সড়কপথে বেশুমার হত্যালীলা নিত্যদিন প্রতিদিন !
সড়কপথে বেশুমার হত্যালীলা নিত্যদিন প্রতিদিন !
সিডনীর কথকতা-৪৫
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ ।
সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত ।
“নিরাপদ সড়ক চাই” দাবীতে শিক্ষার্থীরা গড়ে তুললো তাদের দুই সতীর্থের আকষ্কিক ও নির্মম হত্যার প্রতিবাদে। আকষ্কিকভাবে গড়ে ওঠা স্বত:স্ফূর্ত এই আন্দোলনে সারা দেশে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা হিসেবে আনলে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ পথে নেমেছিলেন ঐ দাবীর ভিত্তিতে গড়ে তোলা আন্দোলনের সাথে সক্রিয় সংহতি জানাতে। চলমান দশকের হয়তো বা এটাই বিবেচিত হবে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও আইনের শাসনের দাবীতে সর্বাধিক গণমুখী আন্দোলন। ঐ তরুণ-তরুণীরাই এ দেশের আগামী দিনের আশা-আকাংখার প্রতীক-এমন একটা সুখকর অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই।
“নিরাপদ সড়ক চাই” দাবীতে গড়ে ওঠা এই অভূতপূর্ব আন্দোলন শেষ পর্য্যন্ত স্পষ্পত: “আমরা সুবিচার চাই,” “আইনের শাসন চাই” “ ……….” এই দাবীর রপ ধারণ করে। সেদিনকার রাজপথে, সড়কে, মহাসড়কে যে সব মিছিল দেখা গিয়েছিল ঐ সব মিছিলকারীদের অনেকেই দেখেছি “………..” লেখা ব্যানার বহন করতে। তা দেখেছি সুদূর অষ্ট্রেলিয়ায় বসেও বাংলাদেশের টেলিভিশনে, সংবাদপত্রে এবং ফেসবুকে।
প্রবাসী বাঙালিরাও নানাদেশ থেকে ঐ তরুণ-তরুণীদের গড়ে তোলা ন্যায্য দাবী আদায়ের ধরণ, নিয়মতান্ত্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ জনস্বার্থের অনুসারী “আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরোধী” বা সরকার বিরোধী ক্রান্ত” বলে আখ্যায়িত করা, পিছনে জামায়াত-বিএনপির মদদ থাকার কথা প্রচার করা নেহায়েতই অনাকাংখিত।
সরকারের এটা উপলদ্ধি করা প্রয়োজন জনস্বার্থে সংঘটিত কোন যৌক্তিক আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হলে তাদের দাবী যদি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে মেনে নিয়ে তা কার্য্যকর করা না হয়-তবে সরকারের পতন যারা চায় তারা তো কলকাঠি নাড়ার সুযোগ পেয়ে যেতেই পারে। তার জন্যে মূল আন্দোলনকারীরা তো আদৌ দায়ী হতে পারে না। আবার শহীদুল আলমের মত স্বনামে খ্যাত এবং আন্তর্জাতিক পরিস্বরেও তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে পরিচিতি ব্যাপকভাবে থাকা সত্বেও তাঁকে অযথা আন্দোলনে মদদ যুগিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহে লিপ্ত বলে অভিযোগ এনে নিজেদেরকেই মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিরোধী বলে চিত্রিত হওয়া ছাড়া অন্য কিছু হয় না।
