মার্চের দিনগুলি: পাবনা মুক্ত ২৯ মার্চ
মার্চের দিনগুলি: পাবনা মুক্ত ২৯ মার্চ
সিডনীর কথকতা-৭
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।
গোটা বাংলা ছিল উত্তাল একাত্তরের মার্চের অবিস্বরণীয় দিনগুলিতে। পাবনাও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে পাবনা যেহেতু আমার বাস্থান, আমার আজীবনের কর্মস্থানও এবং ঐ দিনগুলির অন্যতম সক্রিয় যোদ্ধাও – তাই পাবনা মার্চ আমার স্মৃতিতে অমরত্ব লাভ করেছে। সে স্মৃতির গৌরব গাথা যেন কখনই ভূলবার নয়। দিনগুলি ছিল আনন্দের, লড়াই এর বিজয়ের।
হ্যাঁ, আমি তখন পুরোদস্তুর যুবক ষাটের দশকের প্রায় পুরোটাই কাটাতে হয়েছে কারা প্রাচীরের অন্তরালে। তাই বাইরের মুক্ত আলো-বাতাশের দিনগুলিতে সক্রিয়াত যেন বাড়তি গতি লাভ করে। তেমনটাই ঘটেছিল বাস্তবেই। আঁধার না ঘুচতেই ঘুম থেকে উঠে প্রাত:কার্য স্মানাদি সেরে সেই যে সকাল ৭-৩০ বা আটটার মধ্যে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়তাম ফিরতে ফিরতে রাত ১২ টা ঘনিয়ে আসত। ঘরে যা থাকে খাবার মুখে দিয়ে বিছানায় যেতেই ঘুম আবার কাক ডাকা ভোরে উঠে পরা।
কাজ? বৈঠক, সমাবেশ, মিছিল । সকাল থেকে রাত পর্য্যন্ত এগুলি চলতো । পহেলা মার্চ থেকে শুরু করে অসহযোগ বঙ্গ বন্ধুর আন্দোলনের তীব্রতার অর্জন কর। নাওয়া-খাওয়ার তখন গেঠন, কে আওয়ামী লীগ কে ন্যাপ তাও বিস্মৃত। কে হিন্দু কে মুসলমান তার খোঁজ খবর অপ্রয়োজনীয়। কে নারী কে পুরুষ তা দেখারও অবকাশ নেই। সবার মাথায়ই তখন শুধুমাত্র বাংলাদেশ – বাংলার মানুষ বাংলার স্বাধীনত।
পাবনা তখন উত্তালতা শিখরে। মানুষের কি ঘর-বাড়ী ছিল তখন? ছিল বলে অনুভূতই হতো না। সবার বাড়ীঘরের রূপ নিয়েছিল বাংলার রাস্তা-রাজপথ সমূহ। অগণিত মানুষের দৃপ্ত পদ ভারে প্রকম্পিত ছিল দিগ্বিদিক। “জায়বাংলা” শ্লোগানে মুখরিত ছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। আজ মনে হয়, আহা! কর্মমূর্খতার ঐ অবিস্বরণীয় দিনগুলি বাঙালির জীবনে আবারও যদি ফিরে পেতাম-কতই না কলুষমুক্ত থাকতে পারতাম।
কলুষমুক্ত শব্দটা এসেই গেল যখন সংক্ষেপে তার ব্যাখ্যাটাও দিয়ে রাখতে হয়। ঐ যে অত বড় বড় মিছিল যার অনেকগুলি হতো নারী-পুরুষ মিলিতভাবে এবং প্রধানত: তরুণ তরুনীদের স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহনে কোনদিন শুনিনি এমন তরূনী কেঁদে ফুঁপিয়ে “যে দেশে জয় বাংলা বলে নারী নির্য্যাতন করা হয়, সে দেশে আমি থাকবো না।” শুনা যায় নি যে, জয়বাংলা শ্লোগান ধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন তরুণ শিক্ষার্থী তার সহপাঠিনীদেরকে ধর্ষণের সেঞ্চুরী উদযাপনে হলের কথাগুলিতে ডিনার পাঠিয়ে ভূরিভোজে লিপ্ত হয় ঐ একই শ্লোগান দিয়ে বা চুরি-ডাকাতি-রাহাজানির মত অপরাধ সংঘটিত হয়। না, এমন কোন ঘটনার একটি রিপোর্টও কোথাও পাওয়া যায় নি। সে দিনের সংবাদপত্রগুলি খুঁজলে এ কথাগুলির সত্যতা মিলবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে হামেশাই আমাদেরকে এমন কলংকের সমুখীন হতে হচ্ছে। জানিনা, এ কলংকের সমাপ্তি কবে হবে।
