সেই নীরু এখন কোথাও নেই
অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
ছাত্রদলের যৌবনের বহুল আলোচিত ছাত্রনেতা সানাউল হক নীরু রাজনীতির কোথাও এখন নেই। বিএনপির রাজনীতির প্রতি আনুগত্য থাকলেও সেখানেও তাকে দেখা যাচ্ছে না। ২০০৬ সালের নির্বাচনে বিকল্পধারার হয়ে মহজোটের প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল নরসিংদীর আসন থেকে। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, নামাজ, রোজা, ব্যবসা-বাণিজ্য পারিবারিক জীবনে জীবনে সময় দেন।
তারাবি নামাজ শেষে হোটেল সোনারগাঁওয়ে মাঝেমধ্যে আড্ডা দেন বন্ধুদের সাথে। নীরুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার রাজনীতির পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে চাননি। তবে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চাইলে যে কোনো সময় সামরিক শাসন জমানার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাঁপানো ছাত্রদলের উত্থানের নায়ক সানাউল হক নীরু বিএনপিতে সক্রিয় হয়ে উঠবেন। এমনকি মনোনয়ন পেলে নরসিংদী-৩ আসনে থেকে নির্বাচন করতেও প্রস্তুত।
নেতাকর্মীরা জানান, আধুনিক ছাত্রদলের রূপকার মাহবুবুল হক বাবলু আর সানাউল হক নীরু। দুই আপন সহোদর ভাই। একজন মৃত হয়েও দলের কাছে জীবন্ত। আরেকজন বেঁচে থেকেও দলের কাছে মৃত। ছাত্রদলের সেরা সংগঠক হিসেবে এখনো মাহবুবুল হক বাবলুকে প্রতি বছর স্মরণ করা হয়। আর সানাউল হক নীরু। দলের কোনো পদ-পদবীতে নাই। ২৮ বছর আগে নিজের তৈরি রাজনৈতিক শিষ্যদের হাতেই এখন বিএনপির চালিকাশক্তি। কিন্তু নীরু নেই। যদিও একসময়ে তার এ সকল শিষ্যদের একটি অংশের প্রভাবে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিলো। সেই সাময়িক সময় যেন আর ফুরানোর নয়।
মাঝে মাঝে আলোর ঝলকানী দিয়ে দলে ফেরার আগমনী বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। ওই সময়ে তাকে পাওয়া গেছে পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় কিংবা দলীয় যে কোনো কর্মসূচিতে। নিজের সরব উপস্থিতি না থাকলেও নিজের হাতে তৈরি করা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাই ফেস্টুন আর পোস্টারে তার উপস্থিতির জানান দিয়েছেন। তিনি আবার আসছেন এই বার্তা নিয়েই সরব হয়ে উঠে সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আবার শঙ্কিত হয়েও পড়ে তার বিরুদ্ধবাদীরা। রুদ্ধ হয়ে ওঠে তার দলে ফেরা। এভাবেই চলছে নীরু।
এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তি নেতা, রাজপথের অহঙ্কার নীরু এখন অনেকটা নিভৃতে চলে গেছেন। এখন আর স্লোগানে-স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে না- নীরু তোমার ভয় নাই, আমরা আছি লাখো ভাই। এখন আর রাজপথ প্রকম্পিত করে দুর্বার আন্দোলনের জন্য দলপ্রেমি হযে ওঠে না।
আশির দশকের ছাত্রদল নেতাকর্মীরা জানান, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ভঙ্গুর দলকে আবার পূনর্জাগরন করতে দেশব্যাপী ছাত্রদলকে একটি শক্তিশালী প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে যে সকল নেতাকর্মীদের অবদান রয়েছে তার মধ্যে ছাত্রদলের সর্বকালের সেরা সংগঠক মাহবুবুল হক বাবলু ও তার সহোদর সানাউল হক নীরু অন্যতম।
নেতাকর্মীরা বলেন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নামক বিশাল ছাত্রসংগঠন যাদের হাতে গড়া তারাই ভালো বলতে পারবেন নীরুর বীরত্বগাথা ইতিহাস। ১৯৮০-৮১ সেশনে ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নীরুর রাজনীতির বন্ধুর পথে যাত্রা শুরু। কাজী আসাদ তখন ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আর চারজন ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। প্রথমবারের মতো ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ছাত্রদলের কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান নীরু। সভাপতি নির্বাচিত হন জালাল আহমেদ আর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান নীরুর সহোদর মাহবুবুল হক বাবলু।