সরকারের বরং জোর দেওয়া উচিত পরিবহন খাতের তাবৎ ঝামেলা, নিত্যদিন অসংখ্য মৃত্যু-বিপুল সংখ্যক মানুষের আহত হওয়ার মত ঘটনাগুলি যাতে আর না ঘটে তার জন্যে উপযুক্ত সকল ব্যবস্থাদি গ্রহণ করে মানুষের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করা। সড়ক, রেল ও নদী মন্ত্রীদের বুলগেরিয়ার মত কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক। ঢাকা শহর যে যে কারণে সমগ্র পৃথিবীর দুর্ণাম কুড়িয়েছে তার মধ্যে প্রধানতম ব্যাপারই হলো অস্বাভাবিক যানজট। কেউই জানেন না- ঢাকা শহরেরই একস্থান থেকে রওনা হয়ে আধঘন্টার রাস্তায় গন্তব্যস্থানে পৌঁছাতে দু’ঘন্টাতেও পৌঁছাতে পারবেন কিনা। জীবনটাকে তো হাতের মুঠোয় নিয়েই চলতে হয়।
এই যে সময় মেনে চলতে হনা পারার প্রধান কারণ অস্বাভাবিক জানজট। যে সমস্যা দিনে দিনে আরও প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে। কেউই তাই অনুমান করতে পারছেন না কোথায় গিয়ে শেষ পর্য্যন্ত ব্যাপারটি দাঁড়াবে। তাই কখনও ধারণা করা হয় বস্তি উচ্ছেদ করতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কেউ ভাবছেন রাস্তার ধারের ফুটপাতগুলি থেকে সব দোকান তুলে দিতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কেউ ভাবছেন ধীরগতির এবং তিন চাকার যানবাহন, যাহা; রিকসা, স্কুটার, ভ্যান এবং নছিমন করিমন বে-আইনী ঘোষণা করলেই রাস্তা-ঘাট পরিস্কার হয়ে যাবে-সকলে যানজটমুক্ত ঢাকা নগরী দেখতে পাবেন ইত্যাদি।
এখানেই শেষ না। নতুন নতুন ফ্লাইওভার নিমৃাণ, মেট্রোরেল প্রবর্তন ইত্যাদি কত কিছু ভাবা হচ্ছে-নগরীর চতুর্দিক দিয়ে নদী নির্মাণ করে জলপথ সৃষ্টি করে জলযান চালু করার প্রকল্পও অনেকদিন শুনাগেল। বিষয়টি শেষ পর্য্যন্ত সম্ভবত; ফাইলবন্ধী হয়ে কোন হোমরা-চোমরার টেরিলের ড্রায়ারে অথবা কোন একটা আলমারীতে থাকতে থাকতে উধাও হয়ে গেছে। আরও হয়তো বহু প্রকল্প গৃহীত হয়ে থাকবে বা আলোচনার প্রাথমিক স্তরে থাকতে পারে যা আমার জানা নেই।
নতুন পরিবতন আইন সংসদে পাশ হবে শীঘ্রই এ কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তার আগে সরকারকে বলতে হবে-বিদ্যমান আইন (পরিবহন সংক্রান্ত) আদৌ মানা হচ্ছে কি ? না মানা হলে কেন মানা হচ্ছে না এবং কারা তা মানছেন না।
সবাই জানি, সরকারি কর্মকর্তারাই তা মানছেন না। মানছেন না সরকারি কর্মকর্তাদের দূর্নীতিরবাজ অংশ। তার ফলে বিদ্যমান পরিবহন আইনকে কার্যত; অকেজো করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু তা কার স্বার্থে, যাত্রী সাধারণের স্বার্থে কি ? না পূরোপূরিভাবেই যাত্রীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। এবং তা এক বা একাধিক মন্ত্রীর গোপন প্রশ্রয়ে।
