সেলিনা জাহান প্রিয়ার রহস্য গল্প- বৃষ্টির রাতের মোহিনী
বৃষ্টির রাতের মোহিনী
রাত এক টা একটু পরে ট্রেন থেকে নামলো ড্যানিয়েল কিশোর গঞ্জ রেল স্টেশন এ। চিটাগং মেইল ট্রেন থেকে নেমেই হাত ঘড়ি টা চেয়ে দেখল। অনেক রাত।চায়ের দোকান থেকে একটা রং চা খেয়ে নিল। হাতের ব্যাগটা কাঁদে নিয়ে আকাশটা টা একবার দেখল। অনেক মেঘ করা। একটা রিক্সা কে বলল
—– কি ভাই যাবেন
—– স্যার কই যাইবাইন?
—– জঞ্জল বাড়ি!!
—- স্যার যাইবাম।
—– কত নিবে?
—– দেলাইন যে সাব। রাইতের বেলা। রাস্তা টা ভাল না। চোর ডাকাত আছে। তাই বলি সাব সকালে গেলে ভাল হয়।
—– আরে আমার কাছে পিস্তল আছে?
—— কন কি সাব??? মাইরাইলছুইন!!!
—–কেন?
—– এমন জিনিস থাকলে ভুত পেরত ও ভয় ফাইবো।
—–আরে তুমি যাব কিনা বল?
—– স্যার আল্লাহ্ রাসুলের নাম নিয়ে উইঠা পরইন।
ড্যানিয়েল রিক্সা উঠে। পাশের হোটেল থেকে এক বোতল পানি কিনে নেয়। রিক্সা চলেতে থাকে। রিক্সা চালকের বয়স পঞ্চাশের উপরে হবে। এক রামপুর পার হবার – একটা বিড়িতে আগুন ধরায় রিক্সা চালক। মনের সুখে একটা গান ধরে। গানটা অনেক পূরানো ছবির। ড্যানিয়েল আর কিছু বলে না। মনে হয় কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। তাই খুব ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। আকাশ একদম কালো। ড্যানিয়েল বলল কত সময় লাগবে বলতে পারেন চাচা?
—– কিতা যে কইন। বিড়ির দম দেয়া শেষ হলে এক ঘণ্টা লাগবো। বৃষ্টি শুরু হয় তখন বউলাই বাজার পার হয়ে একদম খোলা ময়দান। চার পাশে শুধু ধানের জমি। মাঝ খান দিয়ে একটা রাস্তা। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে রিক্সা টা একটু একটু করে সামনে যাচ্ছে। শিমুল তলার একটু আগে একটা জায়গা। অনেক আগে বাড়ি ছিল এখন আর বাড়ি নাই। কিন্তু ঐ জায়গায় এসে রিক্সার চালক বলল সাব এই বাড়িতে একটু দাড়াই।
—- আরে এই খানে তো কোন বাড়ি ছিল না।
—- সাব এরা নতুন আইছে। এই বাড়িটা কিনেছে।
—- ও আচ্ছা! তাহলে ভাল। বৃষ্টি খুব বেড়েছে। ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। ড্যানিয়েল একটা দৌড় দিয়ে গিয়ে পুকুর পার হয়ে বাড়িটার বারান্দায় দাঁড়ালো। জানালা খোলা। একটা হারিকেনের আলো জালানো। রিক্সা চালক বলল সাব আমি গাড়ির কাছে যাই। না হয় চোরে নিয়া যাইব। আপনি বৃষ্টি কমলে চলে আইসেন। বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে চলে গেল। ড্যানিয়েল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। খুব বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিজলী চমকাচ্ছে। ড্যানিয়েল দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভাগ্য ভাল যে জানালা দিয়ে কিছুটা আলো আসছে। না হয় তো সে রিক্সার চালক কে যেতে দিত না। বাতাস শুরু হল। এমন সময় বারান্দার দরজা টা খুলে একজন হাতে হারিকেন নিয়ে বের হল।
—- ড্যানিয়েল মুখের সামনে হারিকেন ধরল। কে আপনি?
