সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পর সরকারী দলের কোন হিন্দু নেতার কথা সংখ্যালঘুরা শুনেনি

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পর সরকারী দলের কোন হিন্দু নেতার কথা সংখ্যালঘুরা শুনেনি
শিতাংশু গুহ
নিউইয়র্ক।

সুপ্রিমকোর্টের এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ঐক্যফ্রন্ট থেকে ধানের শীষ প্রতীক এবার নির্বাচনে লড়ছেন। এটি অভাবনীয় ঘটনা। বাম ঘরানার এই নেতা হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং গণফোরামের নির্বাহী প্রেসিডেন্ট। ঐক্য পরিষদ নেতা ধানের শীষ নিয়ে লড়ছেন, এটি কি চিন্তা করা যায়? শুধু তিনি নন, এবার অনেক সংখ্যালঘু নেতা ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপি’র হয়ে লড়ছেন। এর কারণ কি? বিএনপি কি ভালো হয়ে গেছে বা আওয়ামী লীগ খারাপ হয়ে গেছে? নাকি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে সংখ্যালঘুরা এখন আর গুণগত কোন পার্থক্য দেখতে পাচ্ছেন না?

বোঝা যায়, হিন্দুরা আর এখন সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে চাচ্ছেন না? হিন্দুভোট ভাগ হচ্ছে। ১৯৪৭ সালের পর এই প্রথম। নৌকার পাল্লা এখনো ভারী, কিন্তু অন্যরা ভাগ বসাচ্ছেন। তাহলে হিন্দুরা আর ‘ভোটব্যাঙ্ক’ থাকছেন না? এর দায় হিন্দুদের নয়, আওয়ামী লীগের। হিন্দুরা এতকাল শুধু দিয়েছে, আওয়ামী লীগ নিয়েছে, দেয়নি কিছু? চট্টগ্রামের মেয়র মহিউদ্দিন আহমদের পরাজয়ের কথা মনে আছে? পশুশালা প্রশ্নে হিন্দুরা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তিনি পরাজিত হন। জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন বিপ্লবী বিনোদ বিহারীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তবে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। শেষ রক্ষা হয়নি!

রংপুর, কুমিল্লা বা এবার সিলেট পৌরসভায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, হিন্দুরা অনেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট দেয়নি? কেন দেবে? আওয়ামী লীগ একটানা দশ বছর ক্ষমতায় ছিলো। নি:সন্দেহে দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। উন্নতির ছোঁয়া সংখ্যালঘুর গাঁয়ে লাগেনি? হিন্দুরা এখনো দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে! তারা খোলাখুলিই বলছেন, স্বাধীনতার সুফল সংখ্যালঘুর ঘরে পৌঁছেনি। কথাটা সত্য। আওয়ামী লীগ শাসনামলে গত এক দশকে হিন্দুরা কি পেয়েছে এ প্রশ্ন স্বাভাবিক? সংখ্যালঘুরা মুখ্যত: নিরাপত্তা চায়। তা পায়নি।

মহাজোটের এক দশকে হিন্দু নির্যাতন বিএনপি-জামাত আমল থেকে কম নয়? এটি হিন্দুদের কথা। নির্যাতন তো আছেই, এর চেয়ে বড় অভিযোগ, নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের ‘অনীহা’ বা মৌননীতি বা বিচারহীনতা। এমনকি বিশ্বজিৎ হত্যার বিচারটি নিন্ম আদালতে ঠিক থাকলেও উচ্চ আদালতের রায়ে নিহতের হতভাগ্য পিতাও খুশি হতে পারেননি। দেশে একের পর এক ঘটনা ঘটেছে, সরকার বিএনপি-জামাতের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভিকটিম কিন্তু দেখছে তাদের অত্যাচারীরা সরকারি দলের লোকজন, সাথে অন্যরা?

২০১২-তে রামু’র ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী সেখানে যান, ক্ষতিপূরণ দেন। জাপান ও শ্রীলঙ্কার চাপ ছিলো। তারপরও কিন্তু রামুর ঘটনার বিচার হয়নি। এরপর নাসিরনগর, নন্দীরহাট, অভয়নগর, সাঁওতালপল্লি, রংপুর এবং আরো কত ঘটনা? আওয়ামী লীগ নেতারা দায়সারা গোছের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। হিন্দুরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী তাদের দেখতে যাননি, বা আজ পর্যন্ত কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। অথচ এমনকি ২০১৪-তে যা কিছু ভোট পড়েছিলো, তা দিয়েছিলো হিন্দুরা, এবং এজন্যে মারও খেয়েছে? নৌকায় ভোট দিয়ে ২০০১-এ বেদম মার খেলেও মহাজোট বিচার করেনি?

নাসিরনগর ঘটনায় প্রায়ত: মন্ত্রী ছায়েদুল হক হিন্দুদের ‘মালাউন’ বলেন। কথাটি ছড়িয়ে পরে। মন্ত্রী অস্বীকার করেন। তখন দু’একজন মন্ত্রী তারপক্ষে সাফাই গেয়েছেন যা হিন্দুরা ভালো চোখে দেখেনি। শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কানে ধরে ওঠবস করান জাতীয় পার্টির সাংসদ সেলিম ওসমান। পুরো দেশ সেলিম ওসমানের বিপক্ষে দাঁড়ায়, সরকার একশ্যান নেয়নি। বরং দু’জন মন্ত্রীর সাথে সেলিম ওসমানের কোলাকুলির ছবি মিডিয়ায় ছাপা হয়? সেলিম ওসমান অলৌকিক ক্ষমতাবলে ঐ মামলা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছেন। বেচারা শিক্ষক মিথ্যা মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?