নির্বাচনে তাদের কাছে পরাজিত হন দুদু-হাবিব-হিরু। নেতাকর্মীরা জানান, নীরুর বড় ভাই মাহবুবুল হক বাবলুকে এখনো ছাত্রদলের সর্বকালের সেরা সংগঠক হিসেবে প্রতি বছর তার মৃত্যুদিবস পালন করে দলটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক রহস্যময় মৃত্যু হয়েছিলো এই সেরা সংগঠকের। এক সময়ে বাবলু-নীরু মেধাবী নেতাদেও দিয়ে ছাত্র রাজনীতির ধারা শুরুর পাশপাশি সংগঠনের নেতাকর্মীদের চৌকষ কর্মী হতে দিক্ষা দিয়েছিলেন। আশির দশকেরে নেতাকর্মীরা জানান, ওই সময়ে বাবলু-নীরুই প্রত্যেক ছাত্রদল নেতাকর্মীদের জন্য জিন্স আর কেডস প্রচলন শুরু করেছিলো। তারা ছাত্রদলকে অন্যান্য যে কোন সংগঠন থেকে ভিন্নমাত্রা দেয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা করতো। তাদের সে চেষ্টা সফলও হয়েছিলো বলে আজকের বিশালাকার ছাত্রদল প্রতিষ্ঠিত।
তারা বলেন, ১৯৮৯ সালের ডাকসুতে মনোনয়নবঞ্চিত হলেও ছাত্রদলের ডাকসু জয়ের নেপথ্য রূপকার মনে করা হয় নীরুকেই। সেদিন ছাত্রদলের প্যানেল পরিচিতি সভায় নীরু যখন ক্যাম্পাসে এলেন তখন ক্যাম্পাস জেগে উঠেছিল রীতিমতো বিস্ময়রূপে। তার সমর্থনেই আমান-খোকন প্যানেল জয়ী হয়। কিন্তু তাদের কারনেই নীরুকে রাজনীতিতে পরাজিত হতে হয়েছে। এটা আদর্শের নয়, অপরাজনীতির শিকার হন নীরু।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়ার আদর্শের সৈনিক হিসেবে নীরুর সংগ্রামী যাত্রা শুরু হয়েছিল ছাত্রদল দিয়ে। আর তাদের হাত ধরে উঠে আসা ছাত্রদলের প্রবল শক্তি আর বিশাল কর্মীবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে একবার নয়, একাধিকবার। কিন্তু সানাউল হক নীরুর যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি বিএনপিতে। আর তার মতো নেতাকে এভাবে হেয় প্রতিপন্ন আর অবমূল্যায়নের খেসারত দিতে হচ্ছে পুরো দলকে।
আশির দশকের ছাত্রদল নেতাকর্মীরা জানান, সংগঠনকে শক্তিশালী করতে কিংবা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন যারা নয় বছরে একটি মামলারও শিকার হননি, একটি বারের জন্যও গ্রেফতার হননি তাদেরকেই তখন মূল্যায়ন করে দলের গুরুত্ত্বপূর্ন পদ-পদবী দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছিলো। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো পুরস্কৃত করা হয় সুবিধাবাদীদের। আর বঞ্চিত করা হয় নীরুদের মতো অভিমানি নেতাকর্মীদের।
নেতাকর্মীরা জানান, এখনো খুব সাদামাটা জীবনযাপন করেন সানাউল হক নীরু। সেই জিন্স প্যান্ট, টি শার্ট আর কেডস পরেই চলা ফেরা করেন। বয়সের ভারে এখন স্বাস্থ্য অনেকটা ভারী হয়ে উঠেছে। ধার্মিক জীবনের সাথে তার ব্যাবসায়িক জীবনও সফল। রাজনীতির সেই পুরানো নিয়ম মেনে চলেন তিনি। এখনো কোন নেতাকর্মী কাছে গেলে নিজ হাতে আপ্যায়ন করার নীতি ধরে রেখেছেন।
কর্মীরা জানান, বিএনপি তাকে ছাড়লেও দলটির নেতাকর্মীরা এখনো তাকে ছাড়েননি। এখনো সকলের অজান্তে ছুটে আসেন কিংবদন্তী এই ছাত্রনেতার কাছে দিক্ষা নিতে। পরামর্শ নিতে।
বিএনপিতে ফেরার আশায় জীবনের বড় একটি অংশ অতিবাহিত করেছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার স্নেহের পরশে আবারো রাজপথ দাবড়িয়ে ফিরবেন এই স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হয়ে ওঠে না। কোন এক অদৃশ্য দেয়াল চেয়ারপার্সনের কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। আর এ কারণে তিনি বলেন, ‘বিএনপিতে তিনি মৃত। তার বড় ভাই এই দলের জন্য জীবন দিয়ে এখনো দলের মাঝে জীবিত। আর তিনি বেঁচে থেকেও দলের কাছে মৃত। কিন্তু নিজের অপরাধ জানার অধিকারটুকুও পেলেন না।’