—-ড্যানিয়েল দেখল একটা অপূর্ব সুন্দর মেয়ে। সাদা লাল সুতির শাড়ি পরা। মাথায় অনেক লম্বা শাড়ির আঁচল টানা। জি আমি ড্যানিয়েল। জঙ্গল বাড়ি যাব। বৃষ্টির জন্য একটু দাঁড়ালাম। বৃষ্টি থামলে চলে যাব।
—- ও আচ্ছা ঘরে আসুন।
—- আমি মুসলিম?
—- তাতে কি আমি হিন্দু বলে কি মানুষ না?
—- আসলে তা না। অনেক হিন্দু বাড়িতে তো তাদের ঘরে যেতে দেয় না।
—- তা ঠিক কিন্তু আপনি ঘরে আসুন। মেহমান অনেক রাত। ঠাণ্ডা বাতাস। বৃষ্টির ছিটা ছিটা পানিতে তো আপনার জ্বর চলে আসবে। আর তো বলা চলে ভুজে গেছেন।
—- ড্যানিয়েল কিছুটা অবাক হল। এত রাত একটা এত সুন্দর মেয়ে। আর এত মিষ্টি করে কথা বলছে। তার কথা রাখার জন্য সে ঘরে প্রবেশ করল। অবাক হয়ে দেখছে সব কিছু খুব পুরাতন আমলের।এমন কি চেয়ার টা পর্যন্ত। একটা গোল টেবিল। অনেক কয়টা মোম জলছে।ড্যানিয়েল বসল একটা চেয়ারে।
—- কি দেখছেন মিঃ ড্যানিয়েল!
—- বাহির থেকে বুঝা যায় না। বাড়ির ভিতর টা এত সুন্দর। আচ্চা আর কে কে আছে। এই বাড়িতে।
—- মেয়েটা একটু হেসে বলল। বাড়িতে অনেক মানুষ তবে এই ঘর টা আমার।
—- অহ আচ্ছা! বেশ সুন্দর আপনার ঘর। এই গ্রামে এত সুন্দর বাড়ি আছে আমার জানা ছিল না।
—- নিল এই কাপড় দিয়ে মাথাটা মুছে নেন। না হয় জ্বর চলে আসবে। ড্যানিয়েল খুব ভাল করে মেয়েটা কে দেখছে। খুব অবাক তার পায়ে আলতা দেয়া। সাদা পায়ে আলতা!! বা খুব সুন্দর। মেয়েটার হাতে অনেক চুড়ি আর গলায় অনেক মালা। হাতের আংটি গুলি দেখার মত। এক পাত্র পানি নিয়ে বলল নিন একটু জল
পান করে নিন। মনের ক্লান্তি দূর হবে। ড্যানিয়েল পানি টা হাতে নিল। একটু হাতের ছুয়া লাগলো ড্যানিয়েল বুঝতে পারলো একদম শীতল হাতের ছুয়া। মেয়েটা বলল বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। এমন বৃষ্টি আমার খুব পছন্দ। আপনার কি পছন্দ?
—– হ্যাঁ একটু একটু।।
—- বেশ ভাল। অনেক টা পথ চলে চলে আসছিলেন। আর একটু পরে বৃষ্টি হলে আর দেখা হত না আপনার সাথে। গান শুনবেন।।
—- গান কি ভাবে বিদ্যুৎ তো নাই।
—– কলের গান। বিদ্যুৎ লাগে না। একটা হাতে গুরিয়ে দিতে হয়।
—— ভালই তো বৃষ্টির রাত। একা একটা মেয়ে একা একটা ছেলে। কেউ কাউকে চিনে না।
—— মেয়েটি হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ করে হেসে উঠল। বলল বা চমৎকার করে কথা বলেন?
