সামনে সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন

সামনে সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন
লেখক:-রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত)

পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে কি না জানি না তবে বাংলাদেশ সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী সাংসদদের ভোটে ৫০ জন নারী নির্বাচিত হন সাংসদ হিসেবে। আসন ৫০ টি সংরক্ষিত। দফায় দফায় নারী আসন সংরক্ষিত রাখার মেয়াদ এবং সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ মেয়াদ, যদি সংসদ পুনরায় তা বৃদ্ধি না করে, তবে হয় তো শীঘ্রই তা শেষ হয়ে যাবে অর্থাৎ এই দফায় পরে আর সংরক্ষিত আসন থাকবে না মহিলাদের জন্য। তবে শেষতক জানলাম আরও ২০ বছর এই পদ্ধতি চালু থাকবে।
সত্য বটে বাংলাদেশে এক ধরণের নারী জাগরণ ঘটেছে বর্তমান নেতৃত্বের তিনটি মেয়াদ কালে। আজ মহিলারা শুধুমাত্র শিক্ষক নন, জজ, ম্যাজিষ্ট্রেট, ডিসি, এস.পি. সহ সেনাবাহিনীর নানাপদে অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁদের যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন।

সে হিসেবে মোট জনগোষ্ঠী যেখানে কমপক্ষে ১৬ কোটি সেখানে নারীর সংখ্যা অবশ্যই আট কোটি কিছু কম বেশী হতে পারে। অথচ এই মহিলারাই হয়ে আছেন নিস্পৃহীত, অত্যাচারিত, অবহেলিত এবং মাত্র সেদিনও তাঁরা ছিলেন শিক্ষা দীয়ক্ষায় অতিশয় পশ্চাৎপদ যেন গৃহকোণে বন্দী। তাই এই ধরণের যন্ত্রণা-বঞ্চনার বিরুদ্ধে নারী সমাজ তোলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তাঁরা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার দাবী করে তা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। বরেণ্য মহিলা বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে “বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ” একটি নির্দলীয় মহিলা সংগঠন হিসেবে। বেগম রোকেয়ার মহতী আদর্শে বলীয়ান হয়ে বেগম সুফিয়া কামাল যেমন মহিলা পরিষদ গড়ে তোলেন তেমনই আবার একই লক্ষ্য নিয়ে আরও অনেক নারী সংগঠন গড়ে ওঠে প্রায় সমান লক্ষ্য কার্য্যকর করার উদ্দেশ্যে।

সংরক্ষিত নারী আসন ঐ আন্দোলনের ফসল। তবে নারী আন্দোলনকে বাংলাদেশে যেতে হবে আরও বহুদূর কারণ এখনও পর্য্যন্ত নারী সমাজের বহুমুখী দাবী দাওয়ার আংশিক স্বীকৃতি মিলেছে সত্বি বেশীর ভাগ দাবীর স্বীকৃতি আজও অনর্জিত।
আটা কোটি নারীর জন্য মাত্র ৫০ টি সংরক্ষিত আসন এবং তাতে অপ্রত্যক্ষ নির্বাচন বা ঝবষবপঃরড়হ এর প্রচলিত ব্যবস্থা সাময়িক হতে পারে। তাই তাঁরা বহুদিন আগে থেকেই সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ১৫০ না করলেও আপাতত: ১০০ তে উন্নীত করে সরাসরি নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলনের দাবী তুলেছেন বেশ কয়েক বছর যাবত। কিন্তু মনের সবলতা ও নারীর ছুটোছুটির সক্ষমতার সীমা বিবেচনা করে ক্ষমতাসীনরা ‘সরাসরি নির্বাচনের সময় এখনও আসে নি” বলে মনে করে সংসদে ঐ সংখ্যা বৃদ্ধির ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের প্রস্তাব আলোচনাতেও আসছে না।

আবার আর একটি মত হলো নারীর জন্য আসন সংরক্ষণ অযৌক্তিক। কারণ জনপ্রিয়তা থাকলে মহিলারা দিব্যি সাধারণ আসন থেকেই নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন। যেমন শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া, বেগম মতিয়া চৌধুরী সহ আরও অনেকে। এ বিষয়টি সত্য হলেও কাজটি সহজ নয়। অত্যন্ত ভাল মানুষ হলেই তিনি যে জনপ্রিয় হবেনই তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

আসলে এমন তর্ক-বিতর্ক বাস্তবে কোন কাজে আসে না। সমাজে পশ্চাৎপদতা এখনও বিদ্যমান, নারীর অবস্থান এখনও মর্য্যাদাপূর্ণ নয় এবং নারীর প্রাপ্য ন্যায্য অধিকার সমূহ এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তাই নারী আন্দোলনের প্রয়েঅজনীয়তা এতটুকুও কমে নি বরং বেড়েছে।

