মিয়ানমারের বর্বরোচিত রোহিঙ্গা নির্যাতন

 

 

সিডনীর কথামাল-৫৩

রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
E-mail:raneshmaitra@gmail.com

 

সম্প্রতি নতুন করে মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নির্মম নির্যাতন সুরু হয়েছে। এই নির্যাতন অতীতেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে। চালিয়েছে সে দেশের সামরিক সরকার। কোন রাখঢাক না করে সরাসরি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে এই বর্বর নির্যাতন চালানো হচ্ছে বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করে।

এবার সেটা সুরু হয়েছে সপ্তাহ দুয়েক আগে-নভেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশকে রোহিংঙ্গারা মনে করেন একমাত্র আশ্রয় শিবির। কারণ সম্ভবত: এই যে তাঁরা মনে করেন যেহেতু বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান উভয়েই মুসলিম রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সুতরাং ধর্মীয় কারণেই তাঁরা এখানে আশ্রয় পেতে দাবীদার। তদুপরি, বাংলাদেশ তাদের নিকটতম প্রতিবেশীও।

একদিকে, অন্তত: আশীর দশক থেকে শুরু করে এ যাবত আনুমাণিক লাখ পাঁচেক রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চল এলাকায় এসে ও স্থায়ীভাবে বাড়ীঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন-টাকা-পয়সার বিনিময়েই হোক আর যেভাবেই হোক অনেকেই আবার বাংলাদেশের নাগরিকত্বের খাতায় সপরিবারে নামও লিখিয়ে ফেলেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র পেছেয়েন, ভোটার তালিকায় নিজেদের নাম তুলে ফেলেছেন এবং দিব্যি বাংলাদেশের পাসপোর্টও পেয়েছেন। এবং সব কটি কাজই পৃথিবীর যে কোন দেশে অসম্ভব – কিন্তু তা বাংলাদেশে শুধুমাত্র সরকারী আমলাদের অসততার কারণে সম্ভব হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো- অতীতে আসা এই যে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা এ দেশে বসবাস করছেন অবৈধভাবে – যদি মিয়ানমার সরকার তাঁদেরকে ফেরত নিতে রাজীও হন-তাঁরা কি যাবেন ফিরে? উত্তরে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে দু’চার শত রাজী হলেও তাতে পারেন বাকীরা যাবেন না। কারণ এঁদের অনেকেই বৈধ – অবৈধ পথে বিপুল অর্থ সম্পদের মালিকানা অর্জন করে ফেলছেন বাংলাদেশে। যা মিয়ানমারে গেলে হয়তো তাঁরা ধরে রাখতে পারবেন না। হয়তো বা সে দেশের পরিস্থিতিতে তাঁদের পক্ষে অর্থবিত্ত – বৈভব অর্জন করা ও তা রক্ষা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জন্য এ এক সামাজিক নৈতিক সংকট ও বটে।

কিন্তু এই কথাগুলির পেছনেও তো অনেক কথা-রয়েছে যার কোন উত্তর আপাতত: কোন মহল থেকেই গণতান্ত্রিক অধিকার – মানবাধিকার ভোগ করেন? স্পষ্টত জবাব, না।

বিগত নির্বাচনে সামরিক শাসকেরা যে সকল প্রতশ্রিুতি দিয়েছিল তার মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার – তারা তাদের মত করেই পালন করে চলেছে। অর্থাৎ মূল ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতে। সে কারণেই অংসসানগুচি এবং তাঁর ল বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেও শুচি সেদেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধান উপদেষ্টা মাত্র। উপদেষ্ট এমন একটি পদ যাতে কোন কিছু করার বা নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা সম্ভবত তাঁর হাতে নেই। এ সরকার তাই মিয়ানমারের অগণতান্ত্রিক সেনাবাহিনীর সাথে আপোষের সরকার-গণতান্ত্রিক সরকার আদৌ নয়।

কিন্তু তাই বলে ঐ দেশের নাগরিক হওয়া সত্বেও রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনী বর্বর অত্যাচার চালিয়ে যাওয়া সত্বেও, অংসান শুচি ও তাঁর ন্যূনতম প্রতিবাদ করবেন না-এটা মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। বরং তাঁর ন্যূনতম করনীয় হলো রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, তাদের উপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন বন্ধ করা, নির্য্যাতীদের উপর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দান ও সেনা নির্য্যাতনের ফলে যে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গ বাংলাদেশ সহ নানা দেশে-রিফিউজি হিসেবে বসবাস করছেন-তাঁদের মিয়ানমার সরকারের উদ্যোগে সম্মানে ফিরিয়ে নেওয়া এবং যাঁরাই রোহিঙ্গাদের উপর এ যাবত নির্য্যাতন করেছে তাদের বিচার করে কঠোর শাস্তি প্রদানের দাবী উত্থাপন করা ও ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলিতে গিয়ে সব কিছু স্বচক্ষে দেখে ক্ষতি গ্রস্থ মাসুষদের প্রতি সহমর্মিতা জানানো।

জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে রোহিঙ্গাদের স্থান দেওয়ার আবেদন অযৌক্তিক। কারণ তাঁরা ঐ সরকারকে নির্য্যাতন বন্ধ করার জন্য কার্য্যকর কোন ব্যবস্থা দুই দুইটি দশকেও গ্রহণ করে নি। দীর্ঘকাল যাবত পাঁচলক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বাস করছে-মিয়ানমার সরকার তাদেরকে ফিরিয়ে নিতে কার্য্যত অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। কাজেই অভিজ্ঞতা আদৌ মধুর নয়।

এ অবস্থায় যাঁরা রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অকথ্য নির্যাতনকে “মুসলামন-বিরোধী কার্য্যকলাপ” বলে তার স্বরে চীৎকার করছেন-তাঁরাই ঐ নির্য্যাতীত রোহিঙ্গাদের বন্ধ নন-কপট মিত্র বটে। কারণ ঐ ধরণের প্রচারের ফলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না-বরং মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধীবাসীদেরকে – যাঁরা ধর্মবিশ্বাসে বৌদ্ধ বা বুড্ডিষ্ট তাঁরা উগ্র মুসলিম – বিরোধী হয়ে উঠতে পাবেন। তাই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির এই অপচেষ্টা থেকে সকলের অবিলম্বে বিরত হওয়া উচিত।

আরাকান প্রদেশে মুসলিম ছাড়াও হিন্দু ও খৃষ্টান বসতিও আছে।

বেশ কিছুদিন আগে মিয়ানমারের থেকে পরিবার এবং এক লক্ষ মুসলিম বিতাড়িত হন। হিন্দুরা ভারতে এবং মুসলিমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় পান। তখন দেশের জনসংখ্যাও ছিল কম। কাজেই দেখা যাচ্ছে ও খানে আরাকানীদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় নয় জাতিগতক সংখ্যালঘু বিতাড়নের ষড়যন্ত্র বহু পুরাতন এবং তা আজও দিব্যি বহাল আছে।

ঐ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সাংস্কৃতিক চেতনা ইত্যাদি সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণাই নেই তবে সাধারণভাবে ধরে নিতে পারি দীর্ঘকাল মুসলিম বাদশা দ্বারা এবং পরবর্তীতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা শাসিত এই দেশ (মিয়ানমার) ১৯৪৮ সালে ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করলেও সে দেশের জনগণ কদাপি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বাদ পায় নি। সে কারণে গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশও ঐ দেশে ব্যাহত হয়েছে।

তবে বহুকাল আগে ঐ দেশে প্রাচীন যে সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়-সেই সভ্যতার নাম নিশানাও আজ আর দৃশ্যমান নয়। এক গভীর সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার সংকটে পিতিত হয়েছে মিয়ানমারবাসীদেরকেই সোচ্চার হতে হবে-গণতন্ত্রের যে সংগ্রাম অংসান সুচির নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল-তাকে তার যৌক্তিক এবং সকল পরিসমাপ্তির পথেও নিয়ে যেতে হবে। শুচিকে তাঁর দলের এবং সর্বোপরি তাঁর অর্জিত নোবেল পুরস্কারের মর্য্যাদাও রক্ষা করতে এগিয়ে আসা আজ অত্যন্ত জরুরী শুধু রোহিঙ্গাদের স্বার্থে নয়-ব্যাপক অর্থে মিয়ানমার ও তার সকল অধিবাসীদের স্বার্থেই।

আজ আন্তর্জাতিকতার যুগ। মিয়ানমার আন্তর্জাতিক পরিসবে কোন খ্যাতি বা প্রভাব রাখে না। তাই জাতিসংঘ, ও আই সি প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সামরিকভাবে হলেও তাদেরকে বাঁচাতে। আর মিয়ানমার সরকারের উপর ব্যাপক চাপ বৃদ্ধি করে সে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠ, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি সহ অপরাপর ন্যয্য দাবীগুলি আদায়ে।

কিন্তু অমানুষিক, অমানবিক ও নিষ্ঠুর নির্য্যাতনের শিকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য এই মুহুর্তের করনীয় যেন আন্তর্জাতিক মহল বিস্মৃত না হন। বস্তুত:ই তারা অগ্নিসংযোগ মারধর, ধর্ষণ ও লুটপাটের যে ভয়াবহ শিকারে পরিণত তাতে আপাতত: তাদের ঐ দেশে বাস করা দুরুহ। তাই সাময়িকভাবে হলেও, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযক্ত আরব আমীরাত ও সৌদি আরব প্রভৃতি দেশে তাদেরকে অভিবাসী হিসেবে থাকতে দিলে এবং একই সাথে মিয়ানমার সরকারের উপর সকল মহল থেকে চাপ সৃষ্টি করে সমস্যাটির তাৎক্ষণিক, মধ্যমোয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। সময় সাপেক্ষ হলেও এই পথেই বিষয়টির সমাধান সম্ভব।

বাংলাদেশ এতই বেশী over populated যে তার আর নতুন করে অভিবাসী আশ্রয়দান অসম্ভ। তবে বাংলাদেশ সম্ভাবের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের নির্যাতিতদের ব্যাপারে নানা আন্তর্জাতিক মহলের সাথে কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করা প্রয়োজন।

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!