—— আচ্ছা আপনার নাম জানা হল না।
—— আমি মোহিনী রানী পাল।
—— হ্যাঁ এটার নাম তো পাল পারা।
—– যাই হউক খুব ভাল মনের মানুষ আপনি মোহিনী।।
—— আসলে আমি ভাল এই জন্য যে আপনি ভাল।
—– দাঁড়ান কলের গান বাজাই। খুব সুন্দর কলের গান।ড্যানিয়েল জীবনে এই প্রথম এই কলের গান দিয়ে গান শুনছে। কিন্তু অল্প বেজে বন্ধ হয়ে গেল। মোহিনী বলল আপানার কপাল ভাল না। মাঝে মাঝে চলে। আবার চলে না। যাই হউক একটু বসুন চা বানিয়ে দেই।
—- না না এত রাতে চা লাগবে না।
—- আপনার কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।
—– না! বৃষ্টি তো বাড়ছে আর বাড়ছে। যাব কি ভাবে ভাবছি।
—– কেন যেতেই হবে? কেউ অপেক্ষা করছে কি? আচ্ছা আপনি কার ছেলে?
—–আমি কি আপনাকে শুধু মোহিনী ডাকতে পারি।
—– ঠিক আছে তবে আমি আপনাকে ড্যানিয়েল ডাকব না। আমি আপনাকে রাজ বলে ডাকতে চাই। আপনি জঙ্গল বাড়ির ছেলে? তাই
—– আরে আমার ডাক নাম রাজ। ড্যানিয়েল বলে ডাকে মা । মা তো অন্য ধর্মের তাই।
—– মানে রাজ সাহেব।
—– মা খ্রিস্টান।
—– অহ! দারুন। জানেন রাজ আমার বৃষ্টি হলে পুকুরে সাতার কাটতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু একা একা যেতে ভয় লাগে।
—– যাবেন নাকি।
—– হ্যাঁ যাব। আপনি যদি হারিকেন আর ছাতা নিয়ে দাঁড়ান।
—– সত্য যাবেন। তাহলে ছাতা নিয়ে আসুন। আপনি আমার এত উপকার করলেন আমি না হয় একটু করি।
—–দারুন রাজ সাহেব। আমি ছাতা নিয়ে আসছি। মোহিনী ছাতা নিয়ে আর হারিকেন নিয়ে আসে। ড্যানিয়েল তাকে নিয়ে পুকুর পারে যায়। সব গয়না নিয়ে মোহিনী পানিতে নেমে যায়। হালকা আলো। মাঝে মাঝে বিজলী চমকায়। মেয়েটা সারা পুকুরে মনের সুখে সাতার কাটে। একা একা হাসে পুকুর মাঝ থেকে এটা লাল শাপলা তুলে আনে। বলে এটা আপনার জন্য। চাইলে আপনি নামতে পারেন পুকুরে। তবে ঘরে আপনার পড়ার মত কাপড় নাই। হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। ড্যানিয়েল বলল ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। আচ্ছা আপনি হারিকেন নিয়ে ঘরে যান। আমি ভিজা শরীরে আপনার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে পারব না। আপনি আগে ঘরে যান। আমি আসছি পিছনের দরজা খুলা আছে। ঠিক আছে মোহিনী আপনি আসুন আমি যাই। ড্যানিয়েল এবার ঘরে আসে।
কিছু অল্প সময়ে একটা নীল শাড়ি পরে সামনে আসে মোহিনী। বাহ খুব সুন্দর লাগছে আপনাকে।
—— আসলে ভাবতে পারি নাই আজ জলে নেমে স্নান করতে পারব।
—– কেন। একা একা ভয় পান।
—— দেখুন আমার কোন ভয় নেই। ভয় থাকলে কি আপনাকে ঘরে আসতে দেই।
—- তা সত্য বলেছেন। আপনি এত রাতে পুকুরে নামতে পারেন। আমি ভাবতেই পারি নাই।
—- আপনি একটু বসুন আমি একটু আসছি।
—– কোথায় যাবেন।