আইনে আছে রীতিমত যান্ত্রিকভাবে নিরাপদে চালানোর যোগ্য কিনা তা রীতিমত পরীক্ষা করে প্রতিটি যানবাহনকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতে হবে। ঐ ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকলেই কেবল যানটি সড়ক মহাসড়কে চালানো যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে। কিন্তু তা কি করা হয় ? আন্দোলনের পর বাধ্য হয়ে যে সকল পুলিশী অভিযান চালানো হচ্ছে তার ভিত্তিতে প্রকাশিত খবর সমূতের মাধ্যমে জানতে পারছি তা হলো বেশীর ভাগ যানবাহনই ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই চলছে।
এখন প্রশ্ন: তা হলে হাইওয়ে পুলিশ কেন ? তাঁরা কি চেক করেন ? এতগুলি যান-বাহন যদি ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া বছরের পর বছর রাস্তায় চলতে পারে-তাই ঐ পুলিশের প্রয়োজন কি ? সবাই জানে পুলিশের পকেটে কিছু দিয়ে দিতে পারলেই ঐ সার্টিফিকেটের নাকি দরকার পড়ে না।
তেমনই ব্যাপার দাঁড়িয়েছে চালকদের লাইসেন্স এর ব্যাপারে। দেখা যাচ্ছে, বেশীর ভাগ ড্রাইভারেরই বৈধ লাইসেন্স নেই কিন্তু তাঁরা দিব্যি দিবারাত্র কি দূরের কি নিকটের রুটে দিব্যি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছু টাকা বখষিসের বিনিময়ে। আর যানবাহনগুলির মালিক শ্রমিকেরা দিব্যি ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে ফিটনেস বিহীন গাড়ীসহ সকল যানবাহন দিব্যি চালাচ্ছেন লাইসেন্স না থাকা চালক-হেলপারদের দ্বারা। ফলে হাজার হাজার অসহায় যাত্রীর প্রাণ অকালে সড়কগুলিতে ঝরে পড়ছে।
এই অনিয়মের কারণে যে হাজার হাজার মানুষ পথে-ঘাটে প্রাণ হারাচ্ছেন, তাঁদের পরিবার পরিচন আজীবনের জন্য অসহায় হয়ে পড়ছেন অথচ এই গুরুতর বিষয়কে দিব্যি সড়ক দুর্গটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করা হয়েছে তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। সচেতন ভাবে ফিটনেস বিহীন ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চালালে এবং যানের কারণে যে মৃত্যুঘটে তা সম্পূর্ণত: সচেতন হত্যালীলা। অনুরূপভাবে গাড়ীর ফিটনেস থাকলেও যদি চালক-হেলপারদের লাইসেন্স ঠিকমত না থাকে এবং একই সাথে তাদের যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া না হয়ে থাকে তবে তাদের দ্বারা যে সকল মৃত্যুঘটে তাকেও নিশ্চিতভাবে হত্যাকান্ড বলে অভিহিত করতে হবে।
এছাড়াও যে সকল দুর্ঘটনা রাস্তার সংকীর্ণতার জন্য ঘটে তার জন্যেই বা কাকে দায়ী করা যাবে। সরকারের তো উচিত কোন রুটে কতগুলি এবং কোনকোন গাড়ী চলবে তা নির্ধারিত করে দেওয়া রাস্তার ধারণ ক্ষমতার ভিত্তিতে। নিধঅরিত স্টপেজগুলিতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যও গাড়ী থামা বাধ্যতামূলক করা উচিত- না থামলে তাকে দন্ডনীয় অপরাধ ঘোষনা করা উচিত। তদুপরি আইনের প্রয়োগ না হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলির জবাব দিহিতাই বা কোথায় ?
