স্বাস্থ্য বিভাগ কি গভীর ষড়যন্ত্রে আজও?
স্বাস্থ্য বিভাগ কি গভীর ষড়যন্ত্রে আজও?
রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভাগ্য, তারা তাঁদের স্বাস্থ্য বিভাগকে ষড়যন্ত্রমুক্ত করতে পারছেন না। মানুষ দীর্ঘদিন যাবত নানাভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরে বহুকাল যাবত ঢালা অবাধ দুর্নীতির মহোৎসবকে। সে প্রতিবাদ উপেক্ষিত হয়ে আসছিল-বাড়ছিল মানুষের অসহায়ত্ব।
অবশেষে এলো করোনা ভাইরাস। এ ভাইরাস প্রতিরোধে সারা বিশ্ব আজও সফলতা অর্জন করতে পারে নি-বাংলাদেশও না। তাই প্রতিরোধে আজতক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের অক্ষমতা নিয়ে কোন অভিযোগ তেমন একটা নেই।
তারপরও, অর্থাৎ দিনে দিনে ঐ প্রাণঘাতি ভাইরাসে লক্ষ লক্ষ নাগরিক সংক্রমিত হচ্ছেন এবং হাজার হাজার মানুষ অসহায় মৃত্যুবরণ করছেন-এর বিরুদ্ধে যে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব থাকলেও আজও যে তা করা হয় নি-তাই নিয়ে স্বভাবত:ই মানুষ ক্ষুব্ধ। মানুষ ক্ষুব্ধ, আজও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোন কর্মকর্তাকে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় নি কারও বিরুদ্ধে একটিও মামলা দায়ের বা গ্রেফতার করা হয় নি-এই কারণে। কতদিনে অবস্থার পরিবর্তন হবে, দুর্নীতিবাজরা চিহ্নিত হবে কতদিনে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসবে তার কোন হদিশ ও এই দীর্ঘ ছয় মাসের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না।
হ্যাঁ, তীব্র সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তাকে পদত্যাগ করানো হয়েছে, আরও বেশ কিছু সংখ্যক কর্মকর্তাকে, সংবাদপত্রের ভাষায়, ‘সরিয়ে দেওয়া’ হয়েছে। কিন্তু তাঁদের ‘সম্মান’ রক্ষার্থে বলা হয়েছে, “না তাঁদেরকে দুর্নীতির অভিযোগে” সরানো হয় নি-এই রদবদল “রুটিন ওয়ার্ক” মাত্র।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তীব্র সমালোচিত ডিজি অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ “পদত্যাগ” করার পর একজন সৎ ও জনপ্রিয় চিকিৎসককে ঐ পদে নিয়োগ দানের পর সকল মহল থেকেই তাঁকে অকুণ্ঠ অভিনন্দ জানান হয়েছিল এই প্রত্যাশায় যে তিনি কঠোর হাতে সকল দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতি জনগণের হৃত আস্থা পুনরুদ্ধার করবেন ও দুর্নীতির সিন্ডিকেটকে কঠোরভাবে ভেঙ্গে দেবেন। তা হয় নি আজও। তবে তিনি এতই কম দিন হলো দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন-তার মধ্যে যে দুর্নীতির শক্তিশালী চক্র ভঙ্গ সম্ভব না তা সকলেই উপলব্ধি করে ধৈর্য্যধারণ করে আছেন। আশা করি মানুষ তাঁর কাছে হতাশ হবেন না।
ইতোমধ্যেই খবর বেরিয়েছে, সংক্রমণের দিক থেকে বাংলাদেশ ইতালিকে অতিক্রম করেছে। আবার মজার ব্যাপার হলো এই খবর প্রকাশের সাথে সাথেই জানানো হলো “সংক্রমণের হার বাড়লেও হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাকমছে”। তাৎপর্য্যপূর্ণ খবর বটে। মে-জুন-জুলাই এর তুলনায় ভূয়া, তা কি আজও সরকার অসত্য বলে মনে করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও এম.পি’রা কি ঐ হাসপাতালগুলিতে গিয়ে সপরিবারে করোনা পরীক্ষা করাতে সম্মত হবেন? সরকার হঠাৎ করে করোনা টেস্টের বাবদে ফি নির্ধারণ করে কঠোর দারিদ্র্য পীড়িত কোটি কোটি মানুষের জন্য করোনা টেষ্ট অসম্ভব করে তোলেন নি?