—- পাশের ঘরে।
—- আচ্ছা যান।
—- আপনার গলায় এটা কি? মোহিনী।
—– এটা একটা ফুলের মালা।
—– এত রাতে ফুলের মালা।
—– বেলির মালা সন্ধ্যায় গেথে ছিলাম।
—– মোহিনী আপনাকে এই মালায় নীল শাড়ি খুব সুন্দর লাগছে।
—— আলতা পড়াতে পারেন পায়ে।
—– না তো।
—– আচ্ছা নিয়ে আসছি। একবার দেখালে পারবেন।
—- ঠিক নিয়ে আসুন দেখি।
ড্যানিয়েল মোহিনী কে আলতা পড়াতে লাগলো। মোহিনী পা থেকে কাপড় একটু উপরে তুলতে চাইলে ড্যানিয়েল তার চোখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বলে কাপড় সরাতে হবে না। আপনার কাপড়ে আলতা লাগবে না। বাহ দারুন করে আলতা দিলেন তো। মনে হয় অব্যাস হয়ে আছে।
—- না কোন অব্যাস নাই। তবে মোহিনী আপনার ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে।
—-আপনি অনেক ভাল এই শাপলা ফুল টা ব্যাগে রাখুন। আবার না ভুলে যান।
—– না ভুলার মত না। জিবনে সব কিছু ভুলা যায় না। আপনি অনেক সুন্দর করে হাসেন মোহিনী। আপনার হাসির মাঝে একটা মায়া আছে।
—— আচ্ছা আমি আপনাকে রাজ ডাকলাম কেন জানতে চাইলেন না।
—— আমি খুব অবাক হয়েছিলাম আপনি আমার বাবার নাম ধরে ডেকেছেন।
—— আপনার বাবা আপনাকে কি এই নামে ডাকে?
—— হ্যাঁ বাবা আমাকে এই নামে ডাকে। বাবার নাকি এক দাদা ছিল খুব সুন্দর তাকে সবাই ছোট রাজা ডাকত!! বাবা রাজা না রেখে! রেখেছে রাজ।।
—— আপনি সত্যই একজন রাজ। আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
—— জানি না। হয়ত বা হতে পারি?
আমি একটা জিনিস দেখতে চাই যদি আপনি দেখুন। তবে এই টা দেখার পর আপনি আমাকে আর আপনি করে বলবেন না।
—– কি এমন জিনিস আমাকে দেখান তো। যা দেখার পর আমি আর আপনাকে আপনি না বলে তুমি বলব? তাহলে দেখান!!!! দেখি?
মোহিনী একটা হেসে বলল দেখুন বৃষ্টি কিন্তু থামার নাম নাই। তবে আমি আজ যা দেখাব আপনি কিন্তু আমাকে বলতে পারবেন না। এই সব আমি কোথায় পেলাম। মোহিনী পাশের ঘরে যায়। একটা অনেক দিনের পুরাতন ব্রিফকেস নিয়ে আসে। একটা কাপড় দিয়ে উপরের ময়লা গুলো পরিষ্কার করে। এবার ভিতর থেকে কিছু ছবি বের করে ড্যানিয়েল হাতে দেয়।
ড্যানিয়েল অবাক চোখে চেয়ে দেখে সব গুলো ছবি তার। একটা একটা করে ছবি দেখতে থাকে। এক সময় বলে আরে এই ছবির মানুষ আর আমি তো একই ব্যক্তি মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি কোনো সময় সাদা কালো ছবি তুলি নাই। অবাক না হয়ে পারলাম না। মানুষের সাথে মানুষের এত মিল কি করে হয়। আপনি মোহিনী সত্যি আমাকে অবাক করে দিলেন। মোহিনীর চোখে পানি ঝর ঝর করে পড়ছে। নীল শাড়ীর আঁচলে মোহিনী তার চোখ মুছে যাচ্ছে। ড্যানিয়েল বলে এই গুলো কার ছবি?
——–মোহিনী বলে আমাকে একবার তুমি করে বল। তখন বলছি এই গুলো কার ছবি?
