স্যামসন এইচ. চৌধুরী স্মরণে
স্যামসন এইচ. চৌধুরী স্মরণে
রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
গার্মেন্টস শিল্প যেমন বাংলাদেশের প্রধান বৈদিশকি মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প পরিগণিত হয়-তেমনই ঔষধ শিল্প এ দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দেশ হিগসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠাতা ওষুধ প্রখ্যাত কারখানা প্রতিষ্ঠাতদা চার জনের প্রথম স্যামসন হোসেন চৌধুরী এবং অপর তিন সহযাত্রী ছিলেন ডা. কাজী হারুনর রশিদ, ডা. পরিতোষ কুমার সাহা এবং রাধিকামোহন রায়। কাল পরিক্রমায় স্যামসন এইচ চৌধুরী প্রতিষ্ঠানটির শতভাগ মালিকানা অর্জন করেন।
স্যামসন এইচ. চৌধুরীর পিতা ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী এবং মাতা লতিকা চৌধুরী। গোপালগঞ্জের অরুণাকান্দিতে ১৯২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে তাঁর বাবা ছিলেন চাঁদপুর মিশন হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার। ১৯৩২ সালে তিনি চাঁদপুর থেকে বদলি হয়ে পাবনা জেলায় আতাইকুলায় চলে আসেন। স্যামসন এই চৌধুরীকে আতাইকুলার এক গ্রামীন পাঠশালায় ভর্তি করে দেওয় হয়।
১৯৩৩ সালে উন্নততর শিক্ষা অর্জনের জন্য স্যামসন এইচ চৌধুরীকে ময়মনসিংহ ভিক্টোরিয়া মিশন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি করে দেওয়া হয়।
তিনি ১৯৩৫ সালে পশ্চিম বাংলার বিষ্ণুপুরে শিক্ষাসংঘ হাইস্কুলে ভর্তি হন কিন্তু ১৯৩৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে পুনরায় আতাইকুলা ফিরে আসেন এবং আতাইকুলা হাই স্কুল থেকে ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ওই বছরেই তিনি রম্যাল ই-িয়ান নেভিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে নৌ-বিদ্রোহে যোগ দেন। এক পর্য্যায়ে তিনি গ্রেফতার হন এবং ৫ দিন জেলে আটক রাখার পরে তাঁকে একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে (বন্দী শিবির) পাঠানো হয়। এক মাস বন্দী শিবিরে আটক থাকার পর তিনি মুক্তিলাভ করেন। মুক্তির সময় তাঁকে একটি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। ওই সার্টিফিকেটে তাঁকে সরকারি প্রশাসনিক বা আইন শৃংখলা বাহিনী পদে নিয়োগের সুপরিশ করা হয়। স্যামসন এইচ চৌধুরী ডাক বিভাগে চাকুরী গ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালের ৫ আগষ্ট মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৫ বছর বয়স্ক অনিতা বিশ্বাস (পরবর্তীতে অনিতা চৌধুরী) এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। স্যামসন অনিতা দম্পতি তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের বাবা-মা।
১৯৫২ সালে স্যামসন এইচ চৌধুরী ডাক বিভাগের চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন এবং তাঁর বাবার পরামর্শে ইসন্স্ (ইয়াকুব এ- সনস) নামে একটি ওষুধের দোকান খোলেন আতাইকুলাতে।
১৯৫৮ সালে ক্ষুদ্রাকারে চার জন মিলে সম পরিমাণ পুঁজি নিয়ে পাবনা শহরের শালগাড়ীয়া মৌজায় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস্ নামে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ওষুধ প্রস্তুত কারখানা স্থাপন করেন। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে বিপুল পরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ৫ লক্ষ টাকার মূলধনের মধ্যে ৪ লক্ষ টাকা পেইড আপ ক্যাপিটাল নিয়ে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানীতে পরিণত হয়।
১৯৬৭ সালে একটি মার্কিন মালটি ন্যাশনাল কোম্পানীর লাইসেন্সও অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস্ এ দেশের নেতৃস্থানীয় কোম্পানী হিসাবে বিদেশে তাদের পণ্য রফতানীর সুযোগ অর্জন করে। বর্তমানে রফতানী আয়ই স্কয়ার গ্রুপ অব কোম্পানীজ এর প্রধান আয়।
স্যামসন হোসেন চৌধুরী চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতাকামী একজন হিসেবে স্বাধীনতার শত্রুদের টার্গেটেও পরিণত হয়েছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক খৃষ্টান সংগঠনের সাথে গোপনে যোগাযোগ স্থাপনে মুক্তিযুদ্ধকালে ভাল পরিমাণ সহযোগিতা সংগ্রহ করেন এবং তা বিতরণের ব্যবস্থাও করেন।