ধন্যবাদ জানাতে হয় আমাদের জনগণকে এবং আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ-র্যাব প্রমুখকে। জনগণের অভিযোগের বিত্তিতেপুলিশ-র্যাব বেশ কয়েকটি হাসপাতালে অভিযান চালালেন। আমরা দেখলাম, বেশীর ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের কোন রেজিষ্ট্রেশন নাই, জানলাম বেশ কিছু হাসপাতাল থেকে বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে করোনা টেষ্ট করে ভুল বা ভূয়া সার্টিফিকেট দিচ্ছে। ফলে কয়েকজন ধরাও পড়লেন র্যাব-পুলিশের হাতে। অপরাপর বহু হাসপাতালের বহু দুর্নীতির অভিযোগ গোপনে আসতে লাগলো র্যাবের কাছে। অভিযান পরিচালনা করলো বাহিনীদ্বয় অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলো। বেশ কয়েকজন হাসপাতালের কর্মকর্তা গ্রেফতার হলেন। তাঁরা পুলিশের কাছে বহু রাঘব বেরায়ালের নাম প্রকাশ করে জানালেন যে তাঁদের যোগ সাজশে, বা আশ্রয়-প্রশ্রয়েই তাঁরা এমন দুর্নীতি করছেন। ঐ রাঘব-বোয়ালরা কোথায়? তাঁরা একজনও ধরা পড়ছেন না কেন? কোন শক্তিশালী চক্র ঐ রাঘব বোয়ালদেরকে রক্ষা করছে।
অভিযান বন্ধ-নতুন নির্দেশনা
লক্ষ্যনীয় যে অনেকগুলি হাসপাতালে র্যাব-পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত বেশ কিছু সফল হওয়ায় জনমনে স্বস্তির ভাব সৃস্টি হয়েছিল যদি কোন ক্ষেত্রেই, সম্ভবত: উপরের হাতছানিতেধরা পড়া অভিযুক্তরা রাঘব-বোয়ালদের নাম পুলিশের কাছে প্রকাশ করলেও তাদের কোন তালিকা আজও প্রকাশ করা হয় নিবা ঐ রাঘব-বোয়ালদের টিকিটিও আজতক কেউ ছোঁয়ার সাহস পায় নি। সম্ভবত: ভেতরে ভেতরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা কোন শক্তিশালী মহল কলকাঠি নাড়ার ফলেই এমন গোপনীয়তা ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়েছেন র্যাব-পুলিশ কর্মকর্তারা।
কিন্তু অভিযান বন্ধ হলো কেন? আর কি করোনার জাল সার্টিফিকেট ইস্যু হচ্ছে না? দেশের যে সকল বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক দিব্যি বিনা লাইসেন্সে কাজ চালচ্ছিল তারা কি ইতোমধ্যে তাদের লাইসেন্স সংগ্রহ করে নিয়েছে?