—– রাজ একটু হেসে বলল আচ্ছা তুমি বল তো এই গুলি কার ছবি।
মোহিনী বলল এই গুলো সব রাজের ছবি। যেই রাজ কে আমি ভালবাসতাম। আমার জীবনের চেয়ে বেশি। আমি আজো রাজ কে ভালবাসি। রাজের জন্য তাই এই আলো জ্বেলে অপেক্ষা করি। আমি জানি কোন এক দিন রাজ এমন বৃষ্টির দিনে আসবে। রাজ আমাকে বলে গেছে তাদের বাড়িতে নাকি বর্ষা কালে অনেক রজনীগন্ধা ফুল ফুটে। আমার জন্য সে সেই রজনী গন্ধা ফুল নিয়ে আসবে। আমরা এমন বৃষ্টির দিনে এই লাল শাপলা পুকুরে এক সাথে সাতার কাটব। আমি জানি রাজ আসবে আমি তাই রাজের জন্য অপেক্ষা করি।
ড্যানিয়েল বলল মোহিনী তুমি কান্না কর না। রাজ যদি তোমাকে ভালবেসে থাকে তবে তাকে আসতে হবেই। এমন করে কোন মেয়ে অপেক্ষা করলে সে না এসে পারবে না।আমি তোমার ভালবাসা কে অনেক সম্মান করি মোহিনী।
———- আমি তোমাকে রাজ মনে করেছিলাম। ভাবলাম তুমি আমার সাথে অভিনয় করছ। তাই পুকুরে গেলাম। তুমি পুকুরে নামলে না। আমার রাজ হলে সে আমার সাথে এই পুকুরে নেমে যেত। আমি আর রাজ সারা রাত পুকুরে সাতার কাটতাম। রাজ খুব সুন্দর করে আমাকে বলত। এই পুকুর তুমি আর আমি আর ঐ লাল শাপলা যেন একটা উপন্যাস। রাজ বৃষ্টি থেমে গেছে। তোমার যাওয়া দরকার। একটু পরে ভোর হবে। আমি চাই ভোর হবার আগেই তুমি চলে যাও। কেউ যখন দেখে নাই। তাহলে না দেখাই ভাল। একটা ছবি আমি তোমাকে দিলাম। দেখ তো এই মানুষটা তুমি কি না। যদি তুমি হও। আর বৃষ্টি নামে ঝুম ঝুম তবে চলে এসো এই পুকুর পারে আমি দাঁড়িয়ে থাকব তোমার জন্য।
—— আচ্ছা মোহিনী ছবিটা দাও। বৃষ্টি নাই। অনেক ভাল লাগলো তোমার সাথে পরিচয় হয়ে। যদি সময় পাই যাওয়ার সময় দেখা করে যাব।
—— আচ্ছা তুমি চাইলে ই দেখা হবে।
মোহিনী একটা হারিকেন বাতি হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হয় ড্যানিয়েল কে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসে।
ড্যানিয়েল দেখে রিক্সা টা নাই। ভাল করে আস পাশ দেখে। মোহিনী বলে হয়ত চলে গেছে। অনেক বৃষ্টি তা ছাড়া একা একা রাস্তায় তাই।
—– তাই বলে ভাড়া নিবে না।
—– আবার দেখা হলে দিয়ে দিও।একটু সামনে শিমুল তলা। ৫ মিনিটের পথ। তুমি যাও। আমি হারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
—– মোহিনী তুমি অনেক ভাল। কিন্তু তোমার শাড়ি পড়া চোখের কাজল হাতের চুড়ি, গলার মালা। পায়ের আলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
—– রাজ এই মোহিনী তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, যদি মনে পরে তবে চলে এসো ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে।
—- আমি যাই মোহিনী। তুমি ঘরে যাও।
—– না আমি ঘরে যাব না। যতক্ষণ দেখা যায় আমি তোমাকে দেখব।