যাই হোক, সর্বজনীন অংশগ্রহণে ক্লান্তিভরা দিনগুলি চলে যাচ্ছিল। পুলিশ কিছু বলে নি। কারন তাদের মধ্যেও বাঙালিত্ব ও বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার মরণপণ শপথ ঐ লড়াইয়ে তারাও তো একাত্ম। আবার কোন অপরাধও যেহেতু ঘটছে না-তাই তাদের কাজের চাপও হালকা।
পাবনাতে তখন জেলা প্রশাসক পদে আসীন ছিলেন তরুন সি.এস.পি. নূরূল কাদের। বাম প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সাথে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জীবনে। তিনি বঙ্গ বন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে হলেন একজন সক্রিয় ও উদ্যেগী অংশগ্রহনকারী। তিনিও একা নন। তাঁর নেতৃত্বে পাবনা কাদল কাটারেই সকল কর্মকর্তা কর্মচারীই ঐ অসহযোগ আন্দোলনে হয়ে পড়েন অংশগ্রহনকারী তাঁরই অনুপ্রেরণায়।
পাবনার পুলিশ সুপারকেও তিনিই সম্মত করান পিঞ্জির সরকারের নির্দেশ না মেনে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে থাকতে। তাঁর সমর্থনে থাকলেন তবে নিজ নিজ থানায় অবসরে দিন কাটানোর মত। তাদের সদা ব্যস্ত সময় তখন আর থাকলো না অপরাধ সংঘটিত না হওয়ার কারণে।
এভাবেই চলে এলো ২৫ মার্চ। দিবারাত্র আন্দোলন মুখরতায় ও শ্লোগানের ক্লান্তি নিয়ে দিন কাটিয়ে রাত ১২ টার দিকে বাসায় ফিরি কিছু খেয়েই ঘুম। ভোরে হঠাৎ দরজা নক করার শব্দে চটজলদি উঠে গিয়ে গেটটা খূলতেই দেখি চলমান আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক পাবনা জেলা স্কুলের হেড মওলানা মাওলানা কাছিমুদ্দিন তাঁর সাইকেলে চেপে এসে হাজির। সাইকেল নিয়েই ভেতরে ঢুকে বললেন,“বাসায় আর থাকা নিরাপদ হবে না। সপরিবারে কোন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাও। গভীর রাতে পাক-বাহিনী এসে পড়েছে। শহরে কারফিউ দিয়েছে।
আমি ছুটছি আন্দোলনের নেতাদেরকে খবর দিতে যাতে তাঁরা সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। এক পেয়ালো চা খেয়ে যেতে বললাম। তিনি বসলেন না বললেন সময় নেই। দ্রুত সাইকেলে চড়ে পুনরায় ছুটলেন নেতাদের বাড়ীতে। ঘুম থেকে তাঁদেরকেও সরে যাবার পরামর্শ দিতে। বাঙালি প্রিয় মানবদরদী নির্ভীক এই মাওলানা কছিমউদ্দিনকে ১০ জুন বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে পাক-বাহিনী নির্মমভাবে অত্যাচার করে হত্যা করে। মাধপুরের জঙ্গলে তাঁকে গোপনে অতি সন্তর্পনে কবর করা হয়। সেখানে একটি ছোট খাট স্মৃতিস্তম্ভ পরবর্তীতে গড়ে তোলা হয়েছে। তাঁর প্রিয়জনেরা প্রতি বছর শ্রদ্ধায় ১০ জুন ঐ কবরে ফুল দিতে যান।