অসাধারণ বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী পাবনার স্যামসন এইচ চৌধুরী তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনও গড়ে তোলেন ব্যাপক অধ্যবসায়, দৃঢ় চিত্ততা ও নিষ্ঠার সাথে। আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠলেন জিরো থেকে হিরো। সামান্য একজন ডাক বিভাগের কর্মচারী বা কর্মকর্তা যাঁর বেতন সে আমলে ২০০ টাকার বেশী না-তিনি গড়ে তুললেন আন্তর্জাতিক পরিচিতি, বয়ে আনলেন অসংখ্য সম্মাননা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস্ হয়ে উঠলো একটি বিশাল রফতানি কেন্দ্রিক শিল্প।
ওষুধ প্রস্তদুতেই সীমাবদ্ধ থাকলো না স্কয়ার নানা শাখা-প্রশাখা তাকে করে তুললো সুস্থ-অসুস্থ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সফল মানুষের নিত্য দিনের সাথী। নিশ্চিন্তে, নির্বিবাদে ভেজালমুক্ত ও উচ্চ মানসম্পন্ন নানাবিধ পণ্য। এগুলির প্রয়োজন পড়ে ঘুম থেকে উঠেই প্রয়োজন ফুরোয় রাতে ঘুমানোর আগে। এতই তাদের পণ্য সম্ভার যার কৃতিত্ব স্যামসন এইচ.চৌধুরী। তাঁর কঠোর হুঁশিয়ারী ছিল কর্মকর্তাদের প্রতি-কোন পণ্যই যেন মায়ের দিক থেকে নি¤œমানের বলে পরিচিতি না পায়। সেই ১৯৫৮ থেকে আজ ২০২২ সাল-অর্থাৎ আজ প্রায় ৬৪ টি বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি সকল পন্যের মান বজায় রেখেছে। এ গৌরবের দাবীদার এককভাবে স্যামসন হোসেন চৌধুরী এবং তাঁর প্রেমময়ী সহধর্মিনী মিসেস অনিতা চৌধুরী।
সমগ্র ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি-নির্বাচিত হয়েছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটান চেম্বার্স অব কমার্সের সভাপতি।
দেশের সর্বোচ্চ করদাতাদের মধ্যে স্যামসন এইচ. চৌধুরী অন্নতম সর্বোচ্চ এবং কর ফাঁসির অভিযোগ-স্কয়ার গ্রুপ অব ই-াষ্ট্রিজ এর বিরুদ্ধে।
গড়ে তুলেছেন ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বেসরকারি হাসপাতাল ‘স্কয়ার হাসপাতাল’। নিশ্চিন্তে চিকিৎসা নেওয়া যায়। তবে অতি উচ্চ ব্যয়ের হওয়াতে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে স্কয়ার হাসপাতাল। যদি ওটা সাধারণ মানুষের আয়ত্তাধীন করা সম্ভব না হয় তদবে প্রস্তাব রাখবো-আগামী ১০ বছরের মধ্যে যেন পাবনা এবং উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষের জন্য অন্তত: রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলিতে ৫০০ থেকে ১,০০০ বেড সম্পন্ন হাসপাতাল ও একটি মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়, নার্সিং এর উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গড়ে তোলা হয়।
স্কয়ার নিজস্ব ক্রিকেট ও ফুটবল টিমও গঠন করে সেগুলিকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারেন।
স্কয়ার পাবনা ছাড়াও ঢাকা ও কাশিয়াকৈরে তাদের প্রতিষ্ঠানের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। তিন জায়গা মিলে প্রায় ৭০-৭৫ হাজার কর্মী এগুলিতে কর্মরত। একটি অভিযোগ আছে-সেখানে নাকি নি¤œস্তরের কর্মীরা দিন ভিত্তিক পরিশ্রমিক পান এবং স্থায়ী হতে ১০-১৫ বছরও লেগে যেতে পারে। এ নিয়ম থাকলে তা রচিত করে ছয়মাস কাজ করার পর যোগ্যতার ভিত্তিতে বাধ্যতামূলকভাবে স্থায়ী করার বিধান এবং শ্রম আইন অনুসারে স্বাধীন ড্রেড ইউনিয়ন গঠন করে আই.এল.ও কনডেনশনের সকল বিধান কার্য্যকর করা হোক।
স্যামসন এইচ চৌধুরী সমাজসেবায় একুশে পদকেও ভূষিত হন ২০১১ সালে।
পাবনা প্রেসক্লাবের দ্বিতল ভবনে ডি.আই.পি. মিলনায়তন তিনি উদ্বোধন করেন। পাবনা প্রেসকক্লাবের তিনি জীবন সদস্যও বটেন।
প্রতি বছর পাবনা প্রেসক্লাব তাঁর সম্মানে মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ৫ জানুয়ারি তাঁর স্মরণসভার আয়োজন করে থাকে। অবশ্যই সেগুলিতে আমি উপস্থিত থাকি এবং তাঁর জীবনের জানা অংশগুলি আলোচনায় এনে থাকি।
কয়েক বছর ধরে এই অনুষ্ঠানগুলিতে স্যামসন এইচ. চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দুটি প্রস্তাব রেখে থাকি। তা হলো এক. স্যামসন হোসেন চৌধুরীর জীবন লেখা হোক এবং বই আকাশে প্রকাশ করা হোক এবং
দুই. স্যামসন এইচ চৌধুরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আতাইকুলা হাই স্কুলের সর্বপ্রকার উন্নয়ন করা হোক।
২০১২ সালে ৮৬ বছর বয়সে এই কর্মতীর স্যামসন এইচ চৌধুরী সিঙ্গাপুরের এক হাসতাপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পাবনাতে সমাহিত।