—— এই যাওয়ার সময় তুমি করে বলে আরও মায়া লাগিয়ে দিলে।
ড্যানিয়েল পাকা রাস্তা ধরে হাটতে থাকে। অনেক দূরে যেয়ে পিছন ফিরে দেখে আলো টা এখনো আছে। এক সময় আর আলো দেখা যায় না। মসজিদ থেকে আজানের মিষ্টি সুর ভেসে আসে। ড্যানিয়েল হাটতে হাটতে নিজ বাড়িতে চলে আসে। ড্যানিয়েল মা দরজা খুলে দেয়। ড্যানিয়েল একটা লম্বা ঘুম দেয়। দুপুরে ড্যানিয়েল মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে। মা আর একটু ঘুমাই।
—– না আর ঘুমাতে হবে না। কোন গাড়িতে আসছ। এত সকালে তো কোন গাড়ি থাকার কথা না।
—- মা রাতের ট্রেনে আসছি। রাত একটায় ট্রেন থেকে নামি রিক্সা নেই। পথে অনেক বৃষ্টি। পরে পাল পারা একটা বাড়িতে যাই। বেটা রিক্সা ওয়ালা আমাকে ঐ বাড়িতে রেখে চলে যায়। বৃষ্টি থামার পর আর দেখি রিক্সা নাই। হেঁটেই চলে আসি।
ড্যানিয়েল মা অবাক হয়ে বলে- পাল পাড়া তো কোন বাড়ি ঘর নাই? ঐ খানে কার বাড়িতে উঠলি।
—— মা কার বাড়ি জানি না। তবে মেয়েটার নাম মোহিনী।
—– কি যে বলিস কিছুই বুঝি না? পাল পাড়া না কই উঠেছিলি কে না?
—– মা পাল পাড়ায় উঠেছি।
—– আচ্ছা যা। এখন কিছু খাবি। হাত মুখ ধুয়ে আয়। ড্যানিয়েল বাবা বলে পাল পাড়া তো কেউ নাই। সেতু অনেক বছর আগে তারা ভারতে চলে যায়।
—– আব্বু আমি বিকালে যাব ঐ বাড়িতে। কারন বাড়িটা পাল পাড়া না অন্য জায়গা দেখে আসব। ড্যানিয়েল বিকেল তার বন্ধু আনোয়ার কে নিয়ে মটর সাইকেল নিয়ে যায় ঐ জায়গায়। একি দেখছি কোন ঘর বাড়ি নাই।
—- আনোয়ার বলে তোর কই মাথা নষ্ট হয়েছে। এই জায়গায় আমি জন্মের পর থেকে কোন বাড়ি ঘর দেখি নাই। শুনেছি পাক ভারত ভাগ হবার পরে এরা ভারত চলে যায়। ড্যানিয়েল ভাল করে দেখতে লাগলো।
গাছ ঠিক আছে। পুকুর ঠিক আছে। লাল শাপলা ঠিক আছে। ড্যানিয়েল বলল আনোয়ার বিশ্বাস কর এই
জায়গায় একটা বিশাল বাড়ি আমি দেখেছি।
—— পাগলের মতো কথা বলিস না!! আমি কোন দিন এই খানে আসি না। সবাই বলে এই জায়গা টা ভাল না। চল যাই। আনোয়ার ড্যানিয়েল কে নিয়ে চলে আসে। বাড়িতে এসেই এক দৌড়ে ড্যানিয়েল ঘরে যায়। তার ব্যাগটা খুলে। কি অবাক করা বিষয় লাল শাপলা তো ব্যাগের মধ্যে। ড্যানিয়েল মা বলে কি রে শাপলা কেন তোর ব্যাগে। ড্যানিয়েল বলে মা এদিকে এসো তো। ড্যানিয়েল ব্যাগ থেকে ছবিটা বের করে মাকে দেয়।ড্যানিয়েল মা ছবিটা হাতে নিয়ে বলে এটা তো তোমার ছবি। তা সাদা কালো কেন? মা আব্বু কোথায়? দেখ পাশের ঘরে হয়ত। ড্যানিয়েল তার বাবা কে বলে – বাবা এই ছবিটা কে?
—- ছবিটা টা হাত নিয়ে ভাল করে দেখে। কোথায় পেলে এই ছবি? এই টা তো আমার ছোট চাচার ছবি। একদম তোমার মত ছিল দেখতে।
—–আব্বু আমি ছোট দাদার বিষয় জানতে চাই।
—– বাবা সেই পুরাতন কথা জেনে কি হবে?
