রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িতরা চিহ্নিত
অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে রিজার্ভ চুরির সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ১৬ কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। প্রথম থেকেই তারা সন্দেহের তালিকায় আছেন। কিন্তু ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তারা বহাল তবিয়তেই চাকরি করছেন। তবে তারা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে সেজন্য পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৬ কর্মকর্তার মধ্যে অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের চারজন, পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের চারজন, আইটি অপারেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের চারজন, ফরেন রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দু’জন এবং ব্যাংক অফিস অব দ্য ডিলিংস রুমের এক কর্মকর্তার নাম আছে বলে জানা গেছে। এর বাইরে এক নির্বাহী পরিচালকের নামও আছে সিআইডির তালিকায়। তদন্তের স্বার্থে সংস্থাটি এ মুহূর্তে তাদের নাম প্রকাশ করছে না। তবে তদন্তে শনাক্ত হওয়া সবার বিরুদ্ধেই চার্জশিট হবে বলে জানিয়েছে সিআইডি। সুইফট ইনচার্জ যুবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মামলা করেছিলেন। কিন্তু তাকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছে সিআইডি। রিজার্ভ চুরির পর থেকে এ পর্যন্ত ২ কোটি ডলার ফেরত পাওয়া গেছে। বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার ও তদন্ত তদারক কর্মকর্তা মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, বলা চলে বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের তদন্ত শেষ। এ অংশের তদন্তে রিজার্ভ চুরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত দেশীয় অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে আরও গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। একই সঙ্গে ফিলিপাইনসহ যেসব দেশে আমাদের টাকা চলে গেছে এবং যাদের মাধ্যমে গেছে, তাদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে আমরা চিঠি দিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনান্সিয়াল ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। বিদেশি অপরাধীদের বিরুদ্ধে কি ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে জানতে চাইলে মোল্লা নজরুল বলেন, রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িতদের নাম দিয়ে বলেছি, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য আমাদের দিতে হবে, যা আদালতে এভিডেন্স হিসেবে আমরা কাজে লাগাতে পারব। তিনি বলেন, চক্রটির পরিকল্পনা ছিল ৩৫টি পেমেন্টের মাধ্যমে ২ বিলিয়ন ডলার সরানোর। তারা ৫টি পেমেন্ট নিয়ে গেছে। যার মাধ্যমে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার সরানো সম্ভব হয়।
এদিকে সিআইডি তদন্তে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দেশের বাইরের ৩৩ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। এর মধ্যে পিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের (আরসিবিসি) ১০ কর্মকর্তার নাম আছে। তারা অর্থ সরানোর সঙ্গে জড়িত। তদন্তে তাদের অপরাধ প্রমাণিত। আরসিবিসি ছাড়াও ফিলিপাইনের ফিনলে নামে একটি মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির মালিক, তার ব্যক্তিগত সেক্রেটারি ও কোম্পানির ম্যানেজারের বিরুদ্ধে তথ্য পাওয়া গেছে। ফিলিপাইনের তিনটি ক্যাসিনোর ৩ জনের বিরুদ্ধেও তথ্য মিলেছে। শ্রীলংকার সালিকা এনজিওর (সালিকা ফাউন্ডেশন) চেয়ারম্যান ও ৬ পরিচালকসহ ৭ জন, সালিকা এনজিওর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া ২ জন হ্যাকারও আছে সিআইডির তালিকায়। এছাড়া সিআইডির তদন্তে জাপানের একজন হ্যাকার ও মানি লন্ডারার, সুইফটের ৫ জন এবং চীনের ২ জনের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ঘটনার সঙ্গে সুইফট কি করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জড়ালো তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। তদন্ত দল কয়েক দফায় বিদেশ গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। এরা সবাই সিআইডির চার্জশিটভুক্ত আসামি হবে।
সিআইডি বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন অনেকেই শুধু গাফিলতিই করেননি, ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত ছিলেন এবং তারা অপরাধও করেছেন। সিআইডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের দৃষ্টিতে রিজার্ভ চুরিতে ‘লট অব’ ক্রিমিনাল আছে। এতে উচ্চ পর্যায়ের অনেকেই জড়িত। তাদের অপরাধ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। তাদের ষড়যন্ত্রের তথ্য-প্রমাণও পাওয়া গেছে। যেগুলো একত্রিত করে চার্জশিট দেয়া হবে। যাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ফেঁসে যাবেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্টদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে একটি বেসরকারি ব্যাংকের তিন শীর্ষ কর্মকর্তা জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য বেরিয়ে এসেছে। হ্যাকিংয়ের ঘটনার পর বেসরকারি ব্যাংকের ওই কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সহায়তায় সুইফট লেনদেনের সার্ভারে ‘রি-ইন এর (পুনঃপ্রবেশ) চেষ্টা করেছিল। এ অবস্থায় তারা পুনরায় সার্ভার চালুর চেষ্টা করে, যাতে হ্যাকাররা পরের ধাপে অর্থ সরাতে পারে। ফের সার্ভার চালু করতে পারলে তারা আরও অনেক বেশি টাকা হাতিয়ে নিত।
দেশের বাইরের অপরাধীদের বিষয়ে সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার পুরোপুরি হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কিন্তু তারা ওই সময় অর্থ চুরি করেনি। পরে ১ ফেব্রুয়ারি তারা ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (আরসিবিসি) জুপিটার স্ট্রিট শাখায় একটি ভুয়া হিসাব খোলে। হিসাবটি খোলেন উইলিয়াম সোগো নামে ফিলিপাইনের এক নাগরিক। ৫টি সুইফট বার্তার মাধ্যমে ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাব থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সোগোর ওই অ্যাকাউন্টে সরানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ‘স্টপ পেমেন্ট অর্ডার’ রিকুয়েস্ট পাঠানোর পরও তা আমলে নেয়নি আরসিবিসি। বরং আরসিবিসির অন্তত ১০ কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ সহায়তায় পর্যায়ক্রমে ওই অর্থ সরিয়ে নেয়া হয়। বাকি ২ কোটি ডলার যায়, শ্রীলঙ্কার প্যান এশিয়া ব্যাংকিং কর্পোরেশনে থাকা বেসরকারি সংস্থা সালিকা ফাউন্ডেশনের হিসাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্টপ পেমেন্ট অর্ডার পাওয়ার পর ওই অর্থ ছাড় করেনি প্যান এশিয়া ব্যাংকিং কর্পোরেশন। সিআইডির তদন্তে শ্রীলংকার সালিকা এনজিওর (সালিকা ফাউন্ডেশন) চেয়ারম্যান ও ৬ পরিচালকসহ ৭ জন এবং এদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া ২ হ্যাকারের নাম বেরিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে শ্রীলংকার একটি আদালত সালিকা ফাউন্ডেশন নামের ওই দেশের এনজিওর ৬ পরিচালকের বিদেশ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ রয়েছে। ওই দেশের পুলিশ বলছে, একটি বেসরকারি ব্যাংকে ওই এনজিওর অ্যাকাউন্ট খোলার ৬ দিন পরই ওই অ্যাকাউন্টিতে ২ কোটি ডলার জমা হয়- যা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ।
রিজার্ভ চুরির ৪০ দিন পর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যুগ্ম পরিচালক যোবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেন। মামলার তদন্ত করছেন সিআইডির এডিশনাল এসপি রায়হান উদ্দিন খান। মামলা তদন্তের জন্য ২৫ সদস্যের একটি বিশেষ টিমও কাজ করছে।
সূত্রঃ যুগান্তর।