ভারতের অবস্থান, আমাদের রাজনীতি

নিজের দেশের মানুষ হত্যা করছে মিয়ানমার, যা গণহত্যা হিসেবে ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি পেয়েছে। আগুন দিয়ে ঘর- বাড়ি জ্বালিয়ে এবং গুলি করে, তাড়িয়ে দিয়েছে দশ লক্ষাধিক মানুষ। তাড়িয়ে দেওয়া রোহিঙ্গা নামক দশ লক্ষাধিক মানুষকে আশ্রয় দিয়ে, গণহত্যা- নিপীড়নের প্রতিবাদ করছে বাংলাদেশ। একটা খুনি- বর্বর রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীতে আলোচিত – সমালোচিত নাম মিয়ানমার। আর বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর কাছে পরিচিত সংবেদনশীল – মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে। বিশ্ব রাজনীতিতে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক দুই বড় শক্তি চীন- ভারত কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত।

জাতীয়- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কঠিন সময় যাচ্ছে বাংলাদেশের। প্রথমাবস্থায় সরকার যখন ‘কি করব কি করব’ ভাবনায় সিদ্ধান্তহীন ছিল, পরিস্থিতি তখন বাংলাদেশের জন্যে অনেক বেশি প্রতিকূল মনে হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গণের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস সঠিক সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে কার্যকর দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারও তার দ্বিধা- দ্বন্দ্ব, সিদ্ধান্তহীনতা কাটিয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যা ঘটছে, তার পুরোটা এখন আর বাংলাদেশের প্রতিকূলে নয়। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি – কূটনীতির বিষয় নিয়ে আজকের পর্যালোচনা।

০১. মিয়ানমারের প্রতিকূল সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু চীন। যে দেশে সামরিক শাসন বা কট্টর একনায়ক থাকে, চীন সে সব দেশে আনন্দের সঙ্গে বাণিজ্য করে। জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে না হওয়ায়, একনায়ককে ক্ষমতায় থাকার সমর্থন নিশ্চিত করা চীনের নীতি। এই নীতিতে তারা মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে বহু বছর।

অং সান সু চি’র নেতৃত্বে দৃশ্যমানভাবে গণতন্ত্রের আবহ তৈরি হলেও, ক্ষমতা এখনও সেনাবাহিনীর হাতেই। সামরিক সরকার ক্ষমতায় রেখে মিয়ানমারের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের উপর একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে চীন। সামরিক আধিপত্যের ক্ষেত্রেও মিয়ানমার অবস্থানগত কারণে চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ।

চীন যখন মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের সমর্থন দিয়ে গেছে, ভারত তখন গণতন্ত্র নেই বলে মিয়ানমার থেকে দূরে থেকেছে। আমেরিকার নীতিতে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের উপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেছে। ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে দূরত্ব যতটা বেড়েছে ভারতের, ঠিক ততটা বা তার চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে মিয়ানমার- চীনের মধ্যে। আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার হয়ে উঠতে থাকা ভারত এখন মনে করে যে, তার মিয়ানমার বিষয়ে পূর্বের নীতি সঠিক ছিল না। এই নীতিতে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে চীনের।

সু চি’র ক্ষমতা না থাকলেও গণতন্ত্রের একটা সিল আছে। এই গণতন্ত্রে সামরিক বাহিনী শক্তিশালী অংশীদার। চীনের নীতি সু চি’র অবস্থান দূর্বল করে সরকারে সামরিক বাহিনীর প্রভাব আরও বৃদ্ধি করা। সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা যত বাড়বে চীনের জন্যে ততই সুবিধা।

ভারতের জন্যে উল্টো চিত্র। ভারত মনে করে যে প্রক্রিয়ায়, যত কম ক্ষমতাই থাক, সু চি বা গণতন্ত্র থাকলেই মিয়ানমারে তার স্বার্থ রক্ষা করা সহজ হবে। সামরিক সরকার চীনের স্বার্থই দেখবে, ভারতের নয়। এই নীতিতে মিয়ানমারে ভারত তার অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছে। মিয়ানমারের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সামরিক কৌশলগত কারণেও ভারত সেখানে জোরালো উপস্থিতি রাখতে চায়। অনেকটা পেরেছেও।