—– আব্বু আমার জানতে হবে?
—– আমি সব জানি না বাবা!! তুমি এক কাজ কর তোমার ছোট দাদার এক বন্ধু আছে পাশের গ্রামে। তার কাছে যাও। অনেক বয়স্ক মানুষ এখন মনে হয় ৯০ বছর বয়স। সে সব জানে। একদিন আমাকে বলেছিল তোমার চাচার গল্প তোমার ছেলে কে বলব।।
ড্যানিয়েল পাশের গ্রামে আসে। খুজে পায় তার ছোট দাদার বন্ধু কে। অনেক বয়স মানুষটার কানে কম শুনে।
ড্যানিয়েল তার ছোট দাদার ছবিটা তার হাতে দেয়। ছবিটা দিকে চশমা পরে চায়। ছবিটায় হাত দিয়ে কাদতে থাকে।ড্যানিয়েলের মুখটায় হাত দিয়ে বলে তুমি কে গো? আমি ড্যানিয়েল জঙ্গল বাড়ি সাহেব বাড়ির ছেলে আমি।
বয়স্ক মানুষটি বলে তুমি কি রাজা সাহেবের নাতি।
——— হ্যাঁ দাদা।
———- খুব ভাল। তোমাকে দেখে মনে হয়েছিল রাজা সাহেব এলো বুঝি। ঠিক তোমার মত ছিল। আমাকে খুব ভালবাসত রাজা সাহেব। আমার চেয়ে বয়সে বড় হলেও আমাকে বন্ধুর মত দেখত।
——— আচ্ছা দাদা আমাকে পাল পাড়া আর রাজা সাহেবের কোন কথা থাকলে একটু বলবেন।
——– সে তো অনেক পুরান কথা নাতি। আচ্ছা বস বলছি। রাজা সাহেব খুব ঘোড়া দৌড়াতে পছন্দ করতেন। একদিন ঘোড়া নিয়ে পাল পাড়া যায়। পালদের এক মেয়ে। খুবেই সুন্দর। রাজা সাহেবের সাথে তার ভাব হয়ে যায়। রাজা সাব প্রায় রাতে ঘোড়া নিয়ে সেই মেয়ের সাথে দেখা করতেন। রাতের রাত সেই মেয়ের সাথে কথা বলে কাঁটিয়ে দিতেন। রাজ সাহেব কলকাতা লিখা পড়া করতেন। বাড়িতে এসেই চলে যেত সেই মেয়ের কাছে। মেয়েটির নাম ছিল মোহিনী। একদিন রাজা সাহেবের বাবা জমিদার দেওয়ান সাহেবের নিকট বিষয় জানাজানি হয়ে যায়। তখন এই তল্লাটে রাজা সাবের বাপের ধমকে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খেত। দেওয়ান সাব কিছুতেই বিষয়টা মেনে নিতে পারে না। রাজা সাহেব কে জোড়করে বিয়ে
করান ভাঁটি অঞ্চলের জমিদারের মেয়ে। রাজা মশাই বাসর ঘরে সেই বউ রেখে তার প্রিয় ঘোড়া নিয়ে বেড়িয়ে পরে মোহিনীর সাথে দেখে করতে। মোহিনী পুকুর পারে দাঁড়িয়ে রাজা মসাইর জন্য অপেক্ষা করে। তখন রাত মনে হয় প্রথম প্রহর। দেওয়ান সাহেব তার লাঠিয়াল বাহিনী পাঠায়। রাজা সাহেব কে সেই রাতে ধরে নিয়ে আসে। দেওয়ান সাহেব পালদের সব ঘর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মোহিনীকে দেওয়ান সাহেবের সামনে হাজির করা হয় মোহিনীদের পুকুর পারে। তারপর মোহিনীকে হাত পা বেঁধে সেই পুকুরে ফেলা দেয়া হয়। পাল পাড়া জুড়ে শুরু হয় কান্না। কিছু দিন পর দেশ ভাগ হয়ে যায়। অন্য সব পালরা তখন ভারত চলে যায়। ঐ বাড়িটা তার পর থেকে খালি পরে আছে আজ পর্যন্ত। আমি আগে যেতাম পুকুর পারে বসতাম। এখন বয়স হয়েছে তাই যাওয়া হয় না। তুমি দেখতে রাজা সাহেবের মত হয়েছ।
—— রাজা সাহেবের কি হয়েছিল?
