‘ব্লু হোয়েল’ এর সাতকাহন

 

শত প্রাণ কেড়ে নেয়া অনলাইন গেম ‘ব্লু হোয়েল’ এর প্রতিষ্ঠাতা ২২ বছর বয়সি রাশিয়ান যুবক ফিলিপ বুদেকিনের ভাষায় এই গেম খেলে আত্মহত্যাকারী টিনেজাররা হচ্ছে ‘বায়োলজিক্যাল ওয়াস্ট’! যাদেরকে সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা তিনি নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেন(There are people – and there is biological waste. Those who do not represent any value for society. I was cleaning our society of such people)।

‘ব্লু হোয়েল’ গেমটি শুরু হয় ২০১৩ সালে, রাশিয়ায়। গেমটির সূত্রপাত ঘটে ‘ভিকোন্তাকে’ নামক সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, যার পরিচালক ছিল ‘এফ৫৭’। এফ৫৭ মূলত ‘ডেথ গ্রুপ’ নামে পরিচিত।

গেমটির ফাঁদে পা দিয়ে সর্বপ্রথম ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল জুলিয়া ওভা এবং ভের্নিয়া ওভা নামের দুই বোন। আত্মহত্যার আগে জুলিয়া ওভা সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি নীল তিমির ছবি আপলোড করে লিখে গিয়েছিল ‘The End’! সাগরের নীল তিমিরা মৃত্যুর আগে তীরে উঠে আসে। অর্থাৎ ধরে নেয়া হয় যে নীল তিমি সুইসাইড করার জন্যই তীরে আসে। তাই নীল তিমির এই সুইসাইডাল বৈশিষ্ট্যের জন্যই গেমটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ব্লু হোয়েল’। বিতর্কিত অনলাইন গেম যার নাম বাংলা করলে নামটি দাঁড়াবে ‘নীল তিমি চ্যালেঞ্জ’। তবে গেমটি ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ, পর্পকর্ন কার্নিভাল সহ আরো বিভিন্ন ছদ্মনামে লুকিয়ে আছে ইন্টারনেটের ডার্ক ওয়েভে।

২০১৬ সালের এই ঘটনাটি প্রথমবার সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরেন রাশিয়ান এক সাংবাদিক। অল্প সময়ের মধ্যে এত জন সমবয়সীর আত্মহত্যার ঘটনায় টনক নড়ে পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে প্রশাসনিক পর্যায়েরও। তদন্তকারী কর্মকর্তারা খুঁজতে খুঁজতে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যেন সাপই বেরিয়ে আসে। একটি-দুটি নয়, গোটা বিশ্বে প্রায় ১৩০টি আত্মহত্যার কেস এবং তার সাথে ‘ব্লু হোয়েল’ গেমটির সম্পৃক্ততার ব্যাপারে নিশ্চিত হন তারা।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার তথ্যানুসারে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়াতে এই মরণঘাতী ব্লু হোয়েলের থাবা পড়েছে গত মাসেই (সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৭)। মানপ্রিত সিং নামে ১৪ বছর বয়সি কিশোরের ৭ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার পেছনে ব্লু হোয়েল গেমটি জড়িত বলে ধারণা করছে কিশোরের পরিবারসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তবে গেমটির অন্যতম একটি অংশ ব্লেড দিয়ে শরীরে নীল তিমির ছবি আঁকার বিষয়টি প্রত্যক্ষ হয়নি ওই কিশোরের ক্ষেত্রে।

“রাজধানীর হলি ক্রস বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার (১৩) নিজের শোবার ঘরে ফ্যানের সাথে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার বিষয়টিকে বাংলাদেশে সংঘটিত প্রথম ব্লু হোয়েল সুইসাইডাল কেস বলে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালগুলো ইতোমধ্যেই সোশাল মিডিয়া ছেয়ে ফেলেছে। তবে গত রবিবার (৮ অক্টোবর) দুপুরের দিকে নিহত কিশোরীর পিসি তার নিজ ফেসবুক প্রোফাইলে একটি পোস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করেন যে, স্বর্ণার মৃত্যুর পিছনে ব্লু হোয়েল দায়ী নয়।

স্বর্ণার পিসী কেয়া চৌধুরী জুঁই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লোক প্রশাসন বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি তার ফেসবুক প্রোফাইলে স্বর্ণার আত্মহত্যার পেছনে ব্লু হোয়েলের খবরটি ভুয়া প্রমাণ করে এই পোস্ট করেছেন।

তার পোস্ট থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, স্বর্ণার আত্মহত্যা কোনো গেইমের কারণে হয়নি। তিনি বলেছেন, স্বর্ণার শরীরে কোনো প্রকার কাটা-ছেঁড়া বা কোনো প্রকার দাগ ছিলো না, এমনকি তার মোবাইলেও এ ধরণের কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি বলে তিনি জানান।

তবে ঠিক কি কারণে এই আত্মহত্যা এই মৃত্যু সে ব্যাপারে তিনি কিংবা কিশোরীর পরিবার কেউ সঠিক বলতে পারছেন না। সব শেষে তিনি সবার কাছে এই অনুরোধ করেছেন যেনো এ ঘটনা নিয়ে আর কোনো গুজব রটানো না হয়।”