পাড়ার ছেলেরা সূর্যাদয়ের পরেই নিজ থেকে ছুটে এসে বিছানাপত্র সমেত আমাদেরকে নিকটবর্তী এক বাসায় নিয়ে গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে নিজেরাই পাহারার ব্যবস্থা করলো। ফলে নিরাপত্তার অনেকাংশে নিশ্চিত হলেও দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সাময়িকভাবে কারণ এবং পরে আমাদের অগ্রিম কোন খবর না থাকায় কোন প্রস্তুতিও ছিল না।
জেলা প্রশাসকের বাংলোতে গিয়ে ২৬ মার্চ একজন মেজরের সাক্ষাত করে সহযোগিতা চাইলে নূরূল কাদের জানিয়ে দেন তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে থাকায় পাক আর্মির সাথে সহযোগিতা করতে অপারগ। মেজর চলে যান। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সুপারকে খবর দিয়ে তিনি তাঁর ছোট্ট পরিবার নিয়ে নিকটবর্তী চরে চলে যান কৃষকের বাড়ীতে আশ্রয় নেন। একই জায়গায় আওয়ামী লীগ , ন্যাপ ও ছাত্র নেতারাও একে একে গিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জমা হয়ে জেলা হাই কমান্ড গঠন করেন যার আহ্বায়ক ছিলেন তদানীন্তন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতিদ আমজাদ হোসেন এম.এন. এ. এবং সদস্য সচিব মনোনীত হন জেলা প্রশাসক নূরূল কাদের। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ ও সীমিত সংখ্য়ায় ঐ হাইকমান্ডের সদস্য মনোনীত হন।
প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বও পড়ে জেলা প্রশাসক নূরূল কাদের এর উপর তাঁর আন্তরিকতা ও যোগ্যতার নিরীখে।
হাই কমান্ড শুরুতেই প্রতিরোধ যুদ্ধের ছক আঁকেন। যথার্থভাবেই তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন, পুলিশের অস্রাগারটিই হবে পাক-বাহিনীর প্রতম টার্গেট। পাবনাতে রাত-গভীরে ঢুকেই ঐ বাহিনী পাবনার ওয়াপদা কলোনীতে তাদের হেড কোয়ার্টার প্রতিষ্ঠা করে – জেলা পরিষদের ডাক বাংলোতে তাদের কিছু সংখ্যক অফিসারের থাকার ব্যবস্থা করে। পাবনাতে এসেছিল ২০০ জন অফিসার ও জওয়ান মিলে। তারা জরুরী ভিত্তিতে পুরাতন টেলিফোন ভবন দখল নিয়ে সমস্ত টেলিফোন সংযোগ বিছিন্ন করে দেয়।
হাই কমান্ড তাঁদের প্রথম সিদ্ধান্ত কার্য্যকর করার কৌশল হিসেব ২৭ মার্চ বিকেল থেকে পুলিশ লাইন ও তার অস্রাগার সংলগ্ন রেজিষ্ট্রী অফিসের আইনজীবি সমিতির, প্রধান ডাকঘরের, জেল থানার ও জেলা জজ আদালত ভবনের ছাদ সমূহে বন্দুক রাইফেল, ইঁট , সড়কি প্রভৃতি নিয়ে ছাত্র তরুণেরা, পুলিশ, আনসার প্রভৃতি স্কল করার মত করে গিয়ে যার যার অস্র সামনের বান্ডার দিকে তাক করে অপেক্ষমান থাকেন। ঠিক মাগরিবের নামায এর পর পরই ট্রাক ভর্তি পাক-সেনা রাইফেল তাক করে হেলমেট পরা অবস্থায় ওয়াপদা ভবন থেকে বেরিয়ে পুলিশ লাইনের দিকে যেতেই আইনজীবী সমিতি ভবন ও জেলা জজ আদালতের ছাদ থেকে অতর্কিত গুলি বর্ষনের সম্মুখীন হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তবুও পড়ি কি মরি করে তারা পুলিশ লাইনের বাঁশের খাঁচা দিয়ে তৈরী দেয়ালে বেশ কিছু গুলি ছুঁড়তে পারলেও তিষ্ঠাতে না পেরে তাদের কয়েকটি লাশ ও আহত কয়েকজনকে নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
