ভাষা সৈনিক : দুটি ব্যতিক্রমিক খবর
ভাষা সৈনিক : দুটি ব্যতিক্রমিক খবর
রণেশ মৈত্র (একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
আমি সম্প্রতি ঢাকার দু’তিনটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের কথা বলছি। ভাষা সৈনিকদের নিয়ে তাঁদের সন্তানে, রাজশাহীতে‘ সেখানকার জেলা প্রশাসক মো: আবদুল জলিল যে অসাধারণ ঘটনা ঘটিয়েছেন এবং নারায়নগঞ্জের মর্গ্যম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সেখানকার একজন বীর ভাষা সৈনিককে যে ঘটনা ঘটালেন তা সমগ্র বাংলাদেশের ভাষা সৈনিকদের মনে যথেষ্ট উৎসাহ জোগাবে। অন্তত: আমার মনে তো জুগিয়েছেই।
প্রথম যে খবরটি নজরে পড়েছিল তাহলো ঐ তারিখের ‘জনগণ্ঠে’ দেশের খবর শীর্ষক ১০ নং পৃষ্ঠায় “উপহার নিয়ে দুই ভাষা সৈনিকের বাড়ীতে হাজির রাজশাহীর ডিসি” শীর্ষক খবর। তাতে বলা হয়েছে “অমর একুশে ফেব্রুয়ারিতে এবার ভাষা সংগ্রামীদের বাড়ীতে গিয়ে সম্মান জানালেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল। রবিবার সকালে তিনি ফুল, ফল ও মিষ্টি নিয়ে সম্মান জানাতে ছুটে যান রাজশাহীর দুইভাষা সৈনিকের বাড়ীতে।
রবিবার বেলা সাড়ে এগারটার দিকে জেলা প্রশাসক মো: আবদুল জলিল প্রথমে মহানগরীর বেলদারপাড়া এলাকায় থাকা ভাষা সৈনিক মোশারফ হোসেন আকুঞ্জির বাড়ীতে যান। এ সময় জেলা প্রশাসক তাঁকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান এবং প্রধানমন্ত্রীর উপহার স্বরূপফল ও মিষ্টি উপহার দেন। পরে তিনি এ ভাষা সৈনিকের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
আকস্মিক এ সাক্ষাতে ভাষা সৈনিক মোশারফ হোসেন আকুঞ্জি রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের কাছেএকটি দাবী তুলে ধরেন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকার পর এখনও সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন হয় নি। তাই এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক যেন দ্রুতব্যবস্থা নেন।
এরপর দুপুর বারটার দিকে জেলা প্রশাসক মহানগরের শান্তিনগরে থাকা অপর ভাষা সৈনিক আবুল হোসেনের বাসায় যান। তিনি তাঁকেও ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। পরে জেলা প্রশাসক তাঁর শারীরিক অসুস্থতা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। যে কোন প্রয়োজনে পাশে থাকার কথা জানান এবং ১৯৫২ সালে তাঁর অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া ফল ও মিষ্টি উপহার দেন।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তিনি গতানুগতিক তার বাইরে এসে দু’জন সম্মানিত ভাষা সৈনিকের বাড়ীতে অতর্কিতে ছুটে গিয়ে যে শুভেচ্ছা ও উপহার দিলেন-তা আর্থিক মূল্যে নয়-আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাশীলতার ক্ষেত্রে অসাধারণ এবং ঘটনা হিসেবে অভূতপূর্ব। বাংলাদেশের কোথাও অতীতে বা বর্তমানে অন্য কোন জেলা প্রশাসক ভাষা-সৈনিকদের বাড়ীতে গিয়ে স্বয়ং শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং উপহার সামগ্রী তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছেন এমন কোন নজির নেই। আর প্রধানমন্ত্রীর নামে উপহার তুলে দিয়ে তিনি তাঁকেও সম্মানিত করেছেন। যতটুকু বুঝি, ঐ উপহার সামগ্রী পূরোটাই তাঁর নিজস্ব কারণ প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে দেওয়া হলে তা শুধুমাত্র রাজশাহীর ভাষা সৈনিকদের জন্যে উপহার সামগ্রী পাঠাবেন এমনটি হতে পারেনা। প্রধানমন্ত্রী পাঠালে সারা দেশেরভাষা সৈনিকদের বাড়ীতেই পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন।
দ্বিতীয় খবরটি একই দিনে প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সময়ের আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় দুই কলাম শিরোনামে। শিরোনামটি ছিল “পরিবারের সদস্যদের আবেগময় স্মৃতিচারণঃ ভাষা সৈনিক মমতাজ বেগমের নামে ভবন উদ্বোধন”। প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনটিতে সময়ের আলোর নারায়নগঞ্জ প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, ভাষা সৈনিক মমতাজ বেগমের নামে নারায়নগঞ্জের মর্গ্যান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর নাতনী জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ফারজানা ইসলাম রূপাপি এইচ ডি বলেছেন, মমতাজ বেগম ভাষার জন্য, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য তার জীবন বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। তাঁকে মূল্যায়ন করতে হলে প্রায় সত্তর বছর আগের এ দেশের সমাজ, পরিবিার ও রাষ্ট্রের পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতে হবে। সে সময়ে একজন নারী পরিবারিক বাধা, সামাজিক বাধা তুচ্ছ করে বের হয়ে রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া ভাষার বিরুদ্ধে নিজের মাতৃভাষা রক্ষার দাবীতে আন্দোলন করেছেন এটি বড় ব্যাপার। তিনি শুধু নিজ স্কুলের ছাত্রীদের নিয়েই আন্দোলন করেন নি সে সময়ের ছাত্র নেতাদের নিয়মিত বুদ্ধি পরামর্শও দিয়েছেন, সকলকে উজ্জীবিত করে গেছেন যা ভাষা সৈনিক শফি হোসেন খান বলে গেছেন।
