শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মহিয়সী নারী, মাদার তেরেসা
‘কেবল সেবা নয়, মানুষকে দাও তোমার হৃদয়। হৃদয়হীন সেবা নয়, তারা চায় তোমার অন্তরের স্পর্শ’—এরকম নিছক একটি বাণীই বলে যাননি, আমৃত্যু আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সারাবিশ্বের মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন মহীয়সী মাদার তেরেসা। সমাজের যারা বিভিন্ন দিক থেকে অবহেলিত, মাদার তেরেসা তাদেরই বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
মাদার তেরেসার আসল নাম (আলবেনীয়: Tereza), আনিয়েজ গঞ্জে বয়াজিউ (আগস্ট ২৬, ১৯১০ – সেপ্টেম্বর ৫, ১৯৯৭)ছিল একজন আলবেনীয়-বংশোদ্ভুত ভারতীয় ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী।।
অটোম্যান সাম্রাজ্যের ইউস্কুবে (অধুনা ম্যাসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের রাজধানী স্কোপিয়ে) জন্মগ্রহণ করেন। তবে ২৬ অগস্ট জন্ম হলেও তিনি ২৭ অগস্ট তারিখটিকে তাঁর “প্রকৃত জন্মদিন” মনে করতেন; কারণ ওই তারিখেই তাঁর ব্যাপটিজম সম্পন্ন হয়েছিল। তিনি ছিলেন নিকোলো ও দ্রানা বয়াজুর কনিষ্ঠ সন্তান। তাঁদের আদি নিবাস ছিল আলবেনিয়ার শ্কড্যর্ অঞ্চলে। তাঁর পিতা আলবেনিয়ার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯১৯ সালে মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মা তাঁকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে লালন-পালন করেন। জোয়ান গ্র্যাফ ক্লুকাস রচিত জীবনী থেকে জানা যায়, ছোট্টো অ্যাগনেস মিশনারিদের জীবন ও কাজকর্মের গল্প শুনতে বড়োই ভালবাসতেন। ১২ বছর বয়সেই তিনি ধর্মীয় জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে একজন মিশনারি হিসেবে যোগ দেন সিস্টার্স অফ লোরেটো সংস্থায়। মা আর দিদিদের সঙ্গে আর তার কোনোদিন দেখা হয়নি।
তৎকালীন সময়ে ভারতে বাংলায় ধর্মীয় কাজ করতেন যুগোস্লাভিয়া ধর্মযাজকরা। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল, লরেটা সিস্টারদের মধ্যে যারা আইরিশ সম্প্রদায়ভুক্ত তারা যাবেন ভারতবর্ষের মতো এলাকায় কাজ করতে। মাদার তেরেসা তাই তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করতে চাইলেন। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের দার্জিলিংয়ে ১৯২৮ সালে সন্ন্যাসিনী হওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। ১৯২৯ সালের ৬ জানুয়ারি কলকাতা পৌঁছলেন। ১৯৩১ সালের ২৪ মে সর্বপ্রথম দারিদ্র্য, বার্ধক্য ও সংযমের সাময়িক সংকল্প গ্রহণ করেন তেরেসা। লরেটো কনভেন্ট স্কুলে শুরু হলো তার শিক্ষিকা জীবন। পাশাপাশি তিনি একটি হাসপাতালেও কাজ করতেন। সেখানেই সর্বপ্রথম দুঃখ ও দারিদ্র্যের সঙ্গে তাকে সংগ্রাম করতে হয়, যা ছিল তার কল্পনারও বাইরে। শিক্ষিকা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভালো এবং সফল। ১৯৩৭ সালের ১৪মে সিস্টার তেরেসা তার জীবনের গতি পরিবর্তনের চিন্তা করে সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নেন।
দুস্থ মানুষকে সাহায্য করার কাজটি যেন তার কাছে নেশার মতো হয়ে গেল। আর্তমানবতার সেবা করার জন্যই যেন তার জন্ম হয়েছে। আজীবন এটাই তিনি করতে চান। এরপর সত্যি সত্যি তিনি সম্পূর্ণভাবে মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করার সংকল্পে লরেটো স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন।
তিনি যখন লরেটো স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন, তখন তার হাতে ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। এ রকম নিঃস্ব অবস্থাতেই তিনি স্কুলের সাজানো ফুলের বাগান, স্নিগ্ধ পরিবেশ, সুখময় নিশ্চিন্ত জীবন ফেলে এসে আশ্রয় নিলেন শিয়ালদহ রেলস্টেশন-সংলগ্ন এক পুরোনো ভাঙাবাড়িতে। কলকাতার অলিগলি আর বস্তিতে ঘুরে বেড়াতে থাকেন, উদ্দেশ্য অসহায় মানুষেদের সেবা করা।
এরপর মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা করেন ‘মিশনারিজ অব চ্যারিট’। যার শাখা বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে।
১৯৫২ সালে এই চ্যারিটির অধীনেই গড়ে উঠে ‘নির্মল হৃদয়’, কুষ্ঠ রোগীদের জন্য ‘শান্তি নগর’। ১৯৫৫ সালে স্থাপন মাদার তেরেসা স্থাপন করেন ‘নির্মল শিশুভবন’। ১৯৬৩ সালে গড়ে তোলা হয় ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’-এর ব্রাদার শাখা। মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে যে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল সময়ের ব্যবধানে তা কয়েক হাজারে পৌঁছায়। তারা সবাই বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪৫০টি সেবা কেন্দ্রে মানবসেবার কাজ করে যাচ্ছিল।
ভারতের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের দু:স্থ মানুষদের সেবা করার জন্য ভারতের বাইরে প্রথমবারের মতো ১৯৬৫ সালে ভেনিজুয়েলায় মিশনারি অব চ্যারিটির শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৮ সালে রোম, তানজানিয়া এবং অস্ট্রিয়াতে শাখা খোলা হয়। ১৯৭০-এর দশকে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েক ডজন দেশে শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।
মানবতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মাদার তেরেসা ঘুরে বেড়িয়ে ছিলেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। সব বাঁধা পেরিয়ে গড়ে তোলেন মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত। সবচেয়ে যারা গরিব, সবচেয়ে করুণ যাদের জীবন- তাদের সেবা করাই ছিল মাদার তেরেসার ব্রত। ১৯৪৮ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনি ভারতের নাগরিকত্ব লাভ করেন। আমৃত্যু পর্যন্ত তিনি অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কলকাতার মাদার হাউসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহাত্মা নারী।
(১৯৮৩ সালে পোপ জন পল ২ এর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রোম সফরের সময় মাদার তেরেসার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। ১৯৮৯ সালে আবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তার দেহেকৃত্রিম পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়া হওয়ায় হৃদরোগের আরও অবনতি ঘটে। এই পরিস্থিতিতে তিনি মিশনারিস অফ চ্যারিটিরপ্রধানের পদ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু চ্যারিটির নানরা গোপন ভোটগ্রহণের পর তেরেসাকে প্রধান থাকার অনুরোধ করে। অগত্যা তেরেসা চ্যারিটির প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে পড়ে গিয়ে কলার বোন ভেঙে ফেলেন। আগস্টে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এর পাশাপাশি তার বাম হৃৎপিণ্ডের নিলয় রক্ত পরিবহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। ১৯৯৭ সালের ১৩ই মার্চ মিশনারিস অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাড়ান। ৫ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।)
তিনি জীবনে বিভিন্ন সরকার ও প্রতিষ্ঠান থেকে বহু পুরস্কার পেলেও এ নিয়ে তার কোনো গর্ব ছিল না বরং তিনি পুরস্কার হাতে নিয়ে বিব্রত কণ্ঠে বলতেন, ‘আমি অতি ক্ষুদ্র। আমার শক্তি আমার কর্মবাহিনী আর জনগণের ভালোবাসা। এ পুরস্কার তো তাদের প্রাপ্য।’
মাদার তেরেসা প্রথম পুরস্কার পান ১৯৬২ সালে। ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করে। পরে দুস্থ মানবতার সেবায় আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ মাদার তেরেসা ১৯৭৯ সালে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ১৯৭১ সালে পোপ জন শান্তি পুরস্কার, ১৯৭২ সালে জওহরলাল নেহরু, ১৯৮০ সালে ভারতরত্ন, ১৯৮৫ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম, ১৯৯৪ সালে কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল সহ বিভিন্ন দেশের অসংখ্য পুরস্কার ও সাম্মানিক উপাধিতে ভূষিত হন। কলকাতার স্বর্গীয় টেরিজা হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে মাদার তেরেসাকে।
জাতিসংঘ মাদার তেরেসার গড়া মিশনারি অব চ্যারিটি সংগঠনটিকে সম্মাননা জানাতে প্রচলন করেছিল, সেরেস মেডেল। এ মেডেলের এক পিঠে ছিল ভিক্ষাপাত্র হাতে অপুষ্টিতে ভোগা একটি শিশুর মূর্তি আর অন্য পিঠে মাদার তেরেসার ছবি।
মৃত্যুর সময় মাদার তেরেসার মিশনারিস অফ চ্যারিটিতে সিস্টারের সংখ্যা ছিল ৪,০০০; এর সাথে ৩০০ জন ব্রাদারহুড সদস্য ছিল। আর স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ছিল ১০০,০০০ এর উপর। পৃথিবীর ১২৩টি দেশে চ্যারিটির কাজ পরিচালিত হচ্ছিল।
মাদার তেরেসার সবচেয়ে বড় অর্জন বলা যায়, তার দেখিয়ে দেওয়া আদর্শকে। তার আদর্শের মৃত্যু হয়নি। তার আদর্শ নিয়ে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ এর লাখো সিস্টার মানবসেবায় নিয়োজিত আছেন।
মাদার তেরেসা আজ আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু মানবতার প্রতীক হিসেবে তিনি অমর হয়ে আছেন বিশ্ববাসীর কাছে।
মাদার তেরেসার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বাণী-
১। আনন্দই প্রার্থনা, আনন্দই শক্তি, আনন্দই ভালোবাসা।
২। হৃদয়কে স্পর্শ করতে চায় নীরবতা। কলরবের আড়ালে নীরবেই পৌঁছাতে হয় আর্তের কাছে।
৩। কেবল সেবা নয়, মানুষকে দাও তোমার হৃদয়। হৃদয়হীন সেবা নয়, তারা চায় তোমার অন্তরের স্পর্শ। দিয়ে যাও যতক্ষণ যন্ত্রণা তোমায় বিদ্ধ না করে। জানবে, সত্যিকারের ভালোবাসা যন্ত্রণারই অপর নাম। হৃদয়ের বেদনাই সত্যিকারের ভালোবাসার উৎস।
ডায়রিতে লেখা:
Our Lord wants me to be a free nun covered with the poverty of the cross. Today I learned a good lesson. The poverty of the poor must be so hard for them. While looking for a home I walked and walked till my arms and legs ached. I thought how much they must ache in body and soul, looking for a home, food and health. Then the comfort of Loreto [her former order] came to tempt me. ‘You have only to say the word and all that will be yours again,’ the Tempter kept on saying … Of free choice, my God, and out of love for you, I desire to remain and do whatever be your Holy will in my regard. I did not let a single tear come.
কাগজ২৪/প্রকাশক ও সম্পাদক/মাহবুব এইচ শাহীন