না, এগুলির কোনটিই হয় নি হলেও অতি সামান্য সংখ্যক হাসপাতাল-ক্লিনিক তাদের লাইসেন্স হয়তো নবায়ন করে নিয়েছে। সরকার বা স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের কি করোনীয় নয় কখন বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক তাদের লাইসেন্স নবায়ন করে নিচ্ছেন বা কোন কোন হাসপাতাল-ক্লিনিক আজও তা করে নি? যারা নবায়ন করে নি-তাদের নামের তালিকা দ্রæত প্রকাশ করা জরুরী কারণ সে সব জেনে বুঝে তবেই তো মানুষ হাসপাতালে রোগী ভর্তি করাবেন। শুধু তাই না, সকল হাসপাতালে অসন সংখ্যা অনুযায়ী ডাক্তার (বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সহ), নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আছে কি না-বা তারা রোগীর কাছ থেকে অত্যাধিক টাকা আদায় করছে কি না তা-ও দেখা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তব্য।
যা হোক, অভিযান বন্ধ হওয়ার কারণ এখন অনুমান করা যায়। কথিত ও রাঘব বোয়ালদের সিন্ডিকেটের স্বার্থে(?) যখন তখন হাসপাতালগুলিতে অভিযান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নির্দেশনা জারী করেছেন। ঐ নির্দেশনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে কোন হাসপাতালে অভিযান চালানো যাবে না।
প্রশ্ন করি, কেন এই নির্দেশনা? আগের অভিযানগুলি পরিচালনা কালে র্যাব বা পুলিশের কোন কর্মকর্তা বা তাঁদের কেউ কি বে-আইনী কিছু করেছেন? যদি তা করে থাকেন, তিনি সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবেই অপরাধী। তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি বিধান করা হোক-অব্যাহত রাখা হোক হাসপাতালগুলির মালিক-কর্মকর্তাদের অন্যায়, অবৈধ কার্য্যকলাপের বিরুদ্ধে অভিযান। অভিযানকে আরও জোরাদর করা হোক এবং ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সর্বত্র তা প্রসরিত করা হোক।
একই সাথে, দেশের সকল এলাকার মানুষকে যতটা করোনামুক্ত রাখার জন্য অবিলম্বে করোনা টেষ্টিং ফি প্রত্যাহার, দেশের সকল জেলায়, এবং সম্ভব হলে উপজেলাগুলিতেও করোনা টেষ্ট কিটস্ যথেষ্ট পরিমাণে সরবরাহ করে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা করে যাঁদের ক্ষেত্রে শনাক্ত হবে-তাঁদের সকলের অবিলম্বে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। প্রতিটি জেলাতেই কমপক্ষে ৮টি করে করোনা পরীক্ষার ল্যাব স্থাপন এখন অপরিহার্য্য। এ ব্যাপারে অতীতেরও লিখেছি কিন্তু তার কোন ফল না হওয়ায় পুনরায় বিষয়টি উল্লেখ করতে হলো।
কিন্তু অভিযান পরিচালনার পথ আইন করেন রোধ করা, দুর্নীতিবাজ ও তাদের গডফাদারেরা আজও ধরা-ছোঁয়ার ঊর্ধে থেকে নিরাপদে ঘুরে বেড়ানো প্রভৃতি দেখে মনে হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক গভীর ষড়যন্ত্রে শিকার। এ আশংকা সত্য হলে তা থেকে উদ্ধারে অত্যধিক তৎপর হওয়া প্রয়োজন।
উদ্বেগের খবর হলো, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ওয়েড আসন্ন। তা থেকে পরিত্রাণের প্রচেষ্টা দ্রæত সুরু করা প্রয়োজন। যেমন করোনা পরীক্ষার কিটস্ দেশের সর্বত্র যথেষ্ট পরিমাণে সরবরাহ প্রতি জেলায় কমপক্ষে আটটি করে করোনা পরীক্ষার ল্যাব স্থাপন, প্রতিটি হাসপাতালে উপযুক্ত সংখ্যক আই.সি.ইউ, ভেন্টিলেটার, গ্যাস সরবরাহ, উপযুক্ত সংখ্যক ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রয়োজনীয় উপকরণাদির সরবরাহ অতি শীঘ্র করা প্রয়োজন।
প্রয়োজন করোনা চিকিৎসার হাসপাতাল ওয়ার্ড ও বেড সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তা অতি সত্বরেই শুরু করা।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।