রবিবার (২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১) দুপুর দেড়টায় মর্গ্যান স্কুল মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নারায়গঞ্জ জেলা পরিষদের ও স্কুল ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান এবং নারায়নগঞ্জ মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। আরও বক্তব্য রাখেন মমতাজ বেগমের নাতি ইঞ্জিনিয়ার রওনকুল ইসলাম, নাতনি অতিরিক্ত ট্যাক্স কমিশনার ড. নাশিদ রিজওয়ানা মুনীর, জেলা জাসদ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মোহর আলী চৌধুরী, নারায়গঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শরীফ উদ্দিন সবুজ ও স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ।
অনুষ্ঠানে ভাষা সৈনিক মমতাজ বেগমের নাতি সিলেট গ্যাস ফিল্ডের জি.এম ইনিঞ্জনিয়ার রওনাকুল ইসলাম বলেন, উনি একমাত্র ভাষা-সৈনিক যিনি দীর্ঘ সময় কারাবরণ করে ছিলেন। ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার আন্দোলন না, এটা বঞ্জনার বিরুদ্ধেও আন্দোলন। অপর নাতনি ড. নাশিদ রিজওয়ানা মুনীর বলেন, “আমাদের নানু মমতাজি বেগম ছিলেন রূপকথার রাজকন্যা যিনি ভাষার জন্য অসীম সাহসী হয়ে হারিয়ে গেছেন। তাঁর কবরটি কোথায় সেটিও কেউ জানেনা। এই খবরটিও অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। স্কুল কর্তৃপক্ষ ভবনটি নির্মাণ করে ভাষা সৈনিক মমতাজ বেগমের নামে তা উৎসর্গ করে এবং মমতাজ বেগমের পরিবার পরিজনকে অতিথি করে এনে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন তা এক কথায় অনন্য। হয়তো এ রকম আরও কিছু নজির দেশের কোথাও কোথাও আছে কিন্তু সেগুলি দেশবাসীর অজানা। স্কুল কর্তৃপক্ষ নামকরণের ভবনটির নামকরণের ক্ষেত্রে যে ভাষা সৈনিকদের প্রতিশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন তার জন্যেও তাঁরা প্রশংসার দাবী রাখেন। ঐ স্কুলের ছাত্রীরা মমতাজ বেগম, অপরাপর ভাষা সৈনিক এবং ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য্য সম্পর্কে বেশী বেশী জানতে পারে তবেই হবে এই নামকরণের সার্থকতা।
বস্তুত: ভাষা আন্দোলনের সঠিক তাৎপর্য্য যেমন আমরা বিস্মৃত, তেমনি আর ভাষা সৈনিকদের প্রতি রাষ্ট্র্রীয় ও সামাজিক অবহেলা যেখানে চরম, ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের নামের তালিকা যেখানে এই সত্তরবছরের বেশী সময়ের মধ্যে করা হয় নি। কোন গেজেট তো দূরের কথা, একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে “একুশে পদক” নামে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা শতকরা ৮০ ভাগ দেওয়া হচ্ছে অন্যদেরকে ভাষা সৈনিকদের কে নয় সেখানে রাজশাহীর জেলাপ্রশাসক মোঃ আবদুল জলিল স্ব-উদ্যোগে দু’জনভাষা সৈনিকের বাড়ীতে গিয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন, স্বহস্তে উপহার সামগ্রী প্রদান ও কুশলাদি জিজ্ঞেস করে একটি অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করলেন। একুশের নামে বিশাল মেলার আয়োজন হলেও সেখানে বই লেখা, বই বেচাকেনা বাৎসরিক আয়োজনটি ঐতিহাসিক হলেও সেখানে ভাষা সৈনিকদের জন্য কোন মর্য্যাদাকর ব্যবস্থার কোন আয়োজন আজও হয় নি।
এক কথায় ইতিহাস বিভ্রম, ইতিহাস বিকৃতি এবং ইতিহাস অনীহা বাঙালি জাতিকে যেভাবে রোগগ্রস্ত করে ফেলেছে, তার হাত থেকে রেহাই পেতে একটি জাতীয় নবজাগরণ অপরিহার্য্য।
ক্ষুদ্র হলেও তাই রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এবং নারায়নগঞ্জের ঐ স্কুল কর্তৃপক্ষ জাতিকে পথ দেখালেন আমাদের গৌরব যাঁদের মাধ্যমে অর্জিত তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে হয়তো ভবিষ্যতে এমন ঘটনা অনেক বেশী বেশী করে ঘটাতে রাষ্ট্র ও সমাজকে উদ্বুদ্ধ করবে।
তাই উপরোক্ত প্রত্যাশা রেখে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক মো: আবদুল জলিল ও নারায়নগঞ্জের মর্গ্যান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পুনর্বার অভিনন্দন।