এক বিশাল ‘মল্লযুদ্ধ’ ও ‘মারামারি’

 

 

আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ‘মল্লযুদ্ধ’ ও ‘মারামারি’র আয়োজনের কথা ভাবা হচ্ছে। বলা হয়েছে- এখন যারা এর বিরোধিতা করছেন (থেমেসিস ইস্যুতে) আর যারা পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তিনি দু’পক্ষের কারও পক্ষে থাকবেন না। তারা আগে ‘মারামারি’ ও ‘মল্লযুদ্ধ’ করে শক্তির পরীক্ষা করুক। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও এ ব্যাপারে দু’পক্ষ মুখোমুখী হলে কিছু করতে মানা করেছেন। দু’পক্ষের শক্তির পরীক্ষায় যারা আহত হবেন তাদের চিকিৎসা দেবেন।

এই বক্তব্য কোনো কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অস্বীকার বা প্রতিবাদ করা হয়নি। তার প্রেক্ষিতে কিছু কথা। প্রথমে আসি ‘মল্লযুদ্ধ’ প্রসঙ্গে।

০১.
‘মল্লযুদ্ধ’ মানে হাতে হাতে লড়াই। কুস্তি বললে বিষয়টি সহজে বোঝা যায়। চট্টগ্রামের ‘জব্বারের বলি’ মল্লযুদ্ধ বোঝার জন্যে ভালো দৃষ্টান্ত। গ্রামীণ বাংলায় এক সময় মল্লযুদ্ধের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এখন প্রায় বিলুপ্ত। হাতে হাতে লড়াই করাটাকে সম্ভবত এখন আর সম্মানজনক মনে করা হয় না। টেঠা, বল্লম, দা, কাচি, ঢাল-তলোয়ারের যুদ্ধও বা চরাঞ্চলের ‘কাইজা’ এখন গুরুত্ব হারিয়েছে।

কাটা রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ এক সময় চরমপন্থি গ্রুপগুলোর ভেতরে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর কাছে। বিশেষ করে জাসদ ছাত্রলীগ, আওয়ামী ছাত্রলীগ এবং বিএনপির ছাত্রদলের কাছে। দাড়ি কামানোর খুরকে প্রতিপক্ষের হাত-পায়ের রগ কাটার কাজে ব্যবহার করে অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছিল যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত-শিবির।

চাইনিজ কুড়াল, হকিস্টিকও এক সময় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এখন শহর – গ্রামের পুকুরও এম-১৬ বা একে-৪৭ রাইফেলের খনি। কাটা রাইফেলেরই কদর নেই, সেখানে খালি হাতে মল্লযুদ্ধের তো প্রশ্নই আসে না।
প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া গ্রাম-বাংলার আবহমান সংস্কৃতির অংশ ‘মল্লযুদ্ধ’কে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

০২.
এই ‘মল্লযুদ্ধ’র মঞ্চ নির্দিষ্ট মাঠ বা স্টেডিয়াম নয়। ‘মল্লযুদ্ধ’র মঞ্চ সমগ্র বাংলাদেশ, ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইল। ‘মল্লযুদ্ধ’র আম্পায়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আম্পায়ারের সহযোগী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী পুলিশ, র্যা ব, সোয়াট। থার্ড আম্পায়ার এই আয়োজনের মাননীয় প্রধান পরিকল্পনাকারী। যদিও এই ‘মল্লযুদ্ধ’র কোনো আম্পায়ার থাকবেন কিনা, তা নিশ্চিত হয়নি মাননীয় প্রধান আয়োজকের বক্তব্য থেকে। দুই পক্ষ যখন মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হবেন, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কোনো কিছু করতে নিষেধ করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সহযোগী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীও চুপচাপ থাকবেন। যারা আহত হবেন, তাদের উদ্ধার করবেন। ‘মল্লযুদ্ধ’র সময়ে ফাউল করলে কোনো পক্ষকে বাধা দেবেন না। আর এটা শুধু ‘মল্লযুদ্ধ’ নয়। ‘মারামারি’রও ব্যবস্থা থাকবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। সেই বিবেচনায় বলা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিক আম্পায়ার নন, মূলত পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করবেন । সবার উপরে থার্ড আম্পায়ার হিসেবে অবস্থান করবেন আয়োজনের মাননীয় প্রধান পরিকল্পনাকারী, আম্পায়ারের কাজও মূলত তিনিই করবেন। ভালো করে রিপ্লে দেখে কে কেমন আহত হয়েছেন, তার তেমন চিকিৎসার নির্দেশনা দেবেন। মৃতদের মর্গে পাঠানো, দাফনের ব্যবস্থাও তিনিই করবেন।