০২. রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিপদে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছে। এই সময় আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন বাংলাদেশের জন্যে জরুরি। বিশেষ করে ভারতের সমর্থন। ভারতের নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ বাংলাদেশ গত আট নয় বছরে নি:স্বার্থভাবে দেখেছে। বাংলাদেশ সরকার প্রচারও করে যে, ভারত সব সময় আমাদের সঙ্গে আছে।

সেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন মিয়ানমারের পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশের পাশে না দাঁড়িয়ে, তখন শেখ হাসিনা সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায়। বিব্রতকর অবস্থা হয় ভারতের জন্যেও। দুই কূল রক্ষা করার নীতি নিয়ে এগুতে হয় ভারতকে। দিল্লী কূটনীতির খোঁজ- খবর রাখা ভারতীয় সাংবাদিকরাও বিশ্লেষণ করছেন পরিস্থিতি।

ভারতের বিপদ দুই দিকেই। মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে হৃদ্যতা রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। আবার বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিলে, মিয়ানমার পুরোপুরিভাবে চীনের দিকে চলে যাবে। বড় ভাবে বিঘ্নিত হবে ভারতের স্বার্থ। বাংলাদেশ তার দূর্বল নিজস্ব কূটনীতি দিয়ে ভারতের ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেনি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পর্যন্ত যেতে পেরেছি, বেশ কয়েকদিন পরে। বাংলাদেশ ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেছে। বাংলাদেশের অনুরোধে রাষ্ট্রদূত ভারতে গেছেন, মোদী প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে এক ধরণের সমাধান ফর্মূলা নিয়ে এসেছেন।

ভারত যা বলেছে বাংলাদেশকে-

ক. ভারতের ভেটো পাওয়ার নেই, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যও নয়। ভারত যদি বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়, তাতে বড় কোনও উপকার হবে না । ভারত চাপ দিলেও মিয়ানমার তা শুনবে না। নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে ভেটো দেবে চীন। ভারত কিছু করতে পারবে না। এতে চীন আরও চেপে বসবে মিয়ানমারের উপর।

খ. বিরোধীদল বা সমালোচকদের কাছে শেখ হাসিনা সরকারের মুখ রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে ভারত। বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য পরিমান ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে।

গ. রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বলবেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে আছে ভারত। যা রাষ্ট্রদূত ইতিমধ্যেই বলেছেন।

ঘ. এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ফোন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সময় সুযোগ মত নরেন্দ্র মোদীও ফোন করতে পারেন শেখ হাসিনাকে। ফোন করার অর্থ বাংলাদেশের জনগণকে বোঝানো যে, ভারত সঙ্গে আছে।

ঙ. ভারত সরাসরি ফোন করে অং সান সু চি’কে বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কথা বা বিবৃতি দিয়ে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া জাতীয় কিছু করবে না।

০৩. কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অং সান সু চি’কে ফোন করে চাপ দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে সঙ্গে থাকার কথা বলার চেয়ে, সু চি’কে ফোন করে চাপ দেওয়া অনেক কার্যকরি। নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদার বৈঠকে মিয়ানমারকে নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। চীন তাতে বিরোধীতা করেনি। আবার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রস্তাব আনা যায়নি চীনের বিরোধীতার কারণে। রুদ্ধদার বৈঠকে ভেটো প্রয়োগের ব্যাপার ছিল না। থাকলে চীন ভেটো দিত।

চীনের অবস্থান পুরোপুরি মিয়ানমারের পক্ষে। ‘চীনের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে’- সরকারের কেউ কেউ যা বলছেন, এই বক্তব্যের ভিত্তি নেই।