—— রাজা সাহেব একদিন কাউকে না বলে চলে যায়। আজ পর্যন্ত তার কোন খুঁজ নাই। তবে সে পাগল হয়েছিল। শুধু বলত মোহিনী আমি ফিরে আসব। আবার জন্ম নিব। এই কথা গুলো বলত। ড্যানিয়েল আর কিছুই বলে না। সোজা বাড়িতে চলে আসে। মাকে জড়িয়ে বলে মা আমি দেখতে কি সেই রাজা দাদার মত হয়েছি। ড্যানিয়েল মা একটু হেসে বলে সবাই তো তাই বলে। সারা রাত ঘুমাতে পারে না। ড্যানিয়েল। কি করবে বুঝতে পারে না। জঙ্গল বাড়ি সামনে বড় পুকুর পারে বসে একা একা ভাবতে থাকে। তাহলে কি আমি আবার জন্ম নিয়েছি। না আমি যদি আবার জন্ম নিতাম তাহলে তো মোহিনী কে আমি চিনতাম। আকাশের দিকে তাকায় অনেক মেঘ। প্রচুর গরম। বাড়িতে আসে দেখে অনেক গন্ধরাজ ফুল ফুটে আছে। সন্ধ্যা থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। ড্যানিয়েল বার বার ভাবতে থাকে মোহিনী বলেছে বৃষ্টি পরলে সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। রাত নয়টা গ্রামের বাড়িতে সবাই এই সময় ঘুমাতে যায়। ড্যানিয়েল অনেক গুলো রজনীগন্ধা ফুলের ডাল ছিরে হাতে নেয়। একটা ছাতা নিয়ে হাটতে থাকে আর হাটতে থাকে। ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়ছে আকাশ ভেঙে। রাস্তায় কোন মানুষ নাই। ড্যানিয়েল চলে আসে মোহিনীর সেই পুকুর পারে। ড্যানিয়েল চেয়ে দেখে মোহিনী হাতে একটা হারিকেন নিয়ে সেই লাল সাদা পাশ পারের শাড়ি পরে ধীরে ধীরে ড্যানিয়েলর দিকে হেঁটে আসছে। পায়ে নুপুরের শব্দ। হারিকেনের আলোতে পায়ের আলতা দেখা যাচ্ছে। ড্যানিয়েল সামনে এসে বলে কি আজ মোহিনীকে চিনতে পেরেছ রাজ। রাজ রজনীগন্ধ ফুল গুলো মোহিনীর হাতে দেয়। মোহিনী ফুল গুলো নিয়ে বলে আমি জানি রাজা সাহেব তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে। ড্যানিয়েল বলে মোহিনী আমিই তোমার রাজা সাহেব। আমাকে যে আসতেই হবে শত জন্মের পর জন্মে। আমি এসেছি মোহিনী। রাজা সাহেব দেখ আজ পুকুরে কত লাল শাপলা কত সুন্দর পুকুরের জল। রাজা সাহেব তুমি নামবে না।
চল মোহিনী চল এই পুকুরের জলে আমরা অনন্ত কালের জন্য মিলে যাই।মোহিনী ড্যানিয়েল কে নিয়ে পুকুরে নেমে যায়। বৃষ্টি আর বৃষ্টি সারা রাত বৃষ্টি।।
সকালে একজন বলে পাল পারার পুকুরে নাকি একটা লাশ ভেসে উঠেছে। শত শত মানুষ বৃষ্টির মধ্যে পাল পাড়া পুকুরের কাছে যায়। সবাই চেয়ে দেখে দেওয়ান বাড়ির ছেলে ড্যানিয়েলের লাশ পুকুরে ভাসছে………………………..