ভারতের ‘যৌনতার মন্দির’

 

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সমকামী সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরণের আঘাত আসে। দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতাকে অপরাধ বলে রায় দেয়। এ বছরের আগস্টে ভারত সরকার ৮ শতাধিক পর্নো ওয়েবসাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে কয়েকদিন পরই ওই নিষেধাজ্ঞা শর্তস্বাপেক্ষে প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ভারত এমনটি ছিল না আগে। ১৩ শতাব্দীর আগেও ভারত ছিল অবাধ যৌনতার উর্বরভূমি।

কয়েক শতক ধরে ভারত খুবই রক্ষণশীল। দেশটির কয়েকটি গোষ্ঠীর অতিনৈতিকতাবাদের ফসল এটি। এছাড়া ইসলামী শাসন, বৃটিশ শাসন ও ভারতের নিজস্ব অভিজাত ব্রাহ্মণ সমাজও এ ক্ষেত্রে কিছুটা দায়ী। অথচ ১৩ শতাব্দীর আগেও আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত ছিল যৌনতা। পড়ানো হতো কামসূত্র, যেটি বিশ্বের সর্বপ্রথম যৌনতা বিষয়ক গ্রন্থ। প্রাচীন ভারতে অর্থাৎ ৪০০-২০০ খ্রিস্টপূর্বে গ্রন্থটি লেখা হয়। দেশটির বহু জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অবাধ যৌনতার নিদর্শন। এমনই একটি মন্দির পূর্ব ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের কোনার্কের সূর্য মন্দির। ১৩ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটির দেওয়ালে ও সর্বত্র খাঁজ কেটে দেখানো হয়েছে বিভিন্ন যৌন প্রবৃত্তি। মহারাষ্ট্রের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মন্দির অজন্তা (দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও এলোরার (পঞ্চম ও দশম শতাব্দীর) বিভিন্ন চিত্রকলা ও মূর্তিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ব্যাপক নগ্নতা। তবে যৌন শিল্পের সবচেয়ে বেশি উদাহরণ পাওয়া যায় ভারতের মধ্যাঞ্চলের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ছোট্ট শহর খাজুরাহোতে। এখানে বহু হিন্দু মন্দির অবস্থিত, যেগুলোকে ১৯৮৬ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে ইউনেস্কো। চান্দেলা বংশ এ মন্দিরগুলো নির্মান করে ৯৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে। তবে মূল ৮৫টি মন্দিরের মধ্যে মাত্র ২২টি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। বিবিসি’র একটি ভ্রমণ-প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে মন্দিরগুলোর বিস্তারিত দিক।

৬ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত মন্দির এলাকা। মন্দিরে প্রতিদিন স্থানীয় নারীরা ফুল দিয়ে প্রার্থনা করে। দর্শণার্থীদের প্রায়ই দেখা যায় করিডোর ধরে ঘুরে বেড়াতে। জটিল ও খোলামেলা মূর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে অনেকে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। মন্দিরগুলোর প্রতিটি ইঞ্চি জুড়ে খোদাই করা রয়েছে বিভিন্নভাবে যৌনমিলনরত অজস্র মূর্তি। মূর্তির মধ্যে রয়েছে দেব-দেবী, যোদ্ধা, গায়ক, প্রাণী, পাখি, ইত্যাদি। কিছু কিছু মূর্তি প্রগাঢ় যৌনতাবিশিষ্ট। পশু কিংবা দুইয়ের অধিক সঙ্গি বিশিষ্ট যৌনতাও অঙ্কন করা হয়েছে সেখানে।

এসব মন্দির স্থাপনের কারণ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য থিওরি হলো, চান্দেলা বংশের রাজারা তান্ত্রিক নীতির অনুসারী ছিলেন। তাদের বিশ্বাসের মধ্যে নারী ও পুরুষ শক্তির মধ্যকার ভারসাম্যের কথা বলা আছে। তাদের বিশ্বাসের প্রতিফলনই তারা ঘটিয়েছে নিজেদের নির্মিত মন্দিরগুলোতে। অনেকের ধারণা, যৌনকর্মের চিত্রাঙ্কনকে শুভ লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কেননা, এর মাধ্যমে নতুন সূচনা ও নতুন জীবনের আরম্ভকে বোঝানো হতো। অনেকের মতে, এ মন্দিরগুলো ছিল প্রার্থণা ও শিক্ষার স্থল। এর বাইরেও, হিন্দুমতে, ঐতিহ্যগতভাবেই যৌনতা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধারণা করা হয়, এ মন্দিরগুলোতে যৌনতাকে আড়াল করার কোন চেষ্টা করা হয়নি। এর প্রতিষ্ঠাতারা চেয়েছিলেন সবাই এসব দেখুক।

কিন্তু এ মন্দিরগুলো খাজুরাহোতেই কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা কারোই জানা নেই। আদৌ এ অঞ্চলে কোন রাজ্য ছিল কিনা, তার পরিষ্কার বর্ণনাও কোথাও নেই। কিন্তু হাজার বছর ধরে এ মন্দিরগুলো টিকে রয়েছে কীভাবে? ধারণা করা হচ্ছে, এ এলাকায় খুবই গভীর বনাঞ্চলের কারণে মন্দিরগুলো বহুবছর ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। এ কারণেই এসব টিকে ছিল এতদিন। ১৮৩৮ সালে বৃটিশ ক্যাপ্টেন টিএস বার্ট সর্বপ্রথম এসব আবিষ্কার করেন। এমনকি বার্ট নিজেও গভীর জঙ্গলের ভেতর অভিযান চালানো নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেননি, এর ভেতর উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া যাবে। তবে তার ভারতীয় সঙ্গীরাই তাকে বুঝিয়ে রাজি করায়।

আশ্চর্য্যজনক হলেও, ভারতের ‘নৈতিকতা’ বাহিনীর রোষাণলের মুখে কখনও পড়েনি মন্দিরগুলো। যদিও সালমান রুশদির বইয়ে ও এমএফ হুসেনের চিত্রকলায় হিন্দু দেবীকে যৌনরূপে চিত্রায়িত করার জন্য তাদের দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হলো, মন্দিরে ভারতীয় অনেক পরিবার দর্শণার্থী হিসেবে আসে। গাইড তাদেরকে এ মন্দিরের ইতিহাস জানায় ও মূর্তিগুলোর অর্থ ব্যাখ্যা করে। কিন্তু সবাই নীরবে সেসব হজম করে। কারও চোখেমুখে ভ্রƒকুটি দেখা যায় না। কেউ বিব্রত হয়ে একে-অপরের দিকে তাকায় না। কারও মুখে নেই মুচকি হাসি। সবাই গম্ভীর হয়ে সব শুনে যায়। কেন? কারণ, ধর্মীয় দিক থেকে এসব যৌনতায় হয়তো কারও আপত্তি নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!