সন্ধ্যা রাতে এমন আকশ্মিক গুলির শব্দে প্রথমে শহরবাসী আতংকিত হয়ে পড়লেও গুলি বর্ষণ থামার পর পরই শত শত তরুণ ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে পুলিশ লাইনের প্রতিরোধ যুদ্ধে বিজয় বার্তা ঘোষণা করায় মানুষ উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। আশান্বিতও হন।
২৬ মার্চ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পাক-বাহিনী আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, ছাত্রনেতা ও শহরের নেতৃস্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক অরাজনৈতিক ব্যাক্তিদেরকে ব্যাপকভাবে ধরপাকড় করে কিন্তু অনেকেই সরে পড়ায় তাদের এ অভিযান তেমন একটা সফল হয় নি। তবু ধরা পড়ে যান পাবনা সদর মাহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি আমিন উদ্দিন এডভোকেট, ভাষানী ন্যাপের সভাপতি ডা. অমলেন্দু দাক্ষী ও কতিপয় ব্যবসায়ী ও শিক্ষকসহ বেশ কিছু সংখ্যাক পথচারী সাধারণ মানুষ। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় পাক-বাহিনী পুলিশ লাইনের অস্রাগার দখলে এলে প্রতিরোধ যুদ্ধে পাবনার মানুষের প্রতম বিজয়ের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। সে রাতটা বিজয় আনন্দেই কাটলো সবার ।
২৮ মার্চ দিনভর পাক-বাহিনী ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় নিজ নিজ অবস্থানে চুপচাপ থাকে। এই প্রেক্ষিতে ২৭ মার্চের ন্যায় একই পদ্ধতিতে একতলা পুরাতন টেলিফোন ভবনের চুতুর্দিকের দালানের ছাদে সকলকে অস্র হাতে অবস্থান নিয়ে অপেক্ষমান রাখা হয়। তবে ঐদিন সকালে পুলিশের অস্রাগার ভেঙ্গে সমস্ত অস্র ও গুলি প্রশাসনের পক্ষ থেকেই প্রতিরোধ যোদ্ধা তরুণদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়ায় তরুণেরা অনেক বেশী উৎসাহিত হন।
টেলিভবনের দরজা-জানালা বন্ধ করে সৈন্যরা নানা ফাঁক ফোঁকর দিয়ে অস্র তাক করে অপেক্ষমান থাকলেও আকশ্মিক চতুর্দিক থেকে অসংখ্যা গুলিবর্ষনে দিশেহারা হওয়ার ফলে তাদের গুলি লক্ষ্যহীনভাবে নানা দিকে ছুটে যাওয়ার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ক্ষতি করতে না পারলেও ওপর থেকে চারিদিকের ছুটে গুলিতে সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং একে একে যখন গুলির আঘাতে তাদের পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনটির নানা দিক দিয়ে গুলি ঢুকতে
থাকায় দু’তিন ঘন্টার যুদ্ধে তারা সবাই মৃত্যু বরণ করে।
টেলিফোন ভবনের ভেতর থেকে গুলি আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাহিনীর থেকে যোদ্ধারা অভ্যন্তরে ঢুকে দেখেন ২৮ টি মৃতদেহ। উদ্ধার হলো অসংখ্য অত্যাধুনিক চাইনিজ রাইফেল ও গুলি। সমৃদ্ধ হলো যোদ্ধাদের অস্রের ভান্ডার। সাথে সাথে নবতর বিজয়ের উল্লাস। যোদ্ধারা টেনে লাশগুলি ঐ ভবনের সামনের ছোট্ট মাঠে পুকুরের পাড়ে এনে রাখেন জনসাধারণ যাতে দেখতে পায় শত্রু নিধনের চিত্রটি।
