মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী হাজারদুয়ারী
মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী হাজারদুয়ারী
-সেলিনা জাহান প্রিয়া
মুর্শিদাবাদে এসে হাজারদুয়ারী দেখেননি এমন মানুষ পাওয়া খুব দুষ্কর।হাজারদুয়ারী মুর্শিদাবাদের সাথে ওতপ্রত ভাবে জড়িত।হাজারদুয়ারী প্রাসাদের টানেই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মুর্শিদাবাদে আগমন ঘটে।সাধারন মানুষের মনে হাজারদুরী নিয়ে কৌতুহলের অন্ত নেই । এই নিবন্ধে হাজারদুয়ারী নিয়ে মানুষের কৌতুহলের কিছুটা নিবারন করার চেষ্টা করা হল।বড় কোঠি বা হাজারদুয়ারীকে অনেকেই নবাবী আমলের অন্যতম প্রতিক বলে মনে করলেও হাজারদুয়ারী যখন নির্মিত হয় তার বহু পূর্বেই বাংলার নবাবরা তাদের ক্ষমতা হারিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভাতা ভোগীতে পরিণত হয়েছিলেন।হাজারদুয়ারী যখন নির্মিত হয় বাংলার নবাব পদের অধিকারী তখন মীরজাফরের বংশধর নবাব হুমায়ন।
কথিত রয়েছে যে ১৮২৯ সালের ২৯ শে আগস্ট হাজারদুয়ারী প্রাসাদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন সয়ং নবাব হুমায়ন । প্রাসাদের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপিত হয়েছিল বৃটিশ স্থপতি ডানকান ম্যকলিয়ডের তৈরী নক্সায় ইতালীয় স্থাপত্যশৈলীতে। তৎকালীন গভর্নর লর্ড ক্যাভেন্ডিস সহ এই হাজারদুয়ারি প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তরের অনুষ্ঠানে গর্ভনর জেনারেলের এজেন্ট,মুর্শিদাবাদে বৃটিশ সেনা বাহিনীর কামান্ড্যান্ট,মুর্শিদাবাদে বসবাসকারী ইউরোপীয় অধিবাসী বৃন্দ এবং বিরাট সংখ্যক দেশীয় ব্যাক্তিরাও উপস্থিত ছিলেন।জনশ্রুতি রয়েছে যে নবাব ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণে সিঁড়ি দিয়ে আনেক নিচে নামেন এবং নিজে হাতে একটি সোনার ইট গেঁথে নির্মাণ কাজ শুরু করেন।প্রাসাদটি ইট দ্বরা নির্মিত এবং এটি নির্মাণ করতে চুন-সুরকি ও প্রচুর ডিমের কুসুম ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জাণা যায় এবং ১৮৩৭ সালের ডিসেম্বরে এই প্রাসাদটির নির্মাণ কার্য শেষ হয় ।
নিজামত ডিপোজিট ফান্ড থেকে এই প্রাসাদ নির্মাণ এর অর্থ ব্যয় করা হয় ।এই প্রাসাদটি ছিল ৪২৪ ফুট লম্বা এবং ২০০ ফুট চওড়া । এছাড়া এই প্রাসাদটি ছিল ৮০ ফুট উচ্চ । এই প্রাসাদটির বাইরে থেকে মধ্যে প্রবেশ করার জন্য ৩৭ টি সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয় । প্রাসাদটির মধ্যে চার কোণায় চারটি সিঁড়ি আছে । । এর প্রতিটি সিঁড়ির ৭৬ টি ধাপ রয়েছে । ভৃত্যদের জন্য এই সিঁড়ি ব্যতীত আরো চারটি সিঁড়ি রয়েছে।এই প্রাসাদটির হাযারদুয়ারি নামকরণের অন্যতম কারন প্রাসাদটির ১০০০টি দরজা।যার মধ্যে ৯০০ টি আসল এবং ১০০ টি নকল দরজা। কিন্তু গঠনশৈলীর কুশলতাই সেই পার্থক্য বোঝাই দুষ্কর।
সমগ্র প্রাসাদটি তিন তলা বিশিষ্ট।ইংরেজরা প্রাসাদটি নবাবকে তৈরী করে দিলে নবাব হুমায়ুন জাহাজারদুয়ারীতে স্বপরিবার শুধুমাত্র একটি রাত কাটিয়েছিলেন বলে জানা যায়।এর কারণ হিসেবে অনেকে দাবি করেন যে যেহেতু হাজারদুয়ারীতে কোন হারেম বা বেগমসহ অনান্য নারীদের বসবাস করার জন্য অন্তপুরের অনুপস্থিতি। ফলে র্দীর্ঘ দীর্ঘদিন ধরে হাজারদুয়ারী শুধুমাত্র নবাবের দপ্তর এবং ইংরেজদের অতিথিশালা হিসেবেই ব্যাবহৃত হয়ে এসেছে।১৯৬৯সালে নবাব পদ বিলুপ্ত হওয়ার পর দীর্ঘদিন হাজারদুয়ারী প্রাসাদটি অবহেলায় পড়ে থাকার পর ভারতীয় প্রত্ন ত্বত্ত বিভাগ সেটি অধিগ্রহন করে এবং সেখানে মিউজিয়াম চালু করে।
প্রাসাদের নিচের তলায় রয়েছে মহাফেজখানা, অস্ত্রাগার , রেকর্ড রুম এবং অন্যান্য অফিস।অস্ত্রাগারে রয়েছে প্রায় ২৭০০ টি অস্ত্র।তার মধ্যে নবাব আলিবর্দি ও সিরাজের তলোয়ার, মিরকাসিমের ছোরা, নাদির শাহের শিরিনাস্ত্র,প্রচুর বল্লম, ছোট কামান ছরা,তালোয়ার,তীর ধনুক, ঢাল, ছোট বড় নানান বন্দুক,লোহার তৈরি যুদ্ধের পোশাক সহ আরও অনেক কিছু।দোতলায় রয়েছে দরবার হল , ড্রয়িং রুম , প্রিন্সেস গ্যালারি , গ্রন্থাগার , আর্ট গ্যালারি , নাজিমের গ্যালারি , এজেন্টের গ্যালারি , দেওয়ান গ্যালারি এবং ব্যাংকুয়েট হল ডাইনিং হলদরবার হলটি চোখ জুরান।সেখানে রয়েছে নবাবের রৌপ্য সিংহাসন। ও রানি ভিক্টোরিয়ার দেওয়া একটি বৃহৎ ঝাড়বাতি।সমগ্র দ্বিতীয় তল জুড়েই রয়েছে প্রচুর তৈল চিত্র।তিনতলায় রয়েছে নাচ কক্ষ, অতিথি কক্ষ, ও নবাবের শায়নাগার ইত্যাদি।তবে এই অংশে জনগণের জন্য প্রবেশ এর কোন বন্দোবস্ত নেই।হাযারদুয়ারিতে যে গ্রন্থাগার রয়েছে সেখানে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১০৭৯২টি এবং পুঁথির সংখ্যা প্রায় ৩৭৯১ টি। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল আবুল ফজলের হাতে ‘আইন-ই-আকবরি’র পাণ্ডুলিপি, বাগদাদের সম্রাট হারুন-আল-রাসিদ এর হাতে কোরান সহ বহু দলিল-দস্তাবেজ, চুক্তি পত্র, নক্সা, সহ বহু কিছু। অন্য দিকে আর্ট গ্যালারি তে রয়েছে রাফেল,ভানডাইক, টিশিয়ান, মার্শাল প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা প্রায় ৪০০ টি ছবি। এই সব চিত্র গুলির মধ্যে ‘THE BURIAL OF SIR JOHN MORE’ ‘ADAM & EVE’ ‘BLACK BENT’বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এই মনোরম হাজারদুয়ারি প্রাসাদটি দেশ বিদেশের বহু ইতিহাস পিপাষূ মানুষের দৃষ্টি কাড়লেও প্রাসাদের প্রচুর দুষ্প্রাপ্য দ্রব্য সামগ্রী আজও অবহেলায় পড়ে রয়েছে। এছাড়াও হাজারদুয়ারীর তৃতীয় তল এখনও জনগণের জন্য মুক্ত নয়। প্রাসাদের বহু দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, দলিল দস্তাবেজ গুলি ইতিহাস গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত নয়।এই সব সমস্যা গুলি ভারতীয়ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সহানুভূতির সাথে সমাধানের চেষ্টা করলে হাজারদুয়ারী প্রাসাদের সুনাম দেশ-বিদেশে আরও ছড়িয়ে পড়বে,এবং জেলার ইতিহাস সমৃদ্ধ হবে। যা সব দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া মুর্শিদাবাদ জেলার অগ্রগতিতে সহায়ক হবে।
লেখা সুত্র – ইন্টারনেট, ভারতীয় ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস, বাংলা পিডিয়া।