টাঙ্গাইলের মৃৃৎ শিল্প আধুনিকতার থাবায় প্রায় বিলুপ্তির পথে
মো. রাশেদ খান মেনন (রাসেল), টাঙ্গাইল, বিশেষ প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
টাঙ্গাইলের মৃৃৎ শিল্প আধুনিকতার থাবায় প্রায় বিলুপ্তির পথে। উন্মুক্ত বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্প। অত্যাধুনিক প্লাস্টিক, অ্যালুমোনিয়াম ও মেলামাইনের তৈজসপত্রের দাপটে এ শিল্প প্রায় বিলুপ্ত। ফলে জেলার প্রতিভাবান মৃৎ শিল্পীরা অর্থাভাবে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। টাঙ্গাইল জেলায় এক সময় তৈজসপত্রের চাহিদা পুরণ করত মাটির তৈরি হাড়ি, পাতিল, কলসি, থালা (সানকি), কুয়ার পাট, নানা ধরণের খেলনা, বিভিন্ন পিঠা তৈরির খরমা (সাজ) ইত্যাদি। গ্রাম্য মেলা ও হাট-বাজারে মাটির তৈরি ওইসব পণ্য শোভা পেত। মাটির তৈরি এসব পারিবারিক তৈজসপত্র বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থসম্মত ও সুস্বাদুপণ্যের আধার হিসেবে পরিগণিত। মাটির তৈরি উৎকৃষ্টমানের ওইসব তৈজসত্রের স্থান দখল করে নিয়েছে অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক ও মেলামাইনের তৈরি তৈজসপত্র। গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন উৎসব মেলা বা হাট-বাজারে প্রাকৃতিক উপাদানের তৈরি মৃৎশিল্পের পণ্য সামগ্রীর জায়গা নিয়েছে কৃত্তিমভাবে তৈরি তৈজসপত্র। টাঙ্গাইল বিসিক অফিস সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ১৫৮টি কুমার পরিবার, বাসাইলে ১১৫টি, নাগরপুরে ১০৭টি, মির্জাপুরে ৯৯টি, দেলদুয়ারে ৬৫টি, ঘাটাইলে ৬০টি, ভূঞাপুরে ফলদা কুমার পাড়ায় ২২০টি, কালিহাতীতে ২৮০টি, গোপালপুরে ১১২টি, ধনবাড়ীতে ১০টি এবং মধুপুর উপজেলায় ৯টি কুমার পরিবার বসবাস করছে। জেলায় এক হাজার ২৩৫টি কুমার পরিবার থাকলেও তাদের অধিকাংশই পৈত্রিক পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, মৃৎ শিল্পীরা সুনিপুন শৈল্পিকতায় তৈরি করছেন পুতুল, ফুলের টব, কুয়ার পাট, হাঁড়ি-পাতিল, খেলনা, শো-পিস ‘সহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় ও সৌখিন জিনিসপত্র। এসব পণ্য তারা শহরের দোকান এবং বাসা-বাড়িতে বিক্রি করে থাকেন। বর্তমান সামাজিকতায় মৃৎ শিল্পের তৈজসপত্রের ব্যবহার চোখে পড়ে না, সৌখিন জিনিসপত্র এবং কুয়ার পাট তৈরিই মৃৎশিল্পীদের জীবিকার একমাত্র ভরসা। মৃৎশিল্পীরা জানায়, নানা উৎসব-পার্বণে জেলার বিভিন্ন এলাকায় আয়োজিত মেলায় আগতরা সখের বসে মাটির তৈরি ব্যাংক, পুতুল, ঘোড়া ও গরুর গাড়ি, কারুকার্যকৃত ফুলদানী ইত্যাদি কিনে থাকে। করোনাকালে মেলার আয়োজনও বন্ধ থাকায়, জেলার মৃৎশিল্পীরা বেকার জীবন কাটিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তারা ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রসুলপুর জামাই মেলার আয়োজকদের অন্যতম ও গালা ইউপি চেয়ারম্যান রাজকুমার সরকার জানান, প্রায় দেড়শ’ বছরের ঐতিহ্য রসুলপুরের জামাই মেলা। এক সময় এ মেলার অন্যতম আয়োজন ছিল মাটির তৈরি তৈজসপত্র। জেলার মৃৎশিল্পীরা প্রতিবছর তাদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে মেলার আকর্ষন বাড়ানোর পাশাপাশি ক্রেতাদের কাছে টানতো। মাটির তৈরি জিনিস-পত্রের ব্যবহার কমে যাওয়ায় এখন হাতেগোনা কয়েকজন মৃৎশিল্পী নানা ধরণের খেলনা, ফুলদানী ও শো-পিস নিয়ে মেলায় অংশ গ্রহন করে থাকে। মেলার মৃৎশিল্পের সে স্থান এখন কাঠের তৈরি ফার্ণিচার দখল করে নিয়েছে। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাসাখানপুরের চৈতি পাল, বাদল পাল, ঝর্ণা রাণী পাল, দেলদুয়ারের গমজানির নিমাই পাল, মির্জাপুরের গণেশ পাল, ভূঞাপুরের ফলদা কুমার পাড়ার পিয়াতা পাল, কালিহাতী উপজেলার স্বপন পাল, বাদল কুমার পাল সহ অনেকেই জানান, মাটির তৈরি তৈজসপত্র এক সময় ঘর-গৃহস্থালীর প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এমনিতেই বর্ষাকালে মাটির তৈরি পণ্য রোদে শুকানো যায়না ও চুলায়(পুন/মুখাই/ভাটা) আগুন দেওয়া যায়না। এ কারণে মৃৎশিল্পীদের বছরের ৩-৪মাস বেকার সময় কাটাতে হয়। বর্তমানে প্লাস্টিক, মেলামাইন ও অ্যালুমোনিয়ামের তৈজসপত্র সহজলভ্য হওয়ায় মাটির তৈরি পণ্যের ব্যবহার মৃৎ শিল্পের ভবিষ্যত অন্ধকার করে দিয়েছে। ফলে মৃৎ শিল্পীরা তাদের বাপ-দাদার পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। পৈত্রিক পেশাকে টিকিয়ে রাখতে জড়িতরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি করেন। টাঙ্গাইল বিসিক শিল্প নগরীর কর্মকর্তাগণ বলেন, বিসিক থেকে সরকারি সহযোগিতায় মৃৎ শিল্পীদের বিভিন্ন ধরনের কারিগরী ও আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হয়। যে সব মৃৎ শিল্পীরা শো-পিস তৈরি করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও ব্যাংক ঋণে সহযোগিতা করা হয়। তারা আরো বলেন, যারা মাটির তৈরি শো-পিস তৈরি করে থাকেন মেধা বাছাই করে তাদের মধ্য থেকে মেধাবীদের শিল্পভবনে তিন মাসের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবসা করার জন্য বিসিকের মাধ্যমে স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। মৃৎ শিল্প রক্ষায় এখনই সময়োপযোগী পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।