মফস্বল সাংবাদিকতার নানা দিক
মফস্বল সাংবাদিকতার নানা দিক
রণেশ মৈত্র
ভারতবর্ষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। পাকিন্তানের প্রথম রাজধানী ছিল করাচী শহর। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী ছিলাম ঢাকা ছিলো আমাদের রাজধানী। অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী ছিলো প্রথমে কলিকাতা ও পরে দিল্লী। এ ছাড়াও বোম্বাই ছিলো একটি উন্নত বন্দর নগরী। স্বভাবত:ই সংবাদপত্রের প্রকাশনার কেন্দ্র ভূমি ছিলো কোলকাতা-দিল্লী-মোম্বাই এবং আরও কয়েকটি বৃহৎ নগরী। এর মধ্যে করাচী এবং লাহোরও ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগে এই দুটি নগরীও ভারতবর্ষের অন্যতম দুটি সংবাদপত্র প্রকাশনা কেন্দ্র। ঢাকা দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন সংবাদপত্র প্রকাশনা কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠে নি। বিভাগোত্তর পর্য্যায়ে এসে আজাদ মর্নিং নিউজ প্রভৃতি পত্রিকাগুলি প্রকাশনার মধ্য দিয়ে ঢাকা ধীরে ধীরে তদানীন্তন পাকিস্তানের অন্যতম সংবাদপত্র প্রকাশনা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। আজ তা ফুলে ফলে বিকশিত হয়েছে এবং এই উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র নগরী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
কিন্তু আমার আলোচ্য বিষয় মফস্বল সাংবাদিকতা। সংবাদপত্রের বিকাশের সাথেই মফস্বল সাংবাদিকতার বিকাশ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই পূববর্তী প্যারায় তার ভূমিকা হিসেবে কিছু কথার উল্লেখ করতে হলো। ঢাকার বিভাগোত্তর যুগে অতি অল্পকালের মধ্যেই আজাদ, পাকিস্তান অবজার্ভার, সংবাদ, মর্ণি নিউজ, ইত্তেহার, ইত্তেফাক, আমার বাংলা, মিল্লাত প্রবৃতি দৈনিক পত্রিকা আকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু শুরুতেই দৈনিক ইত্তেফাক ছাড়া, আর সবগুলিই মুসলিম লীগ সমর্থক পত্রিকা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। কোনটি শুরুতে চার পৃষ্ঠার, কোনটি ছয় পৃষ্ঠার কোনটি বা আট পৃষ্ঠা কলেবরে। প্রকাশনার প্রাথমিক পর্যায়ে বিশেষত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পূর্ব পর্য্যন্ত পত্রিকাগুলিতে প্রাধান্য ছিলো দেশের খবরের চাইতে মুসলিম লীগ ও ঐ দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের গুণকীর্তন মুলক সংবাদ, সম্পাদকীয় ও মন্তব্য প্রবৃতি প্রকাশ করা। এর ব্যতিক্রম কখনও কখনও ঘটতো না তা নয় তবে তা একান্তই ব্যতিক্রম। ফলে দেশের সংবাদের প্রধান্য না থাকায় মুসলিম লীগের দলীয় সংবাদ প্রকাশের স্বার্থে স্বভাবত:ই বিভিন্ন জেলায় সংবাদ পাঠাতে উৎসাহী মুসলিম লীগ নেতাদেরকেই নিয়োগপত্র দেওয়া হতো। তাঁরাই কোন পারিশ্রমিক তো দূরের কথা সংবাদ পাঠানোর খরচ, কালিকলম, কাগজ, খাম বা ডাক টিকেটের মূল্য বা ঘটনাস্থলে যাতায়াতের খরচও দেওয়া হতো না। ফলে তৎকালীন মফস্বল সংবাদিকের ছিলেন একান্তই দলীয় এবং তাঁরা পালনও করতেন দলীয় দায়িত্বই।
