সরকারি শিক্ষকদের আয়োজনে বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষা; নেপথ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বাণিজ্য।
সাজ্জাদ খোসনবীশ, টাঙ্গাইল, বিশেষ প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
টাঙ্গাইলে গোল্ড মেডেল বৃত্তির নামে কতিপয় সরকারি শিক্ষকের দশ লক্ষাধিক টাকা অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। ৪নভেম্বর(শনিবার) সকাল ১০:০০টায় টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ২০২৩খ্রিঃ টাঙ্গাইল জেলা শাখার নামে এই বৃত্তি অনুষ্ঠিত হয়। অথচ, নোট-গাইড আর কোচিং নির্ভর পড়াশোনা বন্ধ করতে এবং প্রতিদিন ক্লাসেই মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে গত ৮ আগস্ট সচিবালের অনুষ্ঠিত শিক্ষা ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ সভায় সরকারি ভাবে এবছর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকারি বৃত্তি বাতিলের এই সুযোগে টাঙ্গাইলের কতিপয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গোল্ড মেডেল প্রদানের নামে অনুমোদনবিহীন এই বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করে। বৃত্তি পরীক্ষা বাবদ এরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জন প্রতি ১৫০/(একশত পঞ্চাশ টাকা) করে ফি আদায় করে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত জেলার প্রায় আট হাজারের অধিক কোমলমতি শিশুদের কাছ থেকে এরা একই হারে ফি আদায় করেছে বলে জানা গিয়েছে। এই হিসেবে গোল্ড মেডেল বৃত্তি আয়োজক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকের উপার্জন হয়েছে প্রায় দশ লক্ষাধিক টাকা। সরকারি চাকুরি করে সরকারি শিক্ষকরা এ ধরনের বৃত্তি আয়োজন ও অর্থ উত্তোলন করতে পারে কিনা জিজ্ঞেস করলে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, টাঙ্গাইল জেলা শাখার মহিলা বিষয়ক সম্পাদক কামরুন্নাহার খান মুন্নি বলেন, ‘সরকারি চাকুরি বিধিমালা ১৭(১) নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের অন্য বিধান অনুসারে, কোনও সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া কোনও ব্যবসায় জড়াতে পারবেন না। অথবা দায়িত্বের বাইরে অন্য কোনও কাজ কিংবা চাকরি নিতে পারবেন না।’ সরকারি অনুমোদন ব্যতিত সরকারি চাকুরীজীবি শিক্ষকদের এ ধরনের অর্থ উত্তোলন ও বৃত্তি প্রদানের নামে ব্যবসাবানিজ্য সম্পূর্ণ বেআইনি।’ বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হাজী মুহাঃ সাজ্জাদুর রহমান খোশনবীশকে এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘বৃত্তি বাতিল সংক্রান্ত বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে টাঙ্গাইল জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কতিপয় বিতর্কিত সরকারি শিক্ষক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এই অবৈধ বৃত্তি পরীক্ষা নিয়েছে। এই কাজে তারা সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, টাঙ্গাইল জেলা শাখা’র নাম ব্যবহার করে ‘বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, টাঙ্গাইল জেলা শাখা’কে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অথচ, প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ কোন কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, টাঙ্গাইল জেলা শাখা সমর্থন করে না। তাছাড়া, পুরোপুরি বানিজ্যিক ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়ার আশায় যে কোন ধরনের কার্যক্রম বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিরোধপূর্ণ। সরকারি চাকুরীজীবি হিসেবে সরকারের একজন বেতনভুক্ত শিক্ষক হয়ে এবং শিক্ষক সমিতির নাম ভাঙিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সরকারি আয়োজনের বাইরে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে এরা মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করেছে। কারণ, বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যখন সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তাদের নিজেদের আয়োজনে বেসরকারি বৃত্তি পরিক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য তার নিজ বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানান তখন ঐ বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে শিশুদের উপর একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হয়। এবং অনেক শিশুর অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা ঐ পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধ্য হয়।
পরীক্ষা ফি বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন ও উপার্জনের ধান্ধাকারী ঐসকল অর্থ লিপ্সু শিক্ষক একইসঙ্গে সরকার ও বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। এই একই চক্র টাঙ্গাইল সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি মার্কেট ভবন অবৈধভাবে লীজ প্রদানে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত। বিতর্কিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে জেলার শিক্ষকগণ দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন ও বিক্ষোভ জানিয়ে আসছে। আমরা এই অবৈধ বৃত্তি বন্ধ ও অর্থ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সরকারি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও মাননীয় টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছি। আশা করছি কর্তৃপক্ষ দৃষ্টান্তমূলক ব্যাবস্থ গ্রহণ করবেন।’ এ বিষয়ে কয়েকজন অভিভাবকের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘১৫০/(একশত পঞ্চাশ টাকা) ফি দিয়ে আবেদন ফর্ম তুলেছি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা টাকা উত্তোলন করতে পারেন কিনা জানি না।’
জানা যায়, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি গোল্ড মেডেল বৃত্তি ২০২৩ খ্রি. এর আয়োজক বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, টাঙ্গাইল জেলা শাখার একাংশের সভাপতি দাবি করা ঘাটাইলের চানতারা দক্ষিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এমরান হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক দাবি করা টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আনেহলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হারুনার রশিদ। এই পরীক্ষার সমন্বয়কারী কালিহাতীর হাসরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সদর উপজেলার আনেহলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হারুনার রশিদ ও সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বাসাইলের বার্থা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মো. মনির হোসেন খান।
এ বিষয়ে হারুনার রশিদ বলেন, আমরা সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাই নাই। শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই ও মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এই আয়োজন করা হয়েছে। দেড় ঘন্টায় শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই ও মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তের হারুনার রশিদ বলেন, আমরা তাদের একটু যাচাই করবো।’