ভারত তার কৌশলগত অবস্থান পরিস্কার করেছে। চীন তার স্বার্থে কাজ করছে, ভারতও তার নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবে। এই সাধারণ বিষয়টি মেনে নিয়ে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারণ করতে হবে। ‘এখন ভারত কোথায়’- এসব কথা বলে বিরোধীদল সরকারকে বিব্রত করে সুবিধা নিতে চাইছে। সরকারও মরিয়া হয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে ‘ভারত পাশে’ আছে। বাস্তবে ভারত যা বলছে না, যে কথার অর্থ যা নয়- সেটা বলার চেষ্টা করছে সরকার এবং তার সংশ্লিষ্টরা। এটা একটা দেশের সঠিক নীতি হতে পারে না।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তার বাইরে সে যাবে না বা যেতে পারবে না। প্রকাশ্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে না। মিয়ানমারে ভারতের স্বার্থ রক্ষার জন্যে তা সম্ভব না। এই বাস্তবতা বাংলাদেশকে মেনে নিতে হবে। চীনের ক্ষেত্রেও একই কথা। ভারত বা চীনের দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকাটা বোকামী। ভারত বা চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। ক্ষমতায় থাকার সমর্থনের জন্যে সুবিধা দেওয়ার নীতির অনেক বিপদ আছে। যা এখন দৃশ্যমান।

যাকে সুবিধা দেওয়া হবে, বিনিময়ে বাংলাদেশ যাতে উপকৃত হয়- সেটাই হওয়া উচিত রাষ্ট্রীয় নীতি।

ভারত নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার নীতি থেকে বের হয়ে আসা দরকার বিরোধীদল বিএনপিকে। আর সরকারের উচিত ভারত- চীন তোষণ নীতি পরিত্যাগ করা। ভারত যেহেতু কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না, বাংলাদেশের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কৌশল নির্ধারণ করা দরকার। অসত্য- অর্ধসত্য তথ্য প্রচার করা থেকে সরকারের অন্তত বিরত থাকা উচিত।

বড় ভাবে তাকাতে হবে পৃথিবীর দিকে। ভারত- চীন ছাড়াও পৃথিবীতে দেশ আছে। যারা আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে। অকারণে আমেরিকার সঙ্গে ঝগড়া করার নীতি ত্যাগ করা জরুরি।

ইইউ পার্লামেন্ট রোহিঙ্গাদের পক্ষে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। অবরোধের মত পদক্ষেপ তারা নিতে পারে। সু চি’র পাওয়া শাখারভ পুরস্কার প্রত্যাহারের কথাও তারা ভাবছে। আমেরিকার এখন পর্যন্ত অবস্থান রোহিঙ্গাদের পক্ষে। শুরুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশের যে দুরবস্থা চলছিল, তার অনেকটাই কেটে গেছে।

বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে জাতিসংঘের শক্ত অবস্থান, ইইউ পার্লামেন্টের তারচেয়ে জোরালো অবস্থান নেওয়ার নেপথ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নিজে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন, ১২ জন নোবেল বিজয়ীসহ ৩৩ জন জনকে সঙ্গে নিয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন। নিজে দুবাই ভিত্তিক দ্য ন্যাশনালে আর্টিকেল লিখেছেন। বিবিসি- সিএনএনসহ প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অত্যন্ত জোরালো ভাষায় কথা বলেছেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৪০ টি দেশের কূটনীতিকদের রোহিঙ্গা আশ্রিত এলাকায় নিয়ে গিয়ে ভালো একটি কাজ করেছে।

ইইউ পার্লামেন্ট মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবরোধও আরোপ করতে পারে, এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কূটনীতিকদের নিজেদের চোখে রোহিঙ্গাদের দূর্দশা দেখা এবং ড. ইউনূসের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরও অনেক কিছু করতে হবে। সরকার একটু উদারতার পরিচয় দিয়ে দেশের স্বার্থে ড. ইউনূসকে কাজে লাগাতে পারত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে যাচ্ছেন। সেখানে কথা বলবেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে। শুধু কথা বললে হবে না। বিশ্ব নেতৃবন্দের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করাটা জরুরি।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এক্ষেত্রে আমাদের কূটনীতি অত্যন্ত দূর্বল। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে প্রভাবিত করতে পারেন, ড.ইউনূসের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এই মুহূর্তে শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীতে কম আছেন। বাংলাদেশ সরকারের এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে উপলদ্ধি করা দরকার, দেশ ও জনগণের স্বার্থে।

গোলাম মোর্তোজা : সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail.com

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!