আওয়ামী লীগ আমলে ভালো থাকবেন, এটি ছিলো হিন্দুদের প্রত্যাশা। গত এক দশকে তা হয়নি? এতে সেন্টিমেন্ট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গেছে। ইসলাম অবমাননার গুজব রটিয়ে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, দেখা গেছে, সবই গুজব। কিন্তু হিন্দুর বাড়িঘর পুড়েছে, হিন্দুরা সর্বশান্ত হয়েছেন। রাকেশ, টিটুরা বিনা দোষে জেল খেটেছেন বা খাটছেন। অথচ অপরাধীরা সরকারি ছত্রছায়ায় প্রকাশ্যে দিবালোকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যারা বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন, তারা কেউ আর জেলে নেই? অভিযোগ রয়েছে, তারা নৌকার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত।

এটি ঠিক, সরকার কিছু চাকুরী দিয়েছেন। অনেকে উচ্চপদে আসীন। এরা ছিলেন এরশাদ আমলের রিক্রুট। মহাজোট আমলে তেমন কি নিয়োগ হয়েছে? প্রধান বিচারপতির ঘটনার মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সবচেয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন আওয়ামী লীগের হিন্দু নেতা, এমপি ও মন্ত্রীরা। বিভিন্ন সময় অত্যাচারের ঘটনায় তারা সরকারের পক্ষে যে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারতেন, তা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। বস্তুত: তাদের কোন ভূমিকা ছিলোনা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যু’র পর আর কোন সরকার দলীয় হিন্দু নেতার কথা হিন্দুরা শুনেনি।

ঐসব নেতারা এবার বিপদে আছেন। এদের অনেকের সাথে আমার কথা হয়। তাদের বক্তব্য হলো, সরকারি দল করে কিভাবে তারা প্রতিবাদ করবেন? তাদের বলেছি, আপনারা দুর্গতের পাশে দাঁড়াতে পারতেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে পারতেন? বা এমনকি সবাই মিলে প্রধানমন্ত্রী শরণাপন্ন হতে পারতেন? দুর্ভাগ্য, সবাই মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। এতে দলের ক্ষতি হয়েছে। হিন্দুরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ওনারা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। এবার জেতা তাদের পক্ষে কঠিন হবে। দলীয় আনুগত্য থাকা ভালো, কিন্তু নির্যাতিতের পক্ষে দাঁড়ানোটা দায়িত্ব। তারা দায়িত্ব পালন করেননি।

আওয়ামী লীগ শত্রূ সম্পত্তি আইনটি শেষ পর্যন্ত বাতিল করেছে। হিন্দুদের বড় দু:খ স্বাধীনতার পর এই আইনটি থেকে গিয়েছিলো। এমনকি হিন্দুরা রমনা কালীবাড়ি ফেরত পাননি? প্রায় পাঁচ দশকের মাথায়, হিন্দুরা সর্বস্বান্ত হবার পর আইনটি বাতিল হয়েছে, কিন্তু এতে এখনো এক কানাকড়ি সম্পত্তিও ফেরত আসেনি। আসবে গ্যারান্টি নেই! তবে নির্বাচনের বোনাস হিসাবে সরকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দেড় বিঘা সম্পত্তি ফেরত দিয়েছেন। কুড়ি বিঘার মধ্যে আপাতত: সাড়ে চার বিঘা মন্দিরের দখলে, এই-বা কম কি? এজন্যে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।

গত দশ বছরে মোটামুটি এই হলো সংখ্যালঘুর লাভ-ক্ষতির খতিয়ান। এতে লাভের চাইতে ক্ষতির পাল্লা ভারী। হিন্দুরা এবার তাকিয়ে আছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের দিকে। নির্যাতনের প্রসঙ্গ টেনে লাভ নেই, কারণ এ বিষয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথাই চূড়ান্ত, ‘হিন্দু বিদায় করতে সব সরকার সমান’। সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের সাথে হেফাজত ও ওলামা লীগের মাখামাখি খুবই অপছন্দ করছেন।

মৌলবাদের সাথে আপোষ কিন্তু বিজয় নিশ্চিত করেনি? ওরা রাতারাতি পাল্টে যেতে পারে! নিশ্চিত হিন্দু ভোট ছেড়ে অনিশ্চিত মৌলবাদী ভোটের পেছনে ছুটতে ছুটতে মহাজোটকে কোথায় যাবে কে-জানে? বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘নিশ্চিত ছাড়িয়া যে অনিশ্চিতে ধায়, একুল-ওকূল সে দু’কুল হারায়’?


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

One thought on “সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পর সরকারী দলের কোন হিন্দু নেতার কথা সংখ্যালঘুরা শুনেনি

  • November 30, 2019 at 9:35 am
    Permalink

    Rightly said. All the Hindu members in the parliament are like the dog for the government.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!