আজ ও “নিশ্চিত মৃত্যুর ফাঁদ হিসেবে বিশ্বের আতংকিত ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম খেলতে গিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন হৃদয় (২০) নামে এক তরুণ।”

গেমটির জন্মস্থান রাশিয়াতে এখন পর্যন্ত মোট ১৫১ জন কিশোর-কিশোরী এই গেম খেলে আত্মহত্যা করেছে বলে জানিয়েছেন গেমটির প্রতিষ্ঠাতা ফিলিপ বুদেকিন। রাশিয়ার বাইরে আত্মহত্যা করেছে আরো ৫০ জন। এদের মধ্য থেকে মাত্র ১৭ জনকে ফিলিপ বুদেকিন নিজে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করেছেন বলে জানিয়েছেন। বাকিরা নিজ উদ্দ্যোগেই ফিলিপের সাথে যোগাযোগ করে আত্মহত্যা করেছে।

গত জুন মাসে মস্কো থেকে ফিলিপকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সাইক্রিয়াটিস্টরা তাকে বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হবার আগ পর্যন্ত ফিলিপ একজন সাইকোলজির শিক্ষার্থী ছিলেন এবং বর্তমানে তিনি ‘ব্লু হোয়েল’ গেম দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে ১৭ জন টিনেজারকে সুইসাইড করানোর অপরাধে ৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে রাশিয়ার ক্রেস্টি জেলে আটক আছেন।

এটা এমন একটা গেম যেটা গুগল প্লে স্টোর বা অন্য কোথাও থেকে ডাউনলোড করা যাবে না। অর্থাৎ, আপনি চাইলেই গেমটি ডাউনলোড করে খেলা শুরু করতে পারবেন না। তবে আলোচনায় আসার পরে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংস্থা এই গেমের ফেক ভার্সন বের করে ছড়িয়ে দিয়েছে অনলাইনে। অর্থাৎ, সার্চ দিয়ে আপনি যদি ব্লু হোয়েল গেম খুঁজে পান, তবে নিশ্চিত থাকুন সেটি নকল। এই গেম খেলার জন্য অ্যাডমিন প্যানেল আপনাকে নির্বাচন করবে। উল্লেখ্য-

১। গেইম টা পিসি গেইম। (কোন Android গেমস না)

২। গেইম টা রিয়েল আইপি ছাড়া লগইন করা যায় না।

৩। গেইম টা অনলি ডার্ক ওয়েবে পাওয়া যায় (৯০% বাংলাদেশী মানুষ ডার্কওয়েব নামই শুনছে কিনা সন্দেহ)।

৪। ডার্ক ওয়েবে আপনি কোন স্ক্রিন শর্ট নিতে পারবেন না।

৫। ডার্ক ওয়েব এর ওয়েবসাইট হয়, লিংক নয়। সেসব ওয়েবসাইটে ক্রোম, ফায়ারফক্স মানে নরমাল কিছুর সাহায্যে ঢুকতে পারবেন না।

৬। গেইম টা বিট কয়েন (ইন্টারনেট কারেন্সি) দিয়ে কিনতে হয় । ১ বিট কয়েন = ৪০০০+ ডলার । আর ১ ডলার = ৮২ টাকা!

৭। এটা কোন Apk or exe ফাইল না, ব্রাউজ করে খেলতে হয়।

গেমটিকে মোট ৫০টি লেভেলে সাজানো হয়েছে যা ৫০ দিনে সম্পন্ন করতে হয়। যার প্রথম দশটি লেভেলকে নিতান্ত মামুলি ধরে নেয়া যায়। যেমন : ভোর ৪:২০ এ ঘুম থেকে ওঠা, রাতে হরর মুভি দেখা, পছন্দের কোন খাবার খাওয়া, সারাদিন কারো সাথে কথা না বলা, একা ছাদের রেলিং ধরে হাঁটা, অ্যাডমিনের পাঠানো ভয়ঙ্কর কোন মিউজিক শোনা ইত্যাদি।

১১-২০ লেভেল আগের চেয়ে খানিক উচ্চতর। যেমন : শীতের মধ্যে খালি গায়ে থাকা, সারা রাত না ঘুমানো, গভীর রাতে কবরস্থান থেকে ঘুরে আসা ইত্যাদি। মূলত ১৫ নাম্বার লেভেল পর্যন্ত অ্যাডমিন ভিকটিমের সকল ব্যক্তিগত তথ্য বিভিন্ন কৌশলে হাতিয়ে নিতে থাকে। আর ২০ নাম্বার থেকে ৩০ পর্যন্ত চলতে থাকে কঠিন সব চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে ড্রাগ অ্যাডিকশন একটি। নির্ঘুম রাত কাটানো এবং ড্রাগ অ্যাডিকশনের ফলে এ সময় টিনেজারদের হিপনোটাইজ করা যায় সহজেই।