বাংলাদেশের সমাজে নারী সমাজকে নিয়ে দুটি পরস্পর বিরোধী ধারা ক্রিয়াশীল। আধুনিতা ও পশ্চাৎপদতা। তাই পরস্পরের সংঘাত অনিবার্য্য। এখনও কেউ কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী শিক্ষার বিরোধিতা করে এবং তার দ্বারা সমাজে প্রতিক্রিয়াশীলতা বজায় রাখাতে অথবা পারলে তা বৃদ্ধি করতে চায়। নারী শিক্ষার অনুকূলে বহু পুরাতন প্রবাদ আজও সত্য “একটি শিক্ষিত পরিবার গড়তে একজন শিক্ষিত মায়ের বিকল্প নেই” বাংলাদেশে যেহেতু অধিকতর সংখ্যায় শিক্ষিত পরিবার গড়ে ওঠা প্রয়োজন তাই নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ অপরিহার্য্য । মেয়েরা ডাক্তার হোক, ইঞ্জিনিয়ার হোক, বৈজ্ঞানিক হোক ভাল শিক্ষক হোক, ভাল খেলোয়ারড় হোক এগুলি হলো সময়ের দাবী নালী সমাজেরও সর্বজনীন দাবী। এই দাবীর বিরোধী মহল যে প্রকৃতই সমাজে পিছিয়ে দিতে চায় তা বলাই বাহুল্য এবং সে কারণে দুই পক্ষে অঘোষিত লড়াই বিদ্যমান।

পিতার, স্বামীর সম্পত্তির সমান অংশ উত্তরাধিকারের দাবীটি আজও অপূর্ণ। একই মা-বাবার সন্তান হয়ে (হিন্দু হলে) মেয়েরা কিছুই পাবে না কিন্তু ছেলেরা সমান অংশ তা পাবে। বিধবা স্ত্রী পাবেন ঐ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব (বিক্রয় বা হস্তান্তরের নয়) যতদিন ছেলেরা সাবলক না হবে।

মুসলিম মেয়েরা এ ব্যাপারে হিন্দুদের চেয়ে এগিয়ে আছেন কিছুট কিন্তু সমান উত্তরাধিকার আজও অধরাই রয়ে গেছে। দুই মেয়ের সমান এক ছেলে এমনই বিধান প্রচলিত রয়েছে। ফলে এই উত্তরাধিকারের প্রশ্নেরও লড়াই অপরিহার্য্য।
এ লড়াই কারা পরিচালনা করবেন? মহিলা পরিষদ সহ অপরাপর নারী সংগঠন তো আন্দোলনে আছেনই সে আন্দোলন জাতীয় সংসদ পর্য্যন্ত বিস্তৃত হওয়া প্রয়েঅজন এবং এর মধ্যেই নিহিত নারী আসন সংরক্ষিত রাখা, সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে ১০০ তে উন্নীত করা এবং সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার নিশ্চয়তা। এজন্যে আরও প্রয়েঅজন (এবারের জন্য) ৫০ জন সংগ্রামী নারীর মনোনয়ন। তাদেরকে পাওয়া যাবে মহিলা পরিষদ সহ নানা নারী সংগঠনে, পুষ্পিতা গুপ্তা, খুশী কবির, তামান্নার মত মানবাধিকার কর্মীর মধ্যে এবং বিভিন্ন দলের সংগ্রামী, গণতান্ত্রিক, মানবিক এবং অসাম্প্রদায়িক মহিলাদের মধ্যে। সংকীর্ণতা যেন এই মহৎ কাজের উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে না দেয়।

বাংলাদেশে প্রয়োজন সহস্র বেগম রোকেয়ার, অসংখ্য বেগম সুফিয়া কামাল, হাল আমলে পুস্পিতা গুপ্তা এবং আরও অনেক। সংসদ নিশ্চয়ই যোঘ্য ও সংগ্রামী মহিলাদেরকে স্থান করে দেবে। যেন তাঁরা নির্বাচতি/মনোনীত হয়ে সংসদে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে পারেন এবং সম্মিলিত কণ্ঠে সোচ্চার হয়ে সংসদ অধিবেশনগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারেন। এ ব্যাপারে কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণকারী কোন আইন থাকলে তা বাতিল করে সংসদদের দায়িত্বশীলতার প্রতি অবস্থা জ্ঞাপন করা হোক। নির্ভীক মানবাধিকার কর্মী পুষ্পিতা গুপ্তা এবং আর যারা মনোনয়ন চেয়েছেন তাঁরা মনোনীত হবেন এমন বিশ্বাস মনে পোষণ করি।


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!