ফিটনেস বিহীন গাড়ী, লাইসেন্স বিহীন চালক দিয়ে গাড়ী চালানোর দায়-দায়িত্ব অবশ্যই সংশ্লিষ্ট গাড়ীগুলির মালিক-শ্রমিক, বিআরটিএ এবং পুলিশকে সমভাবে নিতে হবে। এই চতু:শক্তির কর্মসান্ডের ফলেই তো মানুষের সড়কযাত্রা ভীতিকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে-অসংখ্য মানুষ নিত্যদিনই হতাহম হচ্ছেন দেশের নানা অঞ্চলে। তাই এগুলিকে সুষ্পষ্টভাবে আইনের যথাযত সংশোধনী এনে “হত্যাকান্ড” বলে অভিহিত করে সর্বেচ্চ দন্ডের বিধান সংযোজন করা জরুরী। সাথে সাথে ভাবতে হবে কিভাবে এগুলি বন্ধ করা যায়। সমস্যার মূলে আছে জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, গাড়ী-ঘোড়া যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, রাস্তাগুলির সড়ক-মহাসড়ক নির্বিশেষে, পরিসর অত্যন্ত কর্ম, ঢাকা সিটির এলাকা প্রয়োজনের তুলনায় কম, পরিবহন নীতিমালার অভাব, পরিবহনের ব্যবস্থাপনা সেকেলে, যানবাহনের মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভ, বেকারত্ব জনিত কারণে চালক-হেলপার নামমাত্র বেতনে এবং লাইসেন্স ছাড়াই অথবা উপযুক্ত প্রশিক্ষণহীন লোকজনকে টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স প্রদান প্রভৃতি দায়ী। তাই কোন মলম দিয়ে বা ট্রাফিক সপ্তাহ জাতীয় আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
তাই নি¤েœাক্ত ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করতে সুপাশি করছি:
এক. ঢাকা সিটির এলাকা মানিকগহ্জ ও নারায়নগঞ্জ পর্য্যন্ত প্রসারিত করা হোক
দুই. হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট-ঢাকা জেলা ফৌজদারী দেওয়ানী আদালত মানিকগঞ্জে স্থানান্তির করা হোক এবং সেখানে বিচারক-কর্মচারী-আইনজীবীদের বাসস্থান গড়ে তোলা হোক
তিন. ঢাকা সিটির বাণিজ্যিক এলাকা নারায়গঞ্জে স্থানান্তরিত করা হোক,
চার. সম্প্রসারিত ঢাকা নগরীতে অন্তত: ত্রিশটি বহুতল বিশিষ্ট শিক্ষা ক্যাম্পাস গড়ে তুলে কয়েকটি বিশ্বদ্যিালয় ও কলেজ সেখানে স্থানান্তরিত করে সেখানেই শিক্ষকদের আবাসস্থল, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনমত ছাত্রাবাস-ছাত্রীবাস ও নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হোক;
পাঁচ. ফিটনেস লক্কর-ঝক্কর মার্কা সকল গাড়ী বাজেয়াপ্ত করে সরকারি গুদামে রাখা হোক এবং বি.আর.টি.এ পূনর্গঠন করা হোক।
ছয়. হাইওয়ে পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত করার কার্য্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন করা;
সাত. স্বল্প গতি সম্পন্ন তিন চাকার গাড়ী যেমন, রিক্সা, স্কুটার, ইনজিন চালিত রিক্সা প্রভৃতি চলাচলের লেন তৈরী করা;
আট. ফুটপাতের দোকানগুলি কঠোরভাবে তুলে দিয়ে স্বল্পভাড়ায় তাদের জন্য দোকানের ব্যবস্থা করা;
নয়. নতুন নতুন বিকল্প রাস্তা তৈরী ও সম্প্রসালন করা;
দশ. রেলপথ উত্তর ও দক্ষিণ বাংলায় ব্যাপকভাবে নির্মাণ করে রেলগুলিকে ভারতের মত প্রধান যাত্রী বহনকারী যানে পরিণত করা। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে বগি ও ইঞ্জিন দ্রুত আমাদানীর ব্যবস্থা করা। বিনা টিকেটে ব ছাদে যাত্রীবহন কঠোরভাবে বন্ধ করা। বর্তমানে চালু থাকা ট্রেনগুলিকে অবিলম্বে দ্বিগুণ সংখ্যক বগি ও শক্তিশালী ইঞ্জিন স্থাপনের ব্যবস্থা করা। চলমান লেপথগুলিে আরও বেশী সংখ্যক ট্রেন চালু করা এবং রেল ভ্রমণ অধিকতর আরামদায়ক ও সময়মত চলাচলের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে রেলওয়ে যাত্রীসেবা আধুনিক করা হোক;
এগার. যতই কঠিন হোক নদীপথগুলিকে নদী খনন ও বেদখল নদীর জমি উদ্ধার করে নদীখনন ব্যাপকভাবে করে নদীপথে যান চলাচল, কৃষকের সেচকার্য্যের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও পরিবেশ উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
এইসব নানামূখি ব্যবস্থা স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে গ্রহণ করে পরিবহন সংকটের স্থায়ী সমাধান করা হোক।