শেয়ারবাজারে ২৭০০০ কোটি টাকা উধাও ১৫ দিনেই
অনলাইন ডেক্স । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
আবারও সূচকের লাগামহীন পতন। আর তাতে এক দিনেই ৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকার লোকসান গুনতে হয়েছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের। এতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা। কারণ ঋণের অর্থ আদায়ে অনেকের পত্রকোষ বা পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার জোর করে বিক্রির (ফোর্সড সেল) আওতায় পড়েছে।
আগের দিনের বড় দরপতনের ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবারও সূচকের বড় পতন ঘটে। তাতে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫ হাজার পয়েন্টের মনস্তাত্ত্বিক সীমার নিচে নেমে গেছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে।
ঢাকার বাজারের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স গতকাল সোমবার দিন শেষে ৬৭ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯৬৬ পয়েন্টে। ২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বরের পর এটিই সর্বনিম্ন অবস্থান। ওই দিন ডিএসইএক্স সূচকটি ৪ হাজার ৯৫৭ পয়েন্টের অবস্থানে ছিল। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচকটি এদিন ২০০ পয়েন্ট বা সোয়া ১ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ১৫ হাজার ২১৫ পয়েন্টে।
গত ৩০ জুন চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পাস হওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত মাত্র ১৫ কার্যদিবসে বিনিয়োগকারীদের লোকসান হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। শেয়ারের মূল্যমান কমে যাওয়ায় প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা থেকে ডিএসইর বাজার মূলধন নেমে এসেছে ৩ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকায়। এর মধ্যে গতকাল এক দিনেই ডিএসইতে লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর শেয়ারের মূল্যমান ৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা কমে বাজার মূলধন নেমে এসেছে ৩ লাখ ৭২ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকায়। লেনদেনযোগ্য শেয়ারসংখ্যার সঙ্গে লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর শেয়ারের বাজারমূল্যের গুণফলই বাজার মূলধন। বাজার মূলধনের পাশাপাশি একই সময়ে ডিএসইএক্স সূচকটি প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ বা ৪৫৬ পয়েন্ট কমে গেছে। তার মধ্যে গত দুদিনেই কমেছে ১৬৫ পয়েন্ট।
গত দুদিনে শেয়ারবাজারের সূচক যেভাবে কমেছে সেটিকে ‘ফ্রি ফল বা লাগামহীন পতন’ বলে অভিহিত করেছেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীরা যখন আস্থা হারিয়ে ফেলেন, তখন এ ধরনের পতন ঘটে। গতকাল লেনদেনের প্রথম ঘণ্টার মধ্যে ডিএসইর প্রধান সূচকটি ১০০ পয়েন্টের বেশি কমে যায়। তাতে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে অনেক কোম্পানির শেয়ার। এ সময় পতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকে ফোন করে শেয়ার কেনার অনুরোধ জানানো হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ অনুরোধে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সাড়া দেয়। তাতে সূচক কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়। তবে শেষ পর্যন্ত পতন থামেনি।
জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে যখন বড় ধরনের পতন ঘটে, তখন আতঙ্কিত সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হাতে থাকা শেয়ার কার আগে কে বিক্রি করবেন, সেই চেষ্টা করেন। তাই গতকাল লেনদেনের শুরুর প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে সূচক ১০০ পয়েন্টের বেশি কমে যায়। যদিও পরে সেই পতনের মাত্রা কিছুটা কমানো গেছে।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, বাজারের এ পতনের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। বাজেটে সরকার তালিকাভুক্তি কোম্পানিগুলোর বোনাস লভ্যাংশ নিরুৎসাহিত করতে বাড়তি করারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার না থাকলে বোনাস লভ্যাংশ নিষিদ্ধ করেছে বিএসইসি। অন্যদিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে কিছু পদক্ষেপ দীর্ঘ মেয়াদে বাজারের জন্য ভালো। কিন্তু ভুল সময়ে এসব পদক্ষেপ নেওয়ায় বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
গত ২১ মে বিএসইসি কোম্পানির উদ্যোক্তাদের পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ারধারণ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করে। তাতে বলা হয়, যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার নেই, সেসব কোম্পানি বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে না। গত ৩০ জুন হিসাব বছর শেষ হয়েছে এমন ৩৬টি কোম্পানি আছে, যারা বিএসইসির এ নির্দেশনার কারণে এবার বোনাস ঘোষণা করতে পারবে না।
শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক সময়ের ‘অস্বাভাবিক’ দরপতনের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। প্রথম দিনেই গতকাল তাঁরা কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস থেকে যেসব শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে, তা যথাযথ নিয়মকানুন মেনে করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সাধারণত শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের লিখিত বা মুঠোফোনে এসএমএসের মাধ্যমে বিক্রির আদেশ দিতে হয়। সেই আদেশের কপি সংরক্ষণ করতে হয় সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউসকে। বর্তমান বাজারে সেই নিয়ম মেনে বিনিয়োগকারীর শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে কি না, তা তদারকির নির্দেশ দেওয়া হয় স্টক এক্সচেঞ্জ দুটিকে।
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষস্থানীয় ১০টি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ ৫০ জন করে গ্রাহকের ছয় মাসের লেনদেনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে ওই সব গ্রাহকের লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য তদন্ত কমিটিকে দিতে বলা হয়। এসব ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তাদের লেনদেনের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মেনে চলারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য স্বল্প সুদের প্রায় সাড়ে ৮০০ কোটি টাকার যে পুনঃবিনিয়োগ তহবিল গঠন করা হয়েছে, তার ৮৫ কোটি টাকা ছাড় করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে বিএসইসি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, এ টাকা পাওয়ার পর পুনঃবিনিয়োগের জন্য তা ২৭টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হবে। উৎস-প্রথম আলো।