শাল্লার নোয়াগাঁওঃ কলম আর চলতে চাইছে না

শাল্লার নোয়াগাঁওঃ কলম আর চলতে চাইছে না
রণেশ মৈত্র (একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

গত বুধবারের ঘটনা। ঘটনাস্থল সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে। ইসলাম অবমাননা’র মিথ্যে এবং চিরাচরিত অভিযোগে এলাকার এবং আশপাশের গ্রামের হেফাজত সমর্থক উগ্রপন্থীরা ওই গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে তান্ডব চালিয়ে হিন্দুদের শতাধিক বাড়ী ও বেশ কয়েকটি মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট করে বাধা বিপত্তিহীনভাবে চলে যায়। তারা একটি মন্দির থেকে একটি কষ্টিপাথরের মূর্তিও নিয়ে যায়।

কারণ? আগের দিন ঐ গ্রামে হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হক ওয়াজ করেন। ওয়াজ করা কালে, প্রত্যক্ষদর্শী ও শ্রোতাদের বক্তব্য অনুযায়ী, “উস্কানিমূলক সাম্প্রদায়িক” বক্তব্যদেন।

জানা যায়, ঐ গ্রামের ঝুমন দাশ আপন নামের এক যুবক ফেসবুকে মুমিনুল হকের ঐ বক্তব্য “সাম্প্রদায়িক ও আপত্তিকর এই জাতীয় কথা তাঁর ফেসবুক ওয়ালে একটি পোষ্ট দেন। সঙ্গে সঙ্গে পোষ্টটি ভাইরাল হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ ঘটনা জানা মাত্রই কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা জানিয়ে পোষ্ট দেন।
পরদিন, ১৮ মার্চ সকালে ৭১ টেলিভিশন ও অপর কোন কোন চ্যানেলে খবরটি সচিত্র প্রচার করা হয়। বেশীর ভাগ জাতীয় দৈনিকে সবিস্তারে ঐ ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

এই ঘটনাকে নিয়ে আজকের এই নিবন্ধ। এ জাতীয় বহু ঘটনা দশকজুড়ে ঘটে আসছে সবগুলি নিয়েই লিখেছি। কিন্তু এ ঘটনাটি এমনই, হৃদয়ে আঘাত করেছে এতটাই যে লিখতে বসলেও কলম আর চলতে চাইছে না। কতই বা লেখা যায় একই জাতীয় ঘটনা নিয়ে? কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত পত্রিকাগুলির বর্ণনা পড়ে বাধ্য হয়েই না লিখে পারছি না।

একটি জাতীয় দৈনিক ১৮ মার্চের সংখ্যায় “ নোয়াগাঁওকে আর এক রামু বানাল হেফাজত” শীর্ষক দুই কলাম শিরোনামে ঘটনার বর্ণনাদিতে গিয়ে লিখেছেঃ
“গ্রামের সবাই যখন দৌড়ে পালাচ্ছিলেন, তখন চিৎকার করে তাদের বাড়ী ছেড়ে না যাওয়ার অনুরোধ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সত্তরোঞ্জ জগৎ চন্দ্র দাশ। সবাই তাঁকে ফেলেই দৌড়াতে থাকেন। ছেলে লিটন দাশ পালানোর মনস্থির করলেও বাবার এই অবস্থা দেখে তিনিও বাড়ীতে থেকে যান। এর কিছুক্ষণ পরেই তাদের বাড়ীতে হামলা হয়। চলে ভাঙচুর, লুঠপাট। গত বুধবার ১৭ মার্চ সকাল ৮টা থেকে টানা এক ঘন্টাব্যাপী সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে এভাবে হামলা করে শতাধিক বাড়ীঘর এবং পাঁচটা মন্দির ভাঙচুর করে হেফাজত সমর্থকেরা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মামুনুল হককে ‘কটাক্ষ’ করে স্থানীয় যুবক ঝুমন দাশ আপনের একটি পোষ্টকে কেন্দ্র করে এই তান্ডব চলে।

কক্সবাজারের রামু হয়ে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরগনগর, পাবনার বনগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুরের পীর গাছার ঘটনা দশকব্যাপী ঘটার পর সর্বশেষ সুনামগঞ্জের নোয়াগাঁও গ্রামে তান্ডব সবটাই একই সূত্রে গাঁথা। এই অভিযোগ ফেসবুকে ধর্ম অবমাননা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার ১৬ মার্চ দিরাই এ হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আসেন মামুনুল হক সহ সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা। মামুনুল হক ঐ সমাবেশে নানা উসকানীমূলক কথাবার্তা বলে যান। এরই প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে পরদিন শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাস আপন তাঁর ফেসবুক ওয়ালে একটি পোষ্ট দেন। সেখানে তিনি মামুনুল হকের সমালোচনা করেন। এই পোষ্ট দেওয়াকে “ধর্মীয় উসকানি” আখ্যা দিয়ে হেফাজত নেতার অনুসারীরা উত্তেজনাকর শ্লোগান দিয়ে রাতের বেলায় বিক্ষোভ মিছিল করেন।

পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় গ্রামবাসীরাই ঝুমনকে ধরে পুলিশে হস্তান্তর করেন। ঝুমন পুলিশ হেফাজতেই আছেন।
গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন মঙ্গলবার বিকেল থেকেই তাঁরা শুনছিলেন তাঁদের গ্রামের হামলা হতে পারে। কাশিপুর, চন্ডীপুর ও নাচনী গ্রামে মাইকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিসোদ্গার হচ্ছি।। এতে ঘরে ঘরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

ঐ দিন রাত্রি আটটার দিকে হাবিবপুর নোয়াগাঁওয়ের গন্যমান্য ব্যক্তিরা বৈঠকে বসেন। স্থানীয় প্রশাসন, জন প্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস দেওয়া ঝুমন দাসকে গ্রামের লোকজনদেরকেই আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। এর পর ঝুমনকে ধরার জন্য প্রত্যেকটি সম্বাব্য স্থানে মোটরসাইকেলে লোক পাঠানো হয়। রাতে উপজেলার স্বাখাই বাজার থেকে ঝুমনকে গ্রামের লোকজনই আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। এরপর গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তিরা জড়ো হয়ে পুলিশ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ফোন করেন। তাঁরা সবাই আস্বাস দেন, এখন আর কিছু হবে না সবাই যার যার বাড়ীতে অবস্থান করেন।

কিন্তু পরদিন সকাল সাতটা থেকে দিরাই এর নাচনী, চন্ডীপুর ও শাল্লা উপজেলার কাশিপুর গ্রামের মসজিদের মাইকে সবাইকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই সকাল আটটার দিকে কয়েক শত মানুষ দেশী অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে একযোগে হামলা করে। তার আগে মানুষ জমায়েত ওয়ার ব্যাপারে প্রচারিত সংবাদ নোয়াগাঁও গ্রামে পৌঁছালে গ্রাম থেকে থানায় ফোন করে জানান হয়। হামলাকারীরা হিন্দুদের বাড়ী খুঁজে খুঁজে হামলা, ভাঙচুর ও লুঠপাট চালায়। ভাঙচুর করা হয় গ্রামের চন্ডী মন্দির, দুর্গামন্তির, কালী মন্দির, শিব মন্দির ও বিষ্ণ মন্তির। এর আগেই এসব মন্দিরের পুরোহিতরাও প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়ে হাওরের দিকে চলে যান। প্রায় এক ঘন্টা সম্পূর্ণ বিনা ধারা চলে তান্ডব। পরে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

মুক্তিযোদ্ধা জগৎ চন্দ্র দাশের ছেলে লিটন দাস বলেন, “আমাদের বাড়ীতে নাচনি গ্রামের ইউপি সদস্য স্বাধীন মিয়া ও পক্কন মিয়া বলছিল “এটি জগদীশের বাবার বাড়ী। ভেঙে গুঁড়িয়ে দাও” লিটন বলেন, এ কথা আমি উপর থেকে শুনছিলাম। তবে দরজা ভাঙতে না পেরে আমাদের মাঝের হাটির অন্য বাড়ীতে চলে যায়। পরে আবারও ফিরে এসে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ভাংচুর চালায়। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রবীন হওয়ার সত্বেও তাঁকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া শুরু করে। বাবা পরে তার শো কেসের ড্রয়ার থেকে দশ হাজার টাকা এনে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলে তারা টাকা নিয়ে চলে যায়।

গ্রামের অসীম চক্রবর্তী বলেন, তাঁর বাড়ীর বিষ্ণু মন্দির ভাঙচুর করে শত বছরের পুরানো কষ্টি পাথরের বিষ্ণুমূর্তি নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। স্থানীয় হবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ দাস জানিয়েছেন, হামলাকারীরা তাঁর নিজের ঘরসহ ৯০ টি বাড়ি ভাঙচুর ও লুঠপাট করেছেন।

শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অলিউল হকের বাড়ী কাশিপুর গ্রামে। তাঁর গ্রাম থেকে ভাঙচুর করতে এসেছ অনেকে। এ বিষয়ে অলিউল হক বলেন, “আমরা ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। কেউ শুনেছে আমাদের কথা-কেউ কেউ শুনেও নি। তবে তার দাবী দুতিনটি ঘর ভাঙচুর হয়েছে। এর বেশী না।

শাল্লা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরী বলেন, ৮৮টি বাড়ী ভাঙচুর ও লুঠপাট হয়েছে। বিত্তশালীদের বাড়ীতে হামলা ও লুঠপাট হয়েছে বেশী।

শাল্লা থানার ওসি নাজমুল হক বলেন, আমরা পৌঁছার আগেই নদী পার হয়ে কিছু মানুষ সেখানে গিয়ে হামলা করে। তবে বেশীর ভাগ মানুষকে আটকাতে পেরেছে পুলিশ।

পুলিশ সুপার মীজানুর রহমান বলেন, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন আছে বলে জানান তিনি।

অপর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বিবরণে জানা যায়, নাচান গ্রামের স্বাধীন মেম্বর ও ফক্কনের নেতৃত্বে কয়েশ’ মানুষ গ্রামের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ীতেই হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধরা হলেন অনিল চন্দ্র দাস, কাজলী চন্দ্র দাস, সুনুরঞ্জন দাস, অনিল কান্তি দাসও আরও তিনজন। মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্রের পাকা ঘরের দরজা জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে সব কিছু তছনছ করে।

এরপর একে একে গ্রামের ৮৮টি ঘরে হামলা ও লুঠপাট চালায় তারা। প্রতিটি ঘর থেকেই টাকা পয়সা, সোনাদানাসহ মূল্যবান জিনিস লুঠ করে হামলাকারীরা।

গ্রামবাসীরা জানান, হামলায় অংশ নেয় নাচনি গ্রামের স্বাধীন মিয়া ইয়ারত আলী, ইনাত আলী, মীর্জা হোসেন ও নেহার আলী, আলম উদ্দিন, আনোয়ার হোসে, আলাকাছ, হুমায়ুস, লুৎফর মো: ফারুক, আকরামত, কেরামত, কাশিপুর গ্রামের নবাব মিয়া, সাইফুল আবদুল মজিদ, তৌহিদ সহ শত শত লোক।

পরদিন দুপুর একটার দিকে জেলা প্রশাসক মো: জাহাঙ্গীর হোসেন ও পুলিশ সুপার মীজানুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

এই নিবন্ধ লেখা পর্য্যন্ত (বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা) আতংকগ্রস্ত হিন্দুরা কেউ থানায় মামলা দায়ের করেন নি। কাউকে এ পর্য্যন্ত গ্রেফতারও করা হয় নি।

এমন ঘটনা আমাদেরকে, দেশবাসীকে বছর বছরই প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। নোয়াগাঁও বর্বরতা নিরেয় এই লেখাটিই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা নিরেয় শেষ লেকা হোক-এমন কামনা করি। তবে এই ঘটনা কতিপয় গুরুতর প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। তা হলো:
এক. মামুনুল হক যখন উত্তেজনাকর বক্তব্য দিলেন তখনই বা এযাবত তাকে গ্রেফতার করা হলো না কেন?

দুই. যারা আগের রাতে হিন্দুদেরকে হামলা করার ম্লোগান দিয়ে মিছিল করলো তৎক্ষনাৎ বা তারপরে আজতক গ্রেফতার করা হলো না কেন?

তিন. হিন্দুরা যখন থানাকে জানালো তৎক্ষণাৎ পুলিশ এসে আতংকিত হিন্দুদেরকে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন না কেন?

চার. ঘটনা ঘটলো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে? আওয়ামী লীগ কেন প্রতিরোধ করলো না?

পাঁচ. স্পষ্টত থানার পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁদের কর্তব্য পালনে গুরুত্বর অবহেলা প্রদর্শন করে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটার সুযোগ করে দিয়েছেন অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধেই বা ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হবে না।

ছয়. একটি ফেসবুক পোষ্ট দিয়ে মামুনুল হকের উস্কানীমূলক বক্তব্যর সমালোচনা করা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তবে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওযা, তাদের বাড়ীঘর ভাঙচুর ও লুঠপাট করা, মন্দির ও বিগ্রহ ভাঙ্গা কেন “ধর্ম বিশ্বাসে আগাত বা ধর্মের অমর্য্যাতদা করা হয়েছে বলে বিবেচনা করে উপযুক্ত আইনে মোকর্দমা দায়ের হচ্ছে না।

সাত. কষিতিগ্রস্তরা আতংকিত মামলা করতে এসেছেন না। এমতাবস্থায় পুলিশ স্বত:প্রনোদিত হয়ে কেন বামলা দায়ের করছেন না?

আট. সাংবাদিকেরা যারা তা-বলীলা চালিয়েছেন তাদের অনেকের নাম পত্রিকায় প্রকাশিত করা সত্বেও তাদেরকে গ্রেফতার করা হলো না কেন?

নয়. হেফাজতে ইসলাম কি আইনের ঊর্ধে?


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!