স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় বাংলাদেশ।
অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছে একটি জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
বিশ্বের ১২৯ টি দেশে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে এক সমীক্ষার পর জার্মান প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ তাদের রিপোর্টে এই মন্তব্য করে। রিপোর্টটি শুক্রবার প্রকাশ করা হয়েছে। ওই তালিকায় নতুন করে পাঁচটি দেশ স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকা ডুকেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
রিপোর্টে ১২৯ টি দেশের মধ্যে ৫৮ টি দেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং ৭১ টি দেশকে গণতান্ত্রিক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ২০১৬ সালে তাদের আগের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিশ্বের ৭৪টি দেশে গণতান্ত্রিক এবং ৫৫টি দেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলছে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশসহ ওই পাঁচটি দেশ গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করছে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্যালোচনা চলাকালীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মৌলবাদীদের হামলা সংঘটিত হতে দেখা গেছে। সারা দেশে সহিংসতা চালানোর জন্য প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়েছে বিরোধী দল বিএনপিকেও। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘দুই প্রধান নেত্রীর মধ্যকার বিরোধ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়।’
বেরটেলসমান স্টিফটুং নিজেদের ওয়েবসাইটে ‘ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স বিটিআই’ নামের এই সূচক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০০৬ সাল থেকে নিয়মিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্লেষণ করে আসছে এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান। চলতি বছর ১২৯টি উন্নয়নশীল ও রূপান্তরিত দেশের ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪০টি দেশের সরকার গত দুই বছর ধরে আইনের শাসনকে ‘বন্দী’ করে রেখেছে। অন্যদিকে ৫০টি দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। সারা বিশ্বেই গণতন্ত্র এখন চাপের মুখে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর মোট ১৩টি দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। এই তালিকায় বাংলাদেশ ছাড়াও আছে মোজাম্বিক. তুরস্ক ও ইয়েমেনের মতো দেশ। আর এই ১৩টি দেশের মধ্যে ৫টি দেশে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ডও পূরণ হচ্ছে না।
তবে এই সূচক অনুযায়ী, বুরকিনা ফাসো ও শ্রীলঙ্কা লক্ষণীয় উন্নতি সাধন করেছে। এ দুটি দেশকে নতুন গণতন্ত্রের দেশ বলা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশকে নতুন স্বৈরতান্ত্রিক দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, খারাপ মানের নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশকে এই তালিকায় ঢোকানো হয়েছে।
জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি আরও বলেছে, অর্থনৈতিকভাবে ভালোই উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। বাণিজ্য–ঘাটতিও আগের তুলনায় কমে এসেছে। তবে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই দেশের স্নাতক পাস করা তরুণদের ৪৭ শতাংশ কর্মসংস্থানের সুযোগ পান না। যোগ্যতার চেয়ে নিম্নমানের চাকরিতে শিক্ষিত তরুণদের যোগদান বাংলাদেশের একটি অন্যতম সমস্যা বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বেরটেলসমান স্টিফটুংয়ের প্রতিবেদনে দেওয়া সূচকে গণতন্ত্রের মানের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে উরুগুয়ে। দুইয়ে আছে এস্তোনিয়া। আর তালিকার তিন নম্বরে আছে তাইওয়ান। বাংলাদেশ আছে ৮০ নম্বরে। রাশিয়া আছে ৮১ নম্বরে। তালিকার ২৪ নম্বরে আছে ভারত, ভুটান আছে ৪০ ও শ্রীলঙ্কা আছে ৪২ নম্বরে। তালিকার ১০৯ নম্বরে আছে চীন। আর এই সূচকের শেষ তিনটি স্থান যথাক্রমে ইয়েমেন, সিরিয়া ও সোমালিয়ার দখলে।
‘বাংলাদেশ আর গণতান্ত্রিক নয়’
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এই সমীক্ষা চালানো হয় যেসব দেশের ওপর, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে পাঁচটি দেশের কথা—বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া এবং উগান্ডা।
রিপোর্টে বলা হচ্ছে, এই পাঁচটি দেশ এখন আর গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত মানছে না। এসব দেশে বহু বছর ধরেই গণতন্ত্রকে ক্ষুন্ন করা হচ্ছিল। এসব দেশের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণেই এটা ঘটেছে বলে মন্তব্য করা হয় রিপোর্টে।
“এই পাঁচটি নতুন স্বৈরতান্ত্রিক দেশ এমন একটা পর্যায় অতিক্রম করেছে, যেদিকে যাচ্ছে আরও কিছু ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশ – হন্ডুরাস, হাঙ্গেরি, মলডোভা, নিজার, ফিলিপাইন এবং তুরস্ক।”
তবে রিপোর্টে কিছু কিছু দেশে গণতান্ত্রিক অগ্রগতির প্রশংসা করা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা, মরিশাস এবং উরুগুয়ে।
২০১৬ সালের রিপোর্টে বার্কিনা ফাসো এবং শ্রীলংকাকে মধ্যম মাত্রার স্বৈরতন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। এই দুটি দেশকে এবারের রিপোর্টে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য:
বেরটেলসম্যান স্টিফটুং এর এই রিপোর্টটির ব্যাপারে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের সঙ্গে। বিবিসি বাংলার পরিক্রমা অনুষ্ঠানে মাসুদ হাসান খানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি রিপোর্টটি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন।”
রিপোর্টটির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “যে সমীক্ষার ভিত্তিতে রিপোর্টটি করা হয়েছে, সেটির তথ্য তারা কোথায় পেয়েছে? রিপোর্টটি যদি ২০১৫ সাল থেকে নেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হয়ে থাকে, তাহলে সেবছর তো বাংলাদেশে উল্টো ঘটনা ঘটছিল। বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপি যে অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করেছিল, তখন বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ চরমভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছিলেন, তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় হত্যা করা হচ্ছিল,আহত করা হচ্ছিল। ”
এইচ টি ইমাম বলেন, বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্র বা নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন, তাদের কারও কাছে কখনো তিনি এরকম কোন সমীক্ষা হচ্ছে বলে শোনেন নি।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত রক্ষা করা হচ্ছে না বলে রিপোর্টে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সে প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন, “গণতন্ত্রের মানদন্ড কি আমাদের জার্মানদের কাছ থেকে শিখতে হবে? হিটলারের দেশ থেকে?”
২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে যেসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সেসব পরবর্তীকালে বিশ্বের সব দেশ মেনে নিয়েছে বলে দাবি করেন এইচ টি ইমাম। তিনি বলেন, ‘ঐ নির্বাচন সঠিকভাবে হয়েছে, সবাই অংশ নিয়েছে। ঐ নির্বাচনের পরে যদি এই সমীক্ষা হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এর পেছনে অন্য কারণ আছে।”
বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে রিপোর্টে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে তার জবাবে এইচ টি ইমাম বলেন, ” বাংলাদেশে এখন ঢাকা থেকেই প্রকাশিত হয় প্রায় তিনশোর বেশি দৈনিক। প্রত্যেকটি সংবাদপত্র কিভাবে লিখছে আপনারা দেখতে পারেন। প্রত্যেকটি টেলিভিশনের টক শো যদি আপনি দেখেন, সেখানে কি মত প্রকাশের অধিকার নেই, স্বাধীনতা নেই? বাংলাদেশে মোটেই কোন কিছু সেন্সর করা হচ্ছে না।”