একই দিনে পাবনা-আতাইকুলা রোডের পার্শ্ববর্তী বিশাল মাঠের অভ্যুন্তরে একটি আধা পাকা টিনের ঘরে ৪জন পাক-সেনা ছিল ঐ রাস্তা দিয়ে চলমান গাড়ী ঘোড়ার প্রতি নজর রাখার জন্যে। কারণ ওটাই ছিল পাবনা- নগরবাড়ী রোড এবং তখন ঐ পথেই ঢাকা যাতায়াত করতে হতো সকলকে। যা হোক, দুপুরে ঐ ঘর আক্রমণ করতেই সেনারা কোনক্রমে বেরিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে প্রাণ ভয়ে ছুটতে থাকে এবং কয়েক মাঠ দৌড়ানোর পর তারা ক্লান্ত হয়ে একটি গ্রামে গাছতলায় লোকজন দেখে পানি পিপাসার কথা বললে তারা বাঁশের চরাটে সৈন্যদের বসতে দিয়ে পানি এনে খাওয়ায়। অত:পর অতর্কিতে পাশে ফেলে রাখা অস্রগুলি গ্রামের যুবকেরা তুলে
নিয়ে গুলিবর্ষন শুরু করলে ৪ জনই মারা যায়।
এবারে থাকলো ওয়াপদা ভবন ওদের হেডকোয়াটার। ২৮ মার্চ রাতেই ডাক বাংলোর অব অবস্থানরত সেনা ও কর্মকর্তারাও ওখানে চলে আসে। সেখান থেকে ওয়্যারলেসে মেসেজ পেয়ে ২৯ মার্চ ভোরে নাটোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে কয়েক ট্রাক পাক আর্মি সাদা পোষাকে সাদা পতাকা উড়িয়ে মুখে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে দিতে চলে আসে ওয়াপদা ভবনের সামনে। তৎক্ষণাতৎ পাক-সেনারা ভবনের অভ্যন্তরে আটক নেতৃবৃন্দকে গুলি করে মাটিতে দেহগুলি রেখে ছুটে গিয়ে ঐ ট্রাকে উঠে পড়লে একই পথে ট্রাকসহ নাটোর রওনা হয়।
ওদিকে আকাশে একটি বিমান উড়তে দেখা যায় এবং ঐ বিমান থেকে শহরে অজস্র গোলাবর্ষন হতে থাকে। প্রতিরোধ যোদ্ধারাও বিমানটিকে লক্ষ্য করে প্রচুর গুলি নিক্ষেপ করলেও তা বিমানের গায়ে লাগে নি।
আসলে ঐ ট্রাকগুলিতে পলায়নরত সৈন্যদের নিরাপদে ফিরে যাওয়ার সহায়তার জন্য ঐ বিমান কভারেজের ব্যবস্থা করে। কিন্তু ওদের কারসাজি বুঝে ফেলতেই পথের মোড়ে মোড়ে পাক-বাহিনী সশস্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তাৎক্ষণাতভাবে তৈরী নানা ব্যরিকেডও আর্মির গতি হ্রাস করায় এবং ফলে তারা গোলাগুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তেই এবং আক্রান্ত আহত নিহত হতে হতে যখন গোপালপুর (নাটোর) চিনিকলের কাছে গিয়ে পৌঁছায় ততক্ষণে প্রতিটি পাক সেনা খতম একবারেই নির্বংশ একটাও জীবিত ছিল না। প্রতিরোধ যোদ্ধারাও বেশ কিছু শহীদ হন। তবু বিজয় অর্জিত হলো। পাবনা শহর ও পাবনা জেলা পাক-বাহিনী মুক্ত হলো। দখল মুক্ত হলো পবনা জেলার সকল এলাকা। মানুষ বিজয়ী হলেন – অভূত পূর্ব এক দুঃসহাসী বিজয়। সেই থেকে “পাবনা মুক্ত দিবস” হিসেবে পালিত হয় ২৯ মার্চ।
তবে মুক্তিযুদ্ধ তো চলে নয় মাস ব্যাপী। পরবর্তী অভিজ্ঞতাগুলি মাঝে মাঝে কয়েকটি চালানে লিখে জানানোর বাসনা রাইলো।