অর্থাৎ, কিউরেটর বা অ্যাডমিন যা বলে ভিকটিম তাই করতে থাকে। খুব কাছের বন্ধুর সাথে চরম দুর্ব্যবহার, বাবার পকেটের টাকা চুরি, কোন প্রাণীকে খুন করা ইত্যাদি অসংলগ্ন কাজগুলো ভিকটিম ঘোরের বশেই করতে থাকে। এই গেমের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রত্যেকটা টাস্ক শেষ করে সেটার ভিডিও বা ছবি অ্যাডমিনকে পাঠানো এবং একবার এই গেমটি ফোনে ইন্সটল করলে এটা আর কিছুতেই আনস্টল করা যায় না। আর এখানে প্রতিটা টাস্কের শেষেই অ্যাডমিন ভিকটিমদের পয়েন্ট দিয়ে থাকে। এখানে একজন ভিকটিম অন্যান্য ভিকটিমদের দেয়া ভিডিও/ছবি/প্রাপ্ত পয়েন্টের আপডেট পেতে থাকে প্রতি মুহূর্তে। তাই চাইলেও গেমটিকে ভুলে থাকা যায় না এবং অন্যদের চেয়ে নিজের পয়েন্ট বেশি করার জন্য কিউরেটরের দেয়া টাস্কগুলো ভিকটিমরা যথাযথ ভাবেই করতে থাকে।

শুরু থেকে ৩০ নাম্বার লেভেল পর্যন্ত এসে আপনি যখন গেমটির প্রতি বেপরোয়া, তখন কিউরেটর একটা মজার চাল চালেন। ৩১ নাম্বার লেভেলটা আর আনলক করেন না। এদিকে নেশাগ্রস্থ আপনার অবস্থা তখন বেহাল। তারপর হঠাৎ একদিন কিউরেটর আপনাকে সারপ্রাইজ স্বরূপ গেমটির ৩১ নাম্বার লেভেল আনলক করে দেন। গেমটির ৩১-৪০ লেভেল পর্যন্ত কাজগুলো রীতিমত বীভৎস এবং অমানবিক। এখানে আপনার নগ্ন ছবি থেকে শুরু করে প্রেমিক/ প্রেমিকার সাথের সেক্সুয়াল ভিডিও পর্যন্ত পাঠাতে হয় কিউরেটরকে। ব্লেড দিয়ে নিজের শরীরে ব্লু হোয়েল আঁকা তো আছেই! ৪০তম লেভেলের পর আপনি যখন ভীত হয়ে গেমটি ছেড়ে দেয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করবেন তখন আপনার পাঠানো তথ্যগুলো দিয়েই শুরু হবে আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করা। এগুলো পরিবার এবং বন্ধুদের কাছে প্রকাশ করা হবে এমন হুমকি চলতে থাকবে। আপনি গেম থেকে সরে যেতে চাইলে আপনার আত্বীয় এবং বন্ধুদের মেরে ফেলার হুকমিও দেয়া হবে। যদিও এই হুমকিগুলোর কোন ভিত্তি নেই তারপরও নেশাগস্থ হিপনোটাইজড আপনার কাছে সবই সত্য বলে মনে হবে।

৫০ এবং সর্বশেষ টাস্কটি হচ্ছে আপনার মৃত্যু। আপনি যখন গেম থেকে মুক্তির জন্য পাগলপ্রায় তখন আপনাকে জানানো হবে মৃত্যুই আপনার মুক্তির পথ এবং সম্মোহিত বা হিপনোটাইজড অবস্থায় সুইসাইডের মধ্য দিয়েই শেষ হবে গেমটি।

এখন কথা হচ্ছে এই গেমটি থেকে বাঁচার উপায় কী? উত্তর একটাই- আত্মবিশ্বাসী হওয়া। আপনি সাহসী কি না সেটা তো আপনি নিজেই জানেন। কারো পাতা ফাঁদে পা দিয়ে অসুস্থ কাজ কারবার করে নিজেকে সাহসী প্রমাণ করার চেষ্টা করার মানে আপনি আসলেই ভীতু। হতাশা কাটানোর জন্য সুইসাইড করা আর মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা সমান কথা। ফিলিপ বুদেকিনের কাছে আপনি বায়োলজিক্যাল ওয়াস্ট এবং সত্যিকার অর্থেই আপনি তাই। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আপনি যাই হোন না কেন আপনার পরিবারের কাছে আপনি নিঃসন্দেহে যথেষ্ট দামি।

সর্বশেষ কথা, মানুষ তাই নিয়ে কৌতূহলী থাকে যা তার অজানা। এই গেম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার মানে এই না যে, আপনি আগ্রহী হয়ে খেলার জন্য এটা খোঁজাখুঁজি শুরু করবেন। আপনাকে জানানোর উদ্দেশ্য এই যে, এই ফাঁদ থেকে দূরে থাকুন।

উৎসঃ ইন্টারনেট অবলম্বনে।

সম্পাদনায়- মাহবুব এইচ শাহীন/প্রকাশক ও সম্পাদক/কাগজ২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!