এই অবস্থাটার মোড় ঘুরিয়ে দিলো ১৯৪৮ এর ভাষা আন্দোলন বিশেষ করে তার পরে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ তার আগেই ১৯৪৮ এ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ গঠন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে। ১৯৪৮ এই পাকিস্তানোত্তর প্রথম অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক’ যুবলীগের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো। কিন্তু দেশের বাম পন্থীদের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে গঠিত এই যুব সংগঠনটি মুসলিম লীগ সরকারের নির্মম নির্য্যাতনের ফলে বেশীদিন টিকতেই পারে নি অকালমৃত্যু বরণ করতে হয় এই সংগঠনটিকে। ভারতর্বষ যখন বিভক্ত হয় তখন কিন্তু মুসলিম বেশ কটি বিরোধীদল পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ছিলো। যেমন পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস, কমিউনিষ্ট পার্টি, র্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রভৃতি। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব তথা ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতার কারণে জনগণের মধ্যে তার প্রভাবের ব্যাপক হ্রাস এবং তার সাথে সরকারী তীব্র দমন নীতি ঐ গলগুলিকে কার্য্যত: অবলুপ্তির পথে ঠেলে দেয়। তাই মুসলিম সরকারের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জনগণের কাছে দলটি দ্রুতই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিশাল ব্যাপ্তি, তার পূর্ব ও পরবর্তী ধারাবাহিক ছাত্র আন্দোলন একই সালে দেশের প্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম ও ত্বরিত গতিতে দেশব্যাপী তার বিস্তার লাভ, ১৯৫৩ তে পুনরায় বামপন্থী অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ এভং প্রতম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসাবে পাকিস্তান গণতন্ত্রীদল গঠন প্রভৃতি আমাদের দেশে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এক নতুন ও কল্যাণকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে সক্ষম হয়। এক কথায় সংবাদপত্রে তখন আমাদের দেশ ও আমাদের জনগণ ঠাঁই পেতে শুরু করে। আর সে কারণেই দেখা যায় সরকারী দলের লিফলেট নয় দেশের সংবাদপত্রগুলিতে একদিকে গণ আন্দোলনের খবর জনগজীবনের সমস্যা জর্জরিত চিত্র সমূহ স্থান পেতে সুরু করে।
মফস্বল সাংবাদিকরাও তাঁদের কলমকে সমমুখী করে তোলেন দেশের বাস্তব চিত্র পত্রিকায় পাবার তুলে ধরতে উদ্যোগী হন। এরকদলীয় সাংবাদিকতায় স্থলে বহদলীয় সাংবাদিকতার উন্মেষ ঘটে। সংবাদপত্রগুলির সাম্প্রদায়িক চরিত্র পরিবর্তিত করে ধীরে ধীরে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধারণ করতে শুরু করে। বলাই বাহুল্য তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশ একদিকে মুসলিম লীগ ও তার সরকার এবং তাদের দলীয় দর্শন সাম্প্রদায়িকতাকে কোনঠাসা করে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের চিরায়ত ধারাকে নতুন করে বাঙালির জাতীয় আন্দোলনের মূলধারায় পরিণত করে তুলছিল এবং তারই অামলে পূর্ব শর্ত বাঙালি মানুষ ও তার মানসকে সংবাদপত্র সহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে সামনে টেনে আনছিলো এক অভাবিত পূর্ব ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ করে। এরই প্রতিফলন ঘটছিলো আমাদের জাতীয় সংবাদপত্রসমূহে সাংবাদিকদের লেখনীয় মাধ্যমে। মফস্বল সাংবাদিকরাও এই কর্মকান্ডে পিছিয়ে থাকেন নি। ফলে ধীর লয়ে হলেও তাঁরা সমাজে একটি স্থানও অধিকার করে নিচ্ছিলেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠ্য নিয়ে।
পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধ আমাদের সংবাদপত্র এবং মফস্বল সাংবাদিকতার জগতে একটি উল্লম্ফন ঘটায়। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুখপত্র রূপে দৈনিক উত্তেফাকের আত্মপ্রকাশ, মুসলিম লীগ কর্তৃক প্রকামিত দৈনিক সংবাদের প্রগতিশীল মালিকানায় হস্তান্তর এবং দৈনিক মিল্লাত সহ আরও কয়েকটি দৈনিকের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে আমাদের সংবাপত্র জগতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির প্রচারণায় পরিবর্তে প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার প্রচার ও প্রসার মূল দর্শন হিসেবে গণভিত্তি অর্জন করে। পাকিস্তান অবজার্ভারও এ ব্যাপারে ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই এই ধারায় অন্যতম প্রধান মুখপত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠালাভ করে। আর এই সকল পত্রিকায় মফস্বল সংবাদ দাতা হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন প্রধানত: প্রগতিচিন্তায় বিম্বাসী তরূণেররা যাঁরা ছিলেন নি:স্বার্থ দেশপ্রেমিক চিন্তার ধারক ও বাহক। ফলে এঁদের পাঠনো প্রতিবেদনগুলি যেহেতু জনতার কাছাকাছি অবস্থান থেকে রচিত হতো সেগুলি পত্রিকার প্রষ্ঠায় পূর্বাপেক্ষা বেশী গুরুত্ব সহকারে ছাপাও হতো। কিন্তু সরকারী বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে সিষ্ঠুর বৈষম্য (রাজনৈতিক কারণে) এবং মফস্বল সাংবাদিকদের এক এক ধরণের অবহেলাপূর্ণ মনোভাব (মালিক ও ডেকে কর্মরত বেতনভূক সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে) পোষনের ফলে মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য কোন পারিশ্রমিক বা সংবাদ পাঠানো ও সংগ্রহের নিছক খরচটুকুও দেওয়ার ব্যবস্তা ছিল না। তদুপরি মফস্বল সাংবাদিকরাও তাঁদের সামাজিক ও দেশপ্রেমিক দায়িত্ব হিসেবে পত্রিকায় খবর পাঠাতেন বলে তাঁরাও কোন পরিশ্রমিক বা অনুষাঙ্গিক ব্যয়াদি দাবীও করতেন না। ফলে মফস্বল সাংবাদিকেরা ধীরে ধীরে সমাজে এবং পত্র-পত্রিকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেও মফস্বল সাংবাদিকতা আদ্যৌ পেশাগত বিত্তি অর্জন করছিলো না কোন মহলের চিন্তার ক্ষেত্রে। তবে মফস্বল সাংবাদিকতার এই নব উন্মেষ লগ্নে বেশ একগুচ্ছ তরুণ সাংবাদিক তৈরী হচ্ছিলো পূর্ব বাংরার বিবিন্ন জেলায়। অর্থনৈতিক প্রশাসনিক গুরুত্ব বিবেচনায় এঁদের কাউকে কাউকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে চট্টগ্রাম, খূলনা প্রভৃতি বড় বড় শহরে (ঢাকার বাইরে) সার্বক্ষণিক পাঠক হিসেবেও নিয়োগ দেওয়া সুরু হয়।
ইতিমধ্যে দেশ বিভাজন সৃষ্টি হয়ে যায় টাকায় কর্মরত সাংবাদিক এবং মফস্বল কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে। প্রথমোক্ত অংশ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে সরকার ও মালিকপক্ষ কর্তৃক বিবেচিত হতেন মফস্বল সাংবাদিকেরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও গুরুত্বহীন ও খানীকটা যেন অপাংক্তেয় তাই বেতন-ভাতাহীন। ডেকে যাঁরা কাজ করতেন তাঁদেরও অবশ্য বেতন ছিলো অবিশ্বাস্য রকমের কম এবং তা দেওয়া হতো অত্যন্ত অনিমিত ভাবে। তবুও তাঁদের গুরুত্বটা ছিলো স্বীকৃত মর্য্যাদাও ছিলো সকল মহলে।
সাংবাদিকতার দিনগুলি এভাবেই চলতে চলতে ঐ দলকেই দাবী ওঠে সাংবাদিকদের বেতন-ভাতার কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে। দাবীটি তোলেন পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রভৃতি। এগুলি হলো কর্মরত সাংবাদিকদের অর্থাৎ বেতনভূক্ত সাংবাদিকদের অর্থাৎ সার্বক্ষণিক সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠান। ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে স্বীকৃত ও লাইসেন্স প্রাপ্ত। এঁরা এই আন্দোলন চালাতে চালাতে আইউবের সামরিক শাসন আসে। সামরিক শাসকদের কাছেও এ দাবী উত্থাপিত হয়। আন্দোলনের এক পর্য্যায়ে দাবীটি স্বীকৃত হয় এবং কর্মরত সাংবাদিকদের বেতন বোর্ড গঠিত হয়। এই বোর্ডের রোয়েদাদ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালের শেষ দিকে। সাংবাদিকদের আন্দোলনের প্রথম বিজয় হয়। কিন্তু এখানে উল্লেখ্য মফস্বল সাংবাদিকেরা সংঘঠিত না হওয়ায়, তারা এ জাতীয় কোন দাবী উত্থাপন না করায় এবং অপরপক্ষে তাঁরা বেতনভূক্ত নন এবং সেই অর্থে কর্মরত সাংবাদিকের সংজ্ঞার আওতায় তাঁরা পড়েন না – এ সকল কারণে সাংবাদিক বেতন বোর্ডের বোয়েদাদে তাঁদের জন্যে কোন বেতন স্কেল প্রভৃতি নির্ধারিত হয় নি। তবে জেলা সংবাদ দাতাদের জন্য একটি লাইনেজ, রিটেইনার ভাতার (নাম মাত্র) ওই বোয়েদাদ্রে বিধান রাখা ছিল। ঢাকার পত্রিকাগুলিতে এই বোয়েদাদের পূর্ণ রায় ছাপা হলে তা আমাদের নজরে পড়ে ডিসেম্বর ১৯৬০ এ।
তখন আমরা পাবনাতে প্রথম উদ্যোগ নেই ১৯৬১ সালের প্রতম দিকে রাজশাহী-খুলনা বিভাগীয় মফস্বল সাংবাদিকদের সম্মেলন অনুষ্ঠানের। এ খবর ঢাকার সংবাদগুলিতে ভালভাবেই ছাপা হয়। খবরটি ঢাকার সাংবাদিক বন্ধুরা পড়া ও জানার পর তাঁরা পাকিস্তান অবজার্ভারের রংপুর সংবাদ দাতা আবু সাদেকের সাথে আলাপ করেন এবং আমার কাছে আবু সাদেকের (প্রয়াত:) মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠান ওটাকে বিভাগীয় সম্মেলনের পর্য্যায়ে রেখে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মফস্বল সাংবাদিক সম্মেলনের রূপ দিতে। আবু সাদেক এই প্রস্তাবে নিয়ে পাবনা আসেন ক’দিন অবস্থান করেন এবং দফায় দফায় আলোচনার পর প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। আহ্বান করা হয় পূর্ব পাকিস্তান মফস্বল সাংবাদিক সম্মেলন প্রথমবারের মতো আমাদের দেশে। পাবনায় এই সম্মেলন ১৯৬১ সালে অনুষ্ঠিত হয় ৮ ও ৯ মে তারিখে। বনমালী ইনষ্টিটিউটে। পাবনার সাংবাদিকেরা এবং পাবনা বাসী চিরকালের জন্য এগর্ব তাঁদের বুকে ধারণ করতে পারেন। পারেন পূর্ব বাংলার সকল মফস্বল সাংবাদিকই।
আসল কথায় ফিরে আসি। এই সম্মেলনে যে দাবী সর্বসম্মতিভাবে গৃহীত হয়েছিলো তা হলো: মফস্বল সাংবাদিকদেরকে কর্মরত সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। যতদিন তা না হয় ততদিন সাংবাদিকদের প্রথম বেতন বোর্ড রোয়েদাদে জেলা সংবাদদতাদের জন্য যে বেতন ভাতা প্রভৃতির বিধান রাখা হয়েছে তা অবিলম্বে সকল মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য কার্য্যকর করতে হবে। মফস্বল সংবাদ প্রতিদিন প্রতিটি দৈনিকে অন্তত: ৮ কলাম করে ছাপতে হবে। মফস্বল সাংবাদিকদের প্রেরিত সংবাদ অধিকতর গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। আর দাবী তোলা হয় সকল মফস্বল সাংবাদিককে সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্যপদ দিতে হবে এবং তার মাধ্যমে সমগ্র পাকিস্তান ব্যাপী সাংবাদিকদেরকে একটি মাত্র সংগঠনের পতাকাতলে সমবেত করতে হবে। সাংবাদিকদের ব্যাপকতম ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবং পূর্ব-বাংলার সকল সাংবাদিকের জন্য বেতন বোর্ডের রোয়েদাদে প্রকাশিত বিধানগুলি বাস্তবায়নের দাবী এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সকল মক:স্বল সাংবাদিককে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে ‘পূর্ব পাকিস্তান মফস্বল সাংবাদিক সমিতি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হলো। এই সংগঠনের নাম পরবর্তীতে রাখা হয় পূর্ব-পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতি যা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি নাম পরিগ্রহগ করে। এই সম্মেলন প্রস্তাব কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন প্রয়াত এ.কে.এম. আজিজুল হক এবং সাধারণ সম্পাদক রণেশ মৈত্র (বতমান নিবন্ধের লেখক)। সমিতিটির প্রথম সভাপতি ও নির্বাচিত হয়েছিলেন আজিজুল হক সাহেব আমি নির্বাচিত প্রথম যুগ্ম সম্পাদক। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন কুমিল্লার এম. বশারতুল্লাহ্ (প্রয়াত)। সম্মেলনে বিপুলভাবে সহায়তা করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন ও পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। তার মধ্যে তৎকালীন ঊচটঔ সভাপতি মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, ঊচটঔ’র যুগ্ম সম্পাদক কে.জি. মুস্তাফা এবং অন্যতম নেতা এ.বি.এম. মুসার নাম বিশেষভাবে স্মরণ যোগ্য। প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে এসেছিলেন পাকিস্তান অবজার্ভারের স্বনামধন্য সম্পাদক আবদুল সালাম ও মর্নি নিউজের সম্পাদক এস.জি. এম. বদরুদ্দিন। অপরিহার্য্য কারণে শেষ মুহুর্তে এই সম্মেলনে আমার কর্মসূচী বাতিল করতে বাধ্য হয়েও বিপুলভাবে সহযোগিতা করেছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজল হোসেন মানিক মিয়া এবং দৈনিক সংবাদের সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী।
এই সম্মেলন থেকে জোরকণ্ঠে দাবী তোলা হয়েছিলো নিরাপত্তা আইনে আটক সকল সাংবাদিক ও রাজবন্দীদের মুক্তি, নিরাপত্তা আইন ও প্রেস এ- পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স সহ নাগরিক ও মানবাধিকার হরণকারী সকল আইন বাতিল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রভৃতির। সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হাবিবুর রহমান।
এই সম্মেলনে তখনকার উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল দৈনিক পত্রিকারই বার্তা সম্পাদক বা মফস্বল সম্পাদকরাও এসেছিলেন। তাঁরা সারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত নিজ নিজ সংবাদদাতাদের নিয়ে পৃথক পৃথক বৈঠকও করেন এবং তাদের সংবাদ ও তা পরিবেশনের মান প্রভৃতি নিয়েও আলোচনা করেন। প্রচন্ড চাপ দেওয়া হয় পরিশ্রমিকের উপর চাপ দেওয়া হয় মফস্বল সংবাদের জন্য অধিকতর ঝঢ়ধপব এবং সেগুলি গুরুত্বসহকারে প্রকাশের ব্যাপারে। এ সকল ব্যাপারে তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টার অঙ্গীকারও পাওয়া যায়। সংবাদপত্র প্রদর্শনী, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রবৃতি ও খুবই আকর্ষণীয় হয়।
এই সম্মেলনের পর থেকে মফস্বল সংবাদ সকল দৈনিক পত্রিকাতেই গুরুত্বসহকারে ছাপা হতে শুরু করে। প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠাতেও মফস্বল সংবাদ স্থান পেতে থাকে। সর্বত্র সাংবাদিক সমিতির শাখা গঠিত হতে থাকে বিপুল উদ্যমে। মফস্বল সাংবাদিকদেরকে কর্মরত সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতি দান এবং স্বীকৃতি সাপেক্ষে বেতন বোর্ড বোয়েদাদে জেলা সংবাদ দাতা হিসেবে যে সম্মানী ও রিটেইনার প্রবৃতি প্রদানের বিধান কার্য্যকর করার দাবীতে সর্বত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে একই সাথে ঐ আন্দোলনে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, বন্দীমুক্তি প্রভৃতির দাবীও। এক পর্য্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নও মফস্বল সাংবাদিকদের এই দাবীর প্রতি আনুষ্ঠানিক সমর্থন জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সমিতির পক্ষ থেকে ঢাকায় সকল পত্রিকা ও বার্তা সংস্থার মালিক সম্পাদকের সাথে সাক্ষাত করে দাবী নামা সহ স্মারকলিপি পেশ করা, আলোচনা করা ইত্যাদিও চলতে থাকে। ফলও বেশ অল্পদিনের মধ্যেই সম্মেলনের ২/১ বছরের মধ্যেই পাওয়া শুরু হয়। অবজার্ভার ও ইত্তেফাক সর্বপ্রথম এই দাবী মেনে নেয়। এভাবে প্রতিটি যাত্রা শুরু হয়। পরে মর্নিং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তানও রোয়েদাদটি এভাবেই ধীরে ধীরে অনেক পত্রিকাতেই কোথাও পূরোপূরি কোথাও আংশিকভাবে ঐ বোয়েদাদের বিধানগুলি কার্য্যকর করা হয়। অন্যান্য প্রায় সকল পত্রিকাই সংবাদ পাঠানোর খরচ সহ কিছু কিছু সম্মানী হিসেবে দিতে শুরু করে। এই বিজয় পাবনা সম্মেলনের পাবনায় গঠিত সমিতির এবং এর মূল উদগাতা পাবনার সাংবাদিকদের এগুলি অর্জিত হয় পাকিস্তান আমলেই ষাটের দশকেই। কিন্তু মূল দাবীটি মফস্বল সাংবাদিকদেরকে কর্মরত সার্বক্ষণিক এবং বেতনভূক্ত সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতির দাবী আজও উপেক্ষিত।
স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে বহু নতুন পত্রিকার জন্ম হয়েছে। আগেকার ঐ আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসেবে ঐ সকল পত্রিকার মধ্যে যেগুলি প্রধান তারাও মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়ার বিধান চালু করেছেন। কিন্তু স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে সাংবাদিক সমিতিটি দু:খজনকভাবে ব্যক্তির পকেটে চলে যাওয়া, আন্দোলন সংগঠন না করায় অসংখ্য সংগঠন (মফস্বল সাংবাদিকদের) গড়ে ওঠায় এবং সর্বোপরি স্বৈরাচারী সামরিক শাসককে দিয়ে জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করার প্রশ্নে সংগত ভিন্নতর অগ্রাহ্য করায় কার্য্যত: সংগঠনটি এসে বিক্ষুপ্তির পথে চলে যায় অত্যন্ত দুঃখজনভাবে। আজ মফস্বল সাংবাদিকেরা জাতীয় ভিত্তিতে অসংগঠিত, অনৈক্যের শিকারে অসহায়ভাবে পরিণত। তাই মফস্বল সাংবাদিকদের কোন আন্দোলন নেই নতুন কোন অর্জনও নেই। এ এক দুঃজনক পরিস্থিতি।
মূল কথা হলো সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে সার্বক্ষণিক ও বেতনভূক্ত এবং জবাদিহিতার আওতায় তাকে আনতে হবে। উপযুক্ত এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।
আজকের পরিস্থিতি কি করুণ। যশোরের শামছুর রহমান, সাউফুল ইসলাম মুকুল, টিপু সুলতান, প্রবীর শিকদার এবং আরও অসংখ্য সাংবাদিক গ্রামে গঞ্জে শহরে নগরে খুন হচ্ছে আহত হচ্ছে পঙ্গু হচ্ছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কার্য্যকর আন্দোলন নেই প্রতিরোধ নেই। ঢাকার সাংবাদিকেরা দলীয়ভাবে বিভক্ত। তাই আজ তারা স্মারকলিপি দিয়ে মুখরক্ষা করছেন। অত্যন্ত পীড়িত বোধ করছি প্রয়োজন বোধ করছি নুতন করে ঐক্য ও সংগঠন গড়ার। কেউ কি এগিয়ে আসবেন?
আজ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মালিকের স্বীধনতায় অনেকটাই পরিণত সাংবাদিকের স্বাধীনতা এখনও অর্জনের অপেক্ষায়। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এখনও নব নির্মিত। এ সকল বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয় ও পেশা হিসেবে তার স্বীকৃতি এ দেশে জাতীয় ও সুস্থ সাংবাদিকতার বিকাশের স্বার্থেই। হলুদ সাংবাদিকতা – ইষধপশসধরষরহম এর সাংবাদিকতার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য্য যদিও তা আজও অনুল্লেখযোগ্য পর্য্যায়ে আছে। কিন্তু সেগুলি দূর করতে হলে বা ঐ পথে কোন সাংবাদিক যাতে অগ্রসর না হন সে দিকে এগুতে হলে তার পূর্ব শর্তই হবে সাংবাদিকতাকে পেশাগত ভিত্তির উপর অবিলম্বে দাঁড় করানো।
হানাহানি সহ এখনও বেশ কিছু আইন আছে যা আমাদের কলমের এবং সত্য প্রকাশের পরিপন্থী। এগুলিকে বাতিল করার কাজও রাখছি না আমরা। অনেকাংশে আমরা অনেকে নিরাপত্তা হারিয়ে ফেলেছি সংকীর্ণ দলীয় অথবা স্বার্থসিদ্ধ দৃষ্টিভর্ঙ্গীর কারণে। নিরপেক্ষ অর্থ এ নয় যে আমরা ভাল এবং মন্দকে এক দৃষ্টিতে দেখবো বা আলো ও অন্ধকারকে সমান মূল্য দেবো। আমরা অবশ্যই থাকবো সত্য, ন্যায় ও আলোর পক্ষে নীতির পক্ষে – মিথ্যা, অন্যায় ও অন্ধকারের বিপক্ষে। আমরা যে ভাল তাকে ভাল বলবো – যে খারাপ তাকে খারাপ বলবো। আমরা হবো দলনিরপেক্ষ-নীতি নিরপেক্ষ নয়। নইলে নীতি-আদর্শ বিদুরিত হবে। বিদায় নিচ্ছে অথবা পূঙ্গু হচ্ছে শামছুর রহমান, মুকুল, টিপু সুলতান ও প্রবীর সিকাদারেরা। তারা আমাদেরই ভাই-এ কথা মুখে বলাই কি যথেষ্ট? ভাবতে হবে সবাইকে গভীর ভাবেই ভাবতে হবে।
লেখক: রণেশ মৈত্র
সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত ।