সাত জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড: হলি আর্টিজান মামলা
অনলাইন ডেক্স । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
দেশের সবচেয়ে আলোচিত জঙ্গিবিষয়ক মামলা হলি আর্টিজানে হামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা এ মামলায় সাত জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মামলায় খালাস দেওয়া হয়েছে আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে।
আজ বুধবার (২৭ নভেম্বর) বেলা সোয়া ১২টার দিকে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এ রায় দেন। এর আগে বেলা ১২টার দিকে রায় পড়া শুরু হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ। খালাস পেয়েছেন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান।
পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে আদালতে অভিযোগ করা হয়েছে। এখন প্রত্যাশা অনুযায়ী রায় হওয়ায় জঙ্গি কর্মকাণ্ডে কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযানের পর এখন জনসচেতনতা তৈরি এবং পুনর্বাসন কার্যক্রমের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে মনোযোগ দেন তাঁরা।
হলি আর্টিজানে যারা হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন, তাদের পাঁচজন মারা যান। যারা এই হামলার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন, সেই তামিম চৌধুরী, মেজর (বরখাস্ত) জাহিদ, মারজানসহ অনেকেই বিভিন্ন অভিযানে মারা গেছেন। তার পরও যারা গ্রেপ্তার হন, তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং ঘটনাস্থলের কিছু আলামত বিশ্লেষণ করে সামগ্রিকভাবে একটি নিখুঁত ও বস্তুনিষ্ঠ অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে বিজ্ঞ আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করা হয়েছে বলে মনে করছেন পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তাই আগেই আশা করা হয়, যার যে দায় ছিল সে অনুযায়ী প্রত্যাশিত রায় হবে।
হলি আর্টিজান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম আহমেদ চৌধুরী, সারোয়ার জাহান মানিক, প্রশিক্ষণদাতা জাহিদুল, বাস্তবায়নকারীরা পাঁচ জনসহ ১৩ জন নিহত হলেও জীবিত গ্রেপ্তার আট জঙ্গির জবানবন্দিতে হামলার আদ্যপান্ত বেরিয়ে আসে। তবে আসামি বড় মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে কৃতকর্মের বিচারের রায় পেলেন নব্য জেএমবির সাত জঙ্গি।
তদন্তকারীরা জানান, এই আট জঙ্গির অতীত কর্মকাণ্ড এবং সাংগঠনিক অবস্থানের কারণে ধারণা পাওয়া যায়, গ্রেপ্তার না হলে নব্য জেএমবির পরবর্তী নেতা হিসেবে তাঁরা আরো নাশকতা চালাতেন। মনিরুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তার জঙ্গিরাও হামলায় বড় ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের জবানবন্দিতে পুরো ঘটনার বিবরণ এসেছে। এদের কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গি।
হলি আর্টিজানে হামলা বৈশ্বিক মানচিত্রে বাংলাদেশকে স্থান করে দিয়েছিল পুরোপুরি আকস্মিকভাবে। ওই হামলার পরপরই পশ্চিমা দূতাবাসগুলো এ দেশে ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছিল। সন্ত্রাসের ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারের জোরালো উদ্যোগে পরিস্থিতি বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশিদের সেই সতর্কতার মাত্রাও বদলে গেছে। বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশই তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে কড়াকড়ি শিথিল করতে শুরু করেছে।
ওই হামলায় নিহত বিদেশিদের পরিবারের প্রতি বাংলাদেশ সমবেদনা জানিয়েছে। হলি আর্টিজানে হামলায় নিহত জাপানিদের নামে ঢাকায় মেট্রো রেল স্টেশনগুলোর নামকরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। নিহত ইতালীয়দের স্মরণে ঢাকায় ইতালীয় দূতাবাসে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
১১৩ জনের সাক্ষ্য-
ওই জঙ্গি হামলার ঘটনায় করা মামলায় ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। গত বছরের ২৬ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ওই জঙ্গি হামলা মামলার বিচার শুরু হয়।
গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় আটজনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল গত বছরের ২৩ জুলাই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে যে সাত আসামিকে-
গাইবান্ধার জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, নওগাঁর আসলাম হোসেন ওরফে আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র্যাশ, কুষ্টিয়ার আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, জয়পুরহাটের হাদীসুর রহমান ওরফে সাগর, বগুড়ার রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, বগুড়ার মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও রাজশাহীর শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ। অভিযুক্ত সবাই নব্য জেএমবির সক্রিয় সদস্য বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
রায়ে খালাস দেওয়া হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে।
জাপানি দূতাবাসের প্রতিনিধি এ মামলার রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষক হিসেবে আদালতে উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন আইনজীবী প্রকাশ রঞ্জন বিশ্বাস। যিনি নিহত এক জাপানি ও এক ভারতীয় নাগরিকের জব্দ তালিকায় থাকা ব্যক্তিগত মালামাল (ওয়ালেট, মোবাইল ফোন, হাতের বালা) হেফাজতে নেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, আটজনকে অভিযুক্ত করা হলেও হলি আর্টিজানের ঘটনার সঙ্গে ২১ জঙ্গির জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন ঢাকার রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। এ ছাড়া জেএমবির প্রধান সমন্বয়কারী তামিম চৌধুরী, সারোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান, সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলাম, রায়হানুল কবির রায়হান ওরফে তানভীর ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজানও হলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে তদন্তে উঠে আসে। এই আটজন বিভিন্ন সময় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হন বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টায় হলি আর্টিজান বেকারিতে অতর্কিতে আক্রমণ করেছিলেন পাঁচ জঙ্গি। তাঁরা ভেতরে থাকা সবাইকে জিম্মি করে ফেলেন। একে একে গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে ১৭ বিদেশি ও তিন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছিলেন। সেখানে তাত্ক্ষণিক অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। আহত হন র্যাব-১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মাসুদ, পুলিশের গুলশান অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবদুল আহাদসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য।