‘মল্লযুদ্ধ’র এক দিকে গ্রিক মিথলজির চরিত্র ন্যায় বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য থেমেসিস সরানোর পক্ষের হেফাজতে ইসলাম। অন্যদিকে সরানোর বিপক্ষের প্রতিবাদকারীরা। প্রথম মল্লযুদ্ধে হেফাজত অবস্থান নেবেন বায়তুল মোকাররম অঞ্চলে, প্রতিবাদকারীরা অবস্থান নেবেন শাহবাগ এলাকায়।

০৩.
‘মল্লযুদ্ধে’ সাধারণত তেমন ‘আহত’র ঘটনা ঘটে না। নিহত তো নয়ই। আয়োজনে ‘মারামারি’ থাকায় আহত- নিহতের সম্ভাবনা থাকছে। চরাঞ্চলের যে ‘কাইজা’ সম্ভবত তাও ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। মাননীয় প্রধান পরিকল্পনাকারী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা’ তিনি করবেন।

হেফাজতে ইসলামের বক্তব্য খুব পরিস্কার। তারা বলেছেন, ‘সুলতানা কামাল রাজপথে নেমে দেখুন, হাড্ডি গোস্ত রাখা হবে না।’

শুধু হাতে হাতে ‘মল্লযুদ্ধ’ এমন কি ‘মারামারি’ করেও মানুষের শরীরের ‘হাড্ডি-গোস্ত’ আলাদা করা যায় না। গুলি করলেও হাড্ডি গোস্ত আলাদা হয় না। ‘বোমা বিস্ফোরণ’ ঘটিয়ে ‘হাড্ডি-গোস্ত’ আলাদা করা যায়। সেই সক্ষমতা আছে, ইতিপূর্বে  হাটহাজারীতে ‘বোমা বিস্ফোরণ’র ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তাছাড়া ‘হাড্ডি-গোস্ত’ সবচেয়ে ভালো মতো আলাদা করা যায় ‘চাপাতি’ দিয়ে। হেফাজতের দেয়া তালিকা অনুযায়ী যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে, সেখানে ‘চাপাতি’ ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে।

এই ‘মল্লযুদ্ধ’র সঙ্গে যেহেতু ‘মারামারি’র বিষয়টি যোগ করে দিয়েছেন, সুতরাং যুদ্ধ খালি হাতে হবে না। ‘কাইজা’ খালি হাতে হয়ও না। ‘হাড্ডি-গোস্ত’ আলাদা করার জন্যে হেফাজত হয়ত ‘চাপাতি’ ব্যবহার করবে। অন্যপক্ষ থেমেসিস সরানোর সংগঠনহীন প্রতিবাদকারী, যারা অতি নিরীহ। ‘চাপাতি’ তো দূরের কথা, তাদের কাছে লাঠিও নেই। রাস্তায় পড়ে থাকা কিছু ইটের টুকরো, পুরনো দু’একটি টায়ারই তাদের সম্বল।

এই পক্ষে ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টসহ কয়েকটি বাম সংগঠন সক্রিয় থাকবেন। ইটের টুকরো ছোঁড়ার ক্ষেত্রেও তারা পারদর্শী নন। তারা উদ্দীপনামূলক কথা বলবেন, গান গাইবেন, স্লোগান দেবেন। গণজাগরণ মঞ্চ খুব সক্রিয় থাকবে কিনা সন্দেহ আছে। গণ সংহতি আন্দোলন নিশ্চয়ই কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের অবস্থান পক্ষে থাকলেও, তারা মাঠে আসবেন না। এই পক্ষে ছাত্রলীগ যোগ দিলে, ‘মল্লযুদ্ধ’ এবং ‘মারামারি’তে একটা সমতা আসত। রামদা, তলোয়ার, পিস্তল, নাইন শ্যুটার গান সবকিছু ব্যবহারে ছাত্রলীগ পারদর্শী।

এই পক্ষে যারা, তারা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কথা বলেন। আর ‘মল্লযুদ্ধ’র মাননীয় প্রধান পরিকল্পনাকারী বলেছেন, ‘শুকরের মাংস, মদ ও গাঁজা খেয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা যারা বলেন, তারা পারভারটেড।’ বাজেটেও এদের প্রতি সদয় হতে দেখা গেছে। ভ্যাট মুক্ত রাখা হয়েছে, আমদানিকৃত শুকরের মাংশ।

যারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলবেন, তারা কে ‘শুকরের মাংস, মদ ও গাঁজা’ খেয়ে বলছেন, আর কে না খেয়ে বলছেন, তা তাৎক্ষণিকভাবে পরিমাপ করা যাবে না। ধরে নেয়া হবে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলবেন, তারা ‘শুকরের মাংস, মদ ও গাঁজা’ খেয়ে এসেছেন এবং তারা ‘পারভারটেড’।

ছাত্রলীগ ‘শুকরের মাংস, মদ ও গাঁজা’ খেয়ে ‘পারভারটেড’ পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইবে না। উল্টো এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। পহেলা বৈশাখে নারী নিপীড়নের প্রতিবাদকারী ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যেভাবে অবস্থান নিয়েছিল। এমন অবস্থান নেওয়ার বহু দৃষ্টান্ত তারা গত কয়েক বছরে তৈরি করেছে।

০৪.
সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়বেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গণের নেতা-কর্মীরা। তারা ‘মল্লযুদ্ধ’ ও ‘মারামারি’তে অংশ নেবেন না। কিন্তু শহীদ মিনার বা টিএসসিতে দাঁড়িয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা তাদের বলতে হবে। এখন কৌশলের অংশ হিসেবে মুখে যদি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দ উচ্চারণ নাও করেন, তারা যা বলবেন তা হেফাজতের বিপক্ষে এবং প্রতিবাদকারীদের পক্ষে যাবে। আর হেফাজতের বিপক্ষে এবং প্রতিবাদকারীদের পক্ষে মানেই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পক্ষে।

মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কথা বললেই, হেফাজত বলবে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পক্ষে কথা বলছে। এরা ‘শুকরের মাংস, মদ ও গাঁজা’ খেয়ে এসে এ কথা বলছে। বিএনপি-জামায়াতও নিরবে- কৌশলে অবস্থান নেবে হেফাজতের বক্তব্যের পক্ষে।

‘শুকরের মাংশ এবং মদ গাঁজা’ তত্ত্বে সবচেয়ে আনন্দিত-উৎফুল্ল বিএনপি-জামায়াত। কারণ তারা পরিষ্কারভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র বিপক্ষে। ‘বিএনপি কেন জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করে’- এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বিএনপিকে আর বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে না।

হেফাজত-আওয়ামী লীগ মিলন এবং শুকর-মদ- গাঁজা তত্ত্বের পর ‘কেন এক সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত’ প্রসঙ্গটিই গুরুত্ব হারিয়েছে। ‘জামায়াতের চেয়ে হেফাজত ভালো’ এই তত্ত্ব আবিষ্কারের চেষ্টা হবে। তাতে খুব সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ  মাওলানা জিয়াউল হাসান বলে রেখেছেন, ‘হেফাজতের নেতা আহমদ শফী একাত্তরে পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি সেনা আর রাজাকারদের সব কাজে সহযোগিতা করেন।’

০৫.
হেফাজত পবিত্র কোরান শরীফ পুড়িয়ে রাজনৈতিকভাবে সরকারকে বিপদে ফেলতে চেয়েছে- এ কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন। শাপলা চত্বরে সরকার হেফাজতের কয়েক হাজার নেতা- কর্মী হত্যা করেছে, এই অসত্য প্রচারণা চালিয়ে জাতীয়- আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল।

‘হেফাজত জঙ্গি নয়’- ২০১৭ সালে বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ২০১৩, ১৪, ১৫, ১৬ সাল পর্যন্ত শুধু  জঙ্গি নয়, হেফাজতকে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী-নেতারা।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হেফাজত যদি জঙ্গিদের সঙ্গে চলে যেত, এই আশঙ্কায়ই তিনি হেফাজতকে কাছে টেনে নিয়েছেন। বিএনপি এখন আরও জোর দিয়ে বলতে পারবে, জামায়াতকে সঙ্গে রাখার কারণেই তারা সশস্ত্র সংগঠনে পরিণত হয়নি। এতকিছুর পরেও হেফাজত প্রধানমন্ত্রীর উপর খুশি নয়। তারা পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, আপনি কলা ঝুলিয়ে মুলা খাওয়ালেন’।

‘কলা ঝোলানো’ তত্ত্ব বুঝতে হলে হেফাজতের সঙ্গে মিলনের দিনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি স্মরণ করতে হবে।

‘আমাদের হাইকোর্টের সামনে গ্রিক থেমেসিসের এক মূর্তি লাগানো হয়েছে। সত্য কথা বলতে কি, আমি নিজেও এটা পছন্দ করিনি।… আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা এখানে থাকা উচিত নয়। আমি আপনাদের বলব, আপনারা ধৈর্য ধরেন। এটা নিয়ে কোনো হইচই নয়। একটা কিছু যখন করে ফেলেছে সেটাকে আমাদের সরাতে হবে। সেটার জন্য আপনারা একটুকু ভরসা অন্তত রাখবেন যে এ বিষয়ে যা যা করার আমি তা করব।’

কথাগুলো হেফাজত নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। থেমেসিস সরিয়ে আবার অন্যত্র প্রতিস্থাপন করার প্রেক্ষিতে হেফাজত বলেছে, ‘কলা ঝুলিয়ে মুলা খাওয়ালেন’।

শুধু বলার মধ্যে সীমিত থাকেননি। হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি মূর্তি কি এখান থেকে সরাবেন? না আমরা আসব? যদি আমাদের আসতে হয় বাংলাদেশে পূজা মণ্ডপ ছাড়া আর কোথাও মূর্তি রাখা হবে না।’

একটি স্লোগান দেয়াকে কটুক্তি আখ্যা দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষের লোকজনের নামে মামলা হচ্ছে সম্ভবত এই বিবেচনায় যে তারা ‘শুকরের মাংশ, মদ ও গাঁজা’ খায়। এত বড় হুমকি দেয়ার পরও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিরোধী হেফাজতের কারও নামে কোথাও কোনো মামলার উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি, সেটাও হয়ত তারা ‘শুকরের মাংশ, মদ ও গাঁজা’ খায় না বলে!

০৬.
‘মল্লযুদ্ধ’ ও ‘মারামারি’র এক পক্ষ হেফাজতে ইসলাম সংখ্যায় কম হলেও সংগঠিত। সঙ্গে সরকারি পৃষ্টপোষকতা। বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলের নৈতিক সমর্থন তাদের পক্ষে। জামায়াতও তাদের পক্ষে। ১৪ দলের শরীক সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টিও তাদের পক্ষে। আওয়ামী লীগেরও চাওয়া থাকবে এই যুদ্ধে হেফাজত বিজয়ী হোক। প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগও হেফাজতের পক্ষেই, এক্ষেত্রে অন্তত।

অন্যপক্ষ সংখ্যায় বেশি হলেও, বহুভাগে বিভক্ত। সরকার সমর্থক মনোয়ন প্রত্যাশী সাংস্কৃতিক নেতারা ‘শুকরের মাংশ এবং মদ গাঁজা’ তত্ত্বের সরাসরি বিরোধিতা করার মতো নীতি নেবেন না। চাওয়া- পাওয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করে সেই নৈতিক সাহস তারা বহু আগে হারিয়েছেন।

তারা সব সময় বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঠিকই ছিলেন, কিন্তু সরকারের ভেতরে অন্যরা ষড়যন্ত্র করছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে পরিস্কার করে বলেছেন, কারও উপর নির্ভর করে নয় কারও বুদ্ধিতেও নয়, সবকিছু তিনি নিজে করছেন। ক্ষমতাসীনদের কাছে হেফাজত যতটা গুরুত্বপূর্ণ, সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতা কর্মীরা এখন ততটা গুরুত্বপূর্ণ নন।

তারা গুরুত্ব যে হারিয়েছেন, তা বুঝতে পারছেন। হেফাজতকে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে উপস্থাপনের পরিকল্পনা দেখে তারা উদ্বিগ্ন। আবার আপসের নীতি থেকে বের হয়ে আসাও কঠিন। ফলে তারা বায়বীয়ভাবে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করবেন। ‘মল্লযুদ্ধ’ ও ‘মারামারি’র মাঠে থাকবেন না। তাদের কিছু কর্মী সক্রিয় থাকবেন। অস্ত্র ছাড়া অসংগঠিত প্রতিবাদকারীদের প্রতিবাদের শক্তি-সামর্থ্য হেফাজতের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি।

কিন্তু ‘মল্লযুদ্ধ’ ও ‘মারামারি’তে তারা পিছিয়ে। পর্যবেক্ষক, সহায়তাকারী ও থার্ড আম্পায়ার মাননীয় প্রধান আয়োজক নিরপেক্ষ থাকবেন- এমন ভরসা করার সুযোগ নেই। ফলে এটা হবে অসম শক্তির ‘মল্লযুদ্ধ’ ও ‘মারামারি’।

হেফাজতকে বিজয়ী দেখানোর জন্যেই এই ‘মল্লযুদ্ধ’ ও ‘মারামারি’র আয়োজন করা হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস ও পাস করিয়ে দেওয়ার নীতি নিয়ে জনমানুষের সাধারণ শিক্ষার ধ্বংস প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন করে ফেলা হয়েছে। কওমি শিক্ষার কোনো উন্নতি না করে স্বীকৃতি দিয়ে, মানব সম্পদ উন্নয়নের নামে অধপতন ঘটানোর পথ তৈরি করা হয়েছে।

শিক্ষাহীন আগামী প্রজন্ম, আগামীর বাংলাদেশ একটা ভয়াবহ সঙ্কটে পড়বে। সেই বাংলাদেশে হেফাজতকে অনুগত বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সরকার। তাদের কিছু সুযোগ- সুবিধা এবং আস্তিক- নাস্তিক তত্ত্ব দিয়ে ব্যস্ত রাখা সহজ।

অর্থ পাচার, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক লুট, গুম-খুন, আইনের শাসনহীনতা, নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারল কী না পারল- এসব নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। গৃহপালিত জাতীয় পার্টির চেয়েও, তারা ভালো বিরোধী দল হবে। সরকার বিব্রত হয় বা সমস্যায় পড়ে, এমন কিছু তারা করবে না।

০৭.
রাজনীতিক- রাজনৈতিক দল নীতিভ্রষ্ট হতে পারে, বুদ্ধিজীবীরা বিবেক বিক্রি করে দিতে পারে, ব্যক্তি পরাজিত হতে পারে। বাংলাদেশ পরাজিত হতে পারে না।

হেফাজত বিজয়ী হলে, পরাজিত হবে বাংলাদেশ। তা কখনো হতে পারে না, যা কখনো হবে না। এই আত্মবিশ্বাস রেখে প্রতিবাদ- প্রতিরোধে সক্রিয় থাকতে হবে। সংখ্যা, কে পক্ষে থাকলো কে থাকল না, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফিদেল ক্যাস্ত্রো অল্প কয়েকজনকে নিয়ে, বিশাল শক্তির স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সেই কিউবা আর এই বাংলাদেশ এক নয়, তা জেনে- মেনেই বলছি, বিজয় সত্য আদর্শেরই হবে। সত্য- আদর্শ অবিনশ্বর। তা চিরতরে দমিয়ে রাখা যায় না।

স্বল্পমেয়াদে ফলাফল বিরুদ্ধে গেল বলে মনে হলেও, দীর্ঘমেয়াদে সত্যের জয় হবেই।

গোলাম মোর্তোজা : সাংবাদিক, কলাম লেখক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!