো। ও শুনে খুব হাসল আর বলল ম্যাডাম সরি চেষ্টা করব। ছেলে কে বললাম। ছেলে একটু হেসে,ও মা তুমি যে কি বল। আমি কোথায় পাব?
কয়দিন বৃষ্টি আর বৃষ্টি কদম ফুলের সাথে নয়নের জন্য কষ্ট লাগছে। আজ নয়ন বেঁচে থাকলে ও আমার জন্য কদম ফুল নিয়ে আসতোই।
আজ শুক্রবার বিকেল তিনটা এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। আমার ছেলে স্বামী ক্রিকেট খেলা দেখছে। আমি খুব হারানো দিনের গান শুনছি। হটাত একটা কলিং বেল। আমি বললাম দেখত বাবা কে এলো। ছেলে দরজা খুলে কেউ না মা বলে দরজা বন্ধ করে চলে এলো। এবার আবার কলিং বেল। আমি বললাম ভালো করে দেখত এই বৃষ্টি মধ্য কে এলো। ছেলে বলল, মা কাউকে দেখা যায় না, কেউ নেই। আমি উঠে দরজার কাছে এলাম। না কেউ নাই কিন্তু সিঁড়ির দিকে চেয়ে আমি অবাক অনেক গুলো কদম ফুল। আমি একটা একটা করে সব কদম ফুল হাতে নিলাম। এখনো পাতা গুলো ভিজা।
আমি ফুল গুলো বুকে জরিয়ে ধরলাম একটা দীর্ঘ নিশ্বাসে ছাড়লাম। আমার হাতে ফুল দেখে ছেলে বলল মা কে দিল তোমার প্রিয় ফুল। আমি আসে পাশে কাউকে দেখছি না। ফুল গুলো নিয়ে আমি বৃষ্টি মধ্যে ছাদে গেলাম। সাথে আমার স্বামী ও ছেলে আমার চোখ দিয়ে পানি পরছে। বৃষ্টির পানি আমার চোখের জল একসাথে একাকার। জানি না ফুল গুলো কে দিয়েছে কিন্তু ফুল গুলো দিয়ে আমি সেই ছোট নয়ন কে দেখতে পাচ্ছি। যেন আমি আর নয়ন বৃষ্টি মধ্য কাঁদা মাখা পথে আবার আমার সেই গ্রামের পথ দিয়ে